পাঞ্জাব: দেশভাগের পরের উথাল পাতাল রাজনীতি


 পারভেজ সেলিম


 (পর্ব : ০৫)

ভারতে ইংরেজদের ১৯০ বছরের শাসনের পরিসমাপ্তি হলো। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে গেল ইংরেজরা।

সংকট শুরু হলো এবার।

নতুন ভারতের কংগ্রেস সরকার যখন ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠণের কাজে হাত দিলো, শিখরা দেখল তাদের জন্য কোন পৃথক রাজ্যের রাখা হয়নি।

অসন্তোষ আরো বাড়তে শুরু করলো

পাঞ্জাবের হিন্দুরা নিজেদের হিন্দি ভাষী বলে জনগণনায় পরিচয় দিল। পাঞ্জাবের ভারতীয় অংশ হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল।

এই নিয়ে হিন্দুদের সাথে শিখদের তিক্ততা বাড়তে শুরু করলো।

ফলাফল ১৯৫৫ সালে পাঞ্জাবে শুরু হয় ‘শুভা আন্দোলন’। দেশভাগের এক দশকের পার না হতেই ভাষা ভিত্তিক রাজ্য ও স্বায়িত্বশাসনের দাবি তোলা শুরু করলো শিখরা।

এই আন্দোলনও আকালী দলের নেতৃত্বেই হচ্ছিল। তাদের মুল দাবি ছিল ভারতের মধ্যে এক স্বতন্ত্র শিখ রাজ্য।

আকালি পার্টি ও তারা সিং শিখদের আস্থা অর্জন শুরু করে

মাস্টার তারা সিং (১৮৮৫-১৯৬৭) তখন আকালী দলের প্রধান। পাঞ্জাবীদের দাবি পুরুণের জন্য তিনি আমরণ অনশন শুরু করলেন।

১৯৬৬ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শণ করেন শিখরা।

এর পুরুস্কার হিসেবে ১৯৬৬ সালে সরকার ‘পাঞ্জাব রিঅর্গানাইজ অ্যাক্ট’ পাশ করে খুব সহজে।

এর আন্দোলনের সফলতায় আকালি দলের জনপ্রিয়তা এসময় বাড়তে থাকে হু হু করে।

এসময় হরিয়ানাকে আলাদা রাজ্যে পৃথক করা হয়। পাঞ্জাবের সীমানা হিমাচলের পাহাড় পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

তবে চন্ডিগড়কে হরিয়ানা ও পাঞ্জাব দুই রাজ্যের রাজধানী বানানো হয়। এ আরেক সংকটের সূত্রপাত হলো।

এখন ভারতের পাঞ্জাব শুধু পাঞ্জাবী ভাষাভাষীদের রাজ্য হলেও সংকট পুরোপুরি মিটলো না।

রাজধানী চন্ডিগড়ে হিন্দুরা সংখ্যায় বেশি শিখরা সেখানে সংখ্যালঘু।

ইন্দিরা গান্ধী (1917-1984)

সরকারের এমন সিদ্ধান্তে আকালী দল ও ‘শিরোমনি গুরুদুয়ারা প্রবন্ধক কমিটি’ (এসজিপিসি) অসন্তোষ প্রকাশ করলো।

এর কিছুদিন পরই পাঞ্জাবের তিন প্রধান নদী রাভি, বিয়াস ও সুতলজেম ক্যানেল পদ্ধতি চালু করা হয়।

যাতে হরিয়ানা ও রাজস্থানে পানি দেবার ব্যবস্থা করা যায়। এর ফলে পাঞ্জাবের পানি কমে গিয়ে মাত্র ২৩% এ নেমে এসেছিল।

সাধারণ জনগনও সরকারের এই সিদ্ধান্তে অখুশি ছিল। প্রতিনিয়ত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলতে থাকে পাঞ্জাবে। সে আন্দোলন ধীরে ধীরে রুপ নেয় সহিংসতায়।

১৯৭১ সালে পাঞ্জাব থেকে হিমাচলকে আলাদা করে কেন্দ্র শাসিত রাজ্য করা হয়।

প্রকাশ সিং বাদল : আকালী দলের নির্ভরতা

সত্তর দশকে পাঞ্জাবে কৃষি বিপ্লব ঘটে। সাথে নতৃন সংকট দেখা দেয়। শিক্ষিত উচ্চাবিলাসী শিখরা কানাডা আমেরকিরা ইংল্যান্ডে পাড়ি থাকে।

আর বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে দিনমজুর হিন্দুরা এসে পাকাপাকি থাকতে শুরু করে পাঞ্জাবে। ভোটার লিস্টে নাম ওঠতে থাকে। শিখদের সংখ্যা কমতে থাকে পাঞ্জাবে। সংকট এবার অন্যরকম জটিলতায় মোড় নেয়।

১৯৭৩ সালে এক নতুন পদক্ষেপ নেয় খালাসা মতাদর্শের আনন্দপুর সাহিব দলের নেতারা। ‘আনন্দপুর সাহিব রেজুল্যশন’এ শিখদেরকে একটা আলাদা জাতি হিসাবে প্রস্তাব করা হয়।

আশেপাশের রাজ্য সহ এক বৃহৎ পাঞ্জাবের রাজ্যের পূর্ণ স্বায়িত্বশাসন দাবি করা হয় এই প্রস্তাবে।

দারবারা সিং : কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী, ১৯৮০ ফেব্রুয়ারি

এমন ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির বিরাগ ভাজন হয় আকালি পার্টি। এর পর ১৯৭৫ এ ভারতে প্রথমবারের মতো যখন ইমার্জেন্সি জারি করা হয়, তখনও ইন্দিরার বিরোধিতা করেছিল আকালী দল।

কংগ্রেস, আকালী দল ও জনতা পার্টি প্রধান রাজণৈতিক দল তখন পাঞ্জাবে।

প্রধান প্রতিদ্বন্দী কংগ্রেস ও আকালি দল।

শিখদের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট খবুই প্রখর। পাঞ্জাবের ভোটের রাজনীতিতে ধর্মীয় প্রভাব অনেক গভীরে। তাই শিখ সাধু ও ধর্মীয় গুরুদের নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য মরিয়া সকল রাজনৈতিক দলগুলো।

আকালী, কংগ্রেস আর বিজেপির পুর্বসুরি জনতা দল মিলে তখন ক্ষমতার কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছে পাঞ্জাবে।

মাস্টার তারা সিংহ, ফতেহ সিং, গুরনাম সিং ষাট ও সত্তর দশকের পাঞ্জাবে রাজনীতির প্রধান হর্তাকর্তা ছিলেন।

১৯৭৭ সালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হন।

মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে বিজয়ী হয় ‘জনতা এলায়েন্স’। ক্ষমতা এবার বিজেপির পুর্বসুরি জনতা দলের হাতে।

পাঞ্জাবে আকালী ও জনতা দলের জোট সরকার গঠণ হয়। ১৯৭৭ সালের ২০ জুন দ্বিতীয়বারে মতো মুখ্যমন্ত্রী হন আকালী দলের প্রকাশ সিং বাদল।

মাত্র দুই বছরে মাথা আকালী দলকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসে কংগ্রেস। ১৯৮০ সালে ফেব্রুয়ারিতে মুখ্যমন্ত্রী হন দরবারা সিং।

ভার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালা নামের এক সাধু এসময় পাঞ্জাবের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে উঠতে শুরু করেছেন।

তার স্বাধীন শিখ রাজ্যের দাবি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শিখ তরুণদের মধ্য ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে শুরু করেছেন তিনি।

আকালী দলের স্বায়িত্বশাসনে তিনি আর সন্তুষ্ট ছিলেন না, তার সমর্থণ এখন শিখদের জন্য সম্পুর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্রে।

জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে : সামনের রাজনীতি পুরোটা তাকে ঘিরে।

ইন্দিরা গান্ধী এই উদীয়মান তরুণ ধর্মীয় নেতাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলেন। কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিদ্বন্ধী ও ধর্মীয় রাজণৈতিক প্রতিপক্ষ আকালী দলকে পরাজিত করার তুরুপের তাস ভাবলেন ভিন্ড্রানওয়ালেকে।

পুত্র সঞ্জয় গান্ধি এবং পাঞ্জাবের কংগ্রেস নেতা জ্ঞানী জৈল সিং এর সহযোগিতায় ভয়ংকর এক সাম্প্রদায়িক খেলায় মেতে উঠেন ইন্দিরা গান্ধির কংগ্রেস।

১৯৪৭ এর দেশভাগ, ১৯৫৫ সালের সুবাহ আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের পাঞ্জাব রিঅর্গানাইজ অ্যাক্ট পাশ, ১৯৭১ এর নির্বাচণের কংগ্রেস বিশাল জয়, ১৯৭৩ এর আন্দনপুর রেজুলেশন, ১৯৭৫ এর ইন্দিরা গান্ধির জরুরী অবস্থা, ১৯৭৭ এর নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি, জনতা দলের ক্ষমতা দখল, সবই যেন এক অশুভ বীণার তারে বেজে চলার সুরের মতোন। সামনে ভয়ংকর কিছু হয়ত অপেক্ষা করছে।

পাঞ্জাবের রাজনীতির সাথে গোটা ভারতের রাজনীতি যে নুতন ভয়াবহ এক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন কে তা জানতো

 (চলবে..)


 পারভেজ সেলিম
লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী

‘খালিস্তান আন্দোলন’ আরো কয়েকটি পর্ব পড়ুন :

পর্ব : ০১ : খালিস্তান: শিখদের স্বপ্নের স্বাধীন দেশ

পর্ব : ০২ : গুরু নানক: যার হাতে নতুন ধর্মের শুরু

পর্ব : ০৩ : দশ গুরু: শিখ ধর্ম যাদের হাতে গড়ে উঠেছে

 পর্ব : ০৪ : পাঞ্জাবের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও দেশভাগের প্রবঞ্চনা!

 পর্ব : ০৫ : পাঞ্জাব: দেশভাগের পরের উথাল পাতাল রাজনীতি

 পর্ব : ০৬ : খালিস্তান: প্রবাসী সরকার ও পাকিস্তানের মদদ

পর্ব : ০৭ : জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে: এক সাধুর উত্থান ও ট্রাজিক পতন

 পর্ব : ০৮ : কে এই জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে?

পর্ব : ০৯ : অপারেশন ব্লু স্টার: ইন্দিরা গান্ধির শেষ যুদ্ধ !

পর্ব : ১০ : ইন্দিরা গান্ধী হত্যা: শিখদের হাতেই জীবন উৎসর্গ!

৩ thoughts on “পাঞ্জাব: দেশভাগের পরের উথাল পাতাল রাজনীতি

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x