দশ গুরু: শিখ ধর্ম যাদের হাতে গড়ে উঠেছে


পারভেজ সেলিম


(পর্ব : ০৩)

শিখ ধর্ম মতে মানুষের পাঁচটি ক্ষতিকর দিক হলো কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহংকার।

আর সততা, সন্তোষ, দয়া, নম্রতা, ও প্রেম এই পাচটি হলো মানুষের সদগুন।

একে একে দশজন গুরু জীবনের এমন শিক্ষা আর স্রষ্টার গুনকীর্তণ করে ১৪৩০ টি স্তোত্র লিখেন, যা শিখদের পবিত্র গ্রন্থ ‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’ এ সংকলিত হয়।

১৫৩৯ সালে ৬৯ বছরে যখন গুরু নানক মারা যান তখন মাত্র কিছুদিন আগে দিল্লির ক্ষমতা বসেছে মুঘলরা।

মৃত্যুর আগে তিনি গুরুর ভার দিয়ে যান তার প্রিয় শিষ্য ভাই লহনাকে। পরে যিনি ‘গুরু অঙ্গদ’ নামে পরিচিতি পান।

নিজের দুই পুত্র থাকার পরও কেন গুরু ভার শিষ্যকে দিয়ে গেলেন নানক? তা নিয়ে একটি জনশ্রুতি আছে।

একবার এক পানির পাত্র কাঁদায় পড়ে গেলে বড় পুত্রকে আনতে বলেন নানক। বড় ছেলে নোংরা বলে তা আনতে অপরাগ হন, অন্য পুত্রও এটা ভৃত্যের কাজ বলে এডিয়ে যান।

এরপর শিষ্য ভাই লহনাকে যখন বললেন কাজটি করতে, তখন তিনি কাঁদা থেকে পাত্রটি তুলে ধুয়ে পরিস্কার করে গুরু নানককে সেই পাত্রেই পানি খেতে দিলেন।

শিষ্যের এমন আচরণই প্রত্যাশা করেছিলেন পুত্রদ্বয়ের কাছে। কিন্তু তারা তাকে নিরাশ করেছিল।

হয়ত সেই কারণেই গুরু নানকের মৃত্যুর আগে সন্তান নয় শিষ্যকেই তার উত্তরসুরি নির্ধারণ করে যান। ভাই লহনা হন শিখদের দ্বিতীয় গুরু অঙ্গদ।

গুরু অঙ্গদ (১৫০৪-১৫৫২) ছিলেন দেবী দূর্গার ভক্ত ও ধর্মীয় শিক্ষক।

বয়সের ৩০ হবার আগেই গুরু নানকের সাথে তার দেখা হয়েছিলড়। গুরু নানকের স্তোত্রগুলি তিনি সংকলণ করেন এবং ৬২ টি স্তোত্র নিজে লেখেন।

গুরুমুখি লিপির জন্য তার নাম বেশি সমাদৃত।

নানকের মতো তিনিও তার শিষ্য থেকে পরবর্তী গুরু নির্বাচণ করেন।

তৃতীয় গুরু অমর দাস (১৪৭৯-১৫৭৪) এর সময় থেকে শিখদের সার্বজনীণ উৎস হয়ে ওঠে ‘বৈশাখ’।

তিনি পর্দা প্রথা, বহুবিবাহ যেমন বন্ধ করেন, তেমনি সতীদাহ, বিধবা বিবাহ, আন্তবর্ণের বিবাহ চালু করেন।

শিখরা ধীরে ধীরে হিন্দু মুসলমান থেকে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন।

চতুর্থ গুরু রাম দাস (১৫৭৪-১৫৮১) অমৃতসর শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বর্নমন্দির নির্মাণ শুরু হয় তার হাতে।

পঞ্চম গুরু অর্জুনের (১৫৬৩-১৬০৬) সময় অমৃতসরে স্বর্নমন্দির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। নিজেদের মন্দির তৈরির আগে শিখরা হরিদ্বার বা বারাণসীতে তীর্থ করতে যেতেন।

ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করার অপরাধে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর হত্যা করে গুরু অর্জুনকে। তিনিই প্রথম গুরু যিনি হত্যার শিকার হন।

পিতার মৃত্যুর পর ১১ বছর বয়সে ষষ্ঠ গুরু হন হরগোবিন্দ (১৫৯৫-১৬৪৪)।

মোঘলদের সাথে বৈরিতার কারণে তাকে ১২ বছর বন্দি করে রেখেছিল। তবু দমে যাননি তিনি। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সাথে সাত বছর যুদ্ধ করে টিকে ছিলেন এই গুরু। অস্ত্র নিয়ে সরাসরি যুদ্ধ করা প্রথম গুরু তিনি।

আকাল তখত তার হাতে নির্মিত হয়েছিল। যেখানে বসে তিনি ন্যায় অন্যায়ের বিচার করতেন। আকাল তখতের সিংহাসনটি ছিল সম্রাটদের সিংহাসনের চাইতে কিছুটা উঁচুতে, কারণ সম্রাটদের উপরে স্রস্টার স্থান বলেেই মনে করতো শিখরা। আকাল তখত মানে তো ‘স্রষ্টার সিংহাসন।’

এরপর হরগোবিন্দের নাতি গুরু হররাই (১৬৩০-১৭৬১) সপ্তম গুরু হন।

সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারার পক্ষ নেয়ায় আওরঙ্গজেব তাকে হত্যা করেন। মাত্র ৩১ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি।

অষ্টম গুরু হরকিষণ (১৬৫৬-১৬৬৪) মাত্র ৭ বছর বেঁচে ছিলেন।

নবম গুরু তেগ বাহাদুর (১৬২১-১৬৭৫) মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন হিন্দুদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার প্রতিবাদে।

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে তাকেও হত্যা করা হয়। তেগ বাহাদুরই একমাত্র ব্যক্তি যিনি অন্য ধর্মের অধিকার রক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

তিন জন গুরু হত্যার শিকার হবার পর, ১৬৯৯ সালে দশম গুরু গোবিন্দ সিং ‘খালসা বাহিনী’ গঠণ করেন। পরবর্তীতে যা শিখদের সামরিক জাতিতে পরিনত করে।

যদিও মুঘলরা সবসময় শিখদের অস্ত্রধারী হিন্দু মনে করতো।

১৭০৮ সালে দশম গুরু গোবিন্দ সিং ঘোষণা করেন আর কোন মানব গুরু আসবেনা।

শিখদের শেষ গুরু হবে দশ গুরুর অমৃতবচন ও উপদেশ মালা ও স্তোত্রের লিখিতরুপ। নাম ‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’। গুরুমুখি লিপিতে প্রাচীন পাঞ্জাবী ভাষায় লেখা পবিত্র গ্রন্থটি।

১৪৩০ অঙ্গে বিভক্ত এই গ্রন্থ পৃথিবীর একমাত্র ধর্মীয় পবিত্র গ্রন্থ যাতে অন্য ধর্মের মানুষের লেখাও স্থান পেয়েছে।

১৪৬৯ থেকে ১৭০৭ সালে মধ্যে এর স্তোত্রগুলি লিখা হয়েছে। যার বেশিভাগগুলি স্রষ্টার গুণকীর্তণ।

‘গুরু গ্রন্থ সাহেব’ শিখদের শেষ ও চিরন্তন গুরু। এটিই শিখ ধর্মের মানুষদের পবিত্র গ্রন্থ।

শিখদের ধর্মীয় প্রভাব, ইংরেজ আগমণ ও দেশভাগের পর আলাদা জাতিয়তাবাদ কিভাবে খালিস্তান আন্দোলনে রুপ নিলো?

 (চলবে..)


পারভেজ সেলিম

লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী


‘খালিস্তান আন্দোলন’ আরো কয়েকটি পর্ব পড়ুন :

পর্ব : ০১ : খালিস্তান: শিখদের স্বপ্নের স্বাধীন দেশ

পর্ব : ০২ : গুরু নানক: যার হাতে নতুন ধর্মের শুরু

পর্ব : ০৩ : দশ গুরু: শিখ ধর্ম যাদের হাতে গড়ে উঠেছে

 পর্ব : ০৪ : পাঞ্জাবের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও দেশভাগের প্রবঞ্চনা!

 পর্ব : ০৫ : পাঞ্জাব: দেশভাগের পরের উথাল পাতাল রাজনীতি

 পর্ব : ০৬ : খালিস্তান: প্রবাসী সরকার ও পাকিস্তানের মদদ

পর্ব : ০৭ : জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে: এক সাধুর উত্থান ও ট্রাজিক পতন

 পর্ব : ০৮ : কে এই জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে?

পর্ব : ০৯ : অপারেশন ব্লু স্টার: ইন্দিরা গান্ধির শেষ যুদ্ধ !

পর্ব : ১০ : ইন্দিরা গান্ধী হত্যা: শিখদের হাতেই জীবন উৎসর্গ!

৩ thoughts on “দশ গুরু: শিখ ধর্ম যাদের হাতে গড়ে উঠেছে

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x