পারভেজ সেলিম
(পর্ব : ১০)
শিখদের পবিত্র স্বর্নমন্দিরে সেনাবাহিনীর অভিযান এবং এক সাথে এত মানুষের প্রাণহানিতে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো ভারত। ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ এর প্রতিক্রিয়া ধারণার চাইতে বেশি দেখা দেয় শিখদের মনে।
চারিদিকে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সহিংসতা ভয়াবহ রুপ নেয়। সেনাবাহিনীর শিখ সদস্যরা বিদ্রোহ করে বসে। যদিও পরে তাদের মার্শাল ল এর মাধ্যমে বিচার করা হয়েছিল।
অন্যদিকে কানাডা প্রবাসী শিখরা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি প্লেনে বোমা হামলা চালায়। নিহত হয় প্লেনের সকল যাত্রী। সংখ্যাটা ৩২৯। ভিন্দ্রানওয়ালের হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে এই হামলা চালিয়েছে বলে স্বীকার করে হামলাকারিরা।
স্বর্নমন্দিরের নৃশংস অপারেশনকে শিখরা তাদের ধর্মের উপর সরাসরি আঘাত হিসেবে ধরে নেয়। পরিস্থিতি যখন থমথমে, ভারতের গোয়ান্দা প্রধান একটি বিশেষ রির্পোট নিয়ে হাজির হন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার গান্ধীর কাছে।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত শিখ সৈন্যদের তারা সরিয়ে দিতে চান। কারণ বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য শিখরা ভীষণ ঝুঁকিপুর্ন বলে মনে করেন তারা। এই সময় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার ব্যাপারে কোন ধরণের ঝুঁকি নিতে চাননা নিরাপত্তা গোয়ন্দারা।
প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে যখন এমন প্রস্তাব যায় তখন মিসেস গান্ধী সেই প্রস্তাব ছিঁড়ে ফেলে বলেছিলেন, ‘ভারত কি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়? ‘।
অতিমাত্রায় বিশ্বাস আর আবেগের চরমমুল্য দেবার জন্য যেন প্রস্তুত হতে থাকেন এশিয়ার লৌহমানবী খ্যাত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি।
৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪
সকাল সকাল দিল্লীর সফদরজঙ্গ রোডের বাসভবনের বাগান যেন এক নিস্তব্ধ নিরবতায় বিষন্ন হয়ে আছে ।
আজ একটি আইরিশ টেলিভিশনের তথ্যচিত্রের জন্য ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভকে সাক্ষাৎকার দেবার সময় নির্ধারণ করা ছিল প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর।
সকাল সাড়ে সাতটায় কালো পাড়ের গেরুয়া রং এর একটি শাড়ী পরে তৈরি হয়েছিলেন তিনি।
প্রতিদিনের রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে ঘড়িতে যখন ৯ টা বেজে দশ তখন বাইরে বের হন মিসেস গান্ধী। সেদিন বাইরে বেশ রোদ ছিল। সেপাই নারায়ণ সিং একটা কালো ছাতা নিয়ে তার পাশে হাটছিলেন।
তার পিছনে ছিলেন ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান এবং ব্যক্তিগত পরিচারক নাথু রাম। সবার পিছনে ছিলেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার সাব ইন্সপেক্টার রামেশ্বর দয়াল।
এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা স্তরের কৌশল পরিবর্তন করা হয়েছে, একসঙ্গে দুই শিখ সদস্যকে দায়িত্বে রাখা হতো না।
বিয়ন্ত সিং ও সৎবন্ত সিং নামের দুই বিশ্বস্ত শিখ সদস্যের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দুইটি আলাদা জায়গায় দেয়া। কিন্তু পেটের সমস্যার কথা বলে ওয়াশরুমের পাশে ডিউটি নেন সৎবন্ত সিং। তার সাথে ছিল ম্যাগজিন সহ মেশিনগান।
বাসভবনের লাগোয়া দপ্তর ছিল আকবর রোডে। দুটি ভবনের মাঝে যাতায়াতের একটা রাস্তা ছিল। সে রাস্তার দরজার সামনে দিয়ে মিসেস গান্ধি যখন পার হচ্ছিল তার পাশেই ছিলেন দেহরক্ষী বাহিনীর শিখ সদস্য বিয়ন্ত সিং।
মুহর্তেই বিয়ন্ত সিং তার রিভালবর বের করে তিন রাউন্ড গুলি ছোড়ে প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে।
প্রথম গুলিটা লাগে পেটে, বাকি দুটো লাগে বুকে ও কোমরে। ওখান থেকে মাত্র পাঁচ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে ছিল সৎবন্ত সিং। পরিস্থিতির আকষ্মিকতায় তিনি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কয়েক মুহুর্তের জন্য।
বিয়ন্ত সিং এবার চিৎকার করে গুলি চালাতে বললে হুশ ফেরে তারা। সৎবন্ত সিং এবার তার দায়িত্ব পালন করতে থাকে। অন্যরা কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্টেনগান থেকে আরো ২৫ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে ঝাঁঝরা করে দেয় ইন্দিরা গান্ধির বুক। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
হঠাৎ কয়েকটা পাখি উড়ে চলে যায়। পুরো বাগান বাড়ি কয়েক মুহর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। গাছ, পাখি, মানুষ সকলেরই বিশ্বাস করতে কিছুক্ষণ সময় লাগে। এশিয়ার আয়রণ লেডির রক্তাত্ব শরীর ততক্ষনে লুটয়ে পড়েছে মাটিতে। রক্তে শাড়ি ভিজে লাল হয়ে গেছে।
এরপর নিরাপত্তা বাহিনীর চিৎকার ও দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। নিরাপত্তা অফিসার রামেশ্বর দয়াল এগিয়ে এলে তার পায়েও গুলি লাগে, তিনি মাটিতে পড়ে যান।
দুই বডিগার্ড ততক্ষণে অস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রেখে হাত উচু করে আত্নসমর্পণ করেছেন। বিয়ন্ত সিং বলেন ‘আমাদের যা করার আমরা তা করেছি, এবার তোমাদের যা করার তোমরা তা করো।’
নিরাপত্তা রক্ষীর গুলিতে সেখানেই নিহত হন বিয়ন্ত সিং। গ্রেফতার হন সৎবন্ত সিং।
দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে করে চার কিলোমিটার দূরের অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট ফর মেডিক্যাল সায়েন্স হাসপাতালে নেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়না।
রক্তাত্ব প্রধানমন্ত্রীর নিথর শরীর নিয়ে অ্যাম্বুলেস হাসপাতালে ঢুকে ন’টা ৩২ মিনিটে।
তার রক্তের গ্রুপ ছিল ও নেগেটিভ। ৮০ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে। শরীরে যে পরিমাণ রক্ত থাকে, এটা ছিল তার প্রায় ৫ গুণ।
প্রধানমন্ত্রী যে আর বেঁচে নেই, সেটা সকলেই বুঝতে পারছিল, কিন্তু তবুও হাসপাতালের আটতলার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে।
শরীরের ১৯ টি বুলেটের মধ্যে বের করা হয় ৭টি। ধারণা করা হয় গুলি লাগার এক ঘন্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছিল। দুপুর ২.২৩ ডাক্তার অফিসিয়ালি মৃত ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রীকে।
১৯৮৪ সালে ৩১ অক্টোবরের সন্ধ্যা ছয়টা সরকারি টেলিভিশনে জানানো হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি নিহত হয়েছেন।
‘অপারেশন ব্লু স্টারের’ প্রতিশোধ হিসেবে ইন্দিরা গান্ধিকে হত্যা করেছেন বলে আদালতে স্বীকার করেন অভিযুক্তরা। বিচার শেষে সৎবন্ত সিং ও পরিকল্পনাকারি কেহার সিং এর ফাঁসি কার্যকর হয়।
ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পর নতুন আরেক ভয়াবহ সংকটের দিকে এগিয়ে যায় ভারত। মুহুর্তেই শিখ বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতজুড়ে। বিশেষ করে দিল্লীতে নিরাপরাধ সাধারণ শিখদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে হিন্দুরা। তিনদিনে প্রায় তিনহাজার শিখকে হত্যা করা হয়। রক্তের বদলে রক্তে ভিজতে থাকে ভারতের রাজনীতির ইতিহাস।
পারভেজ সেলিম
লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী
yasam ayavefe best man
This is a topic I’ve been curious about. Thanks for the detailed information.