বিদ্রোহী: একশো বছর পরেও বোধের রক্তে আগুণ

---

পারভেজ সেলিম

---

বাসায় ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল। এগারোটা। ফাঁকা বিষণ্ণ দুটো ঘর। দেশের সর্বত্র অনিয়ম। বিচারহীনতা। ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত। শীতের গভীর রাত। কাপড় না ছেড়েই কম্পিউটার স্ক্রিনে অগোছালো চোখ তখন। 

গ্রামের কোন এক কৃষকের মুখ হঠাৎ শুনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। শুনতে, শুনতে, শুনতেই থাকলাম। কেমন এক আচ্ছনতায় আবিষ্ট হলাম।

শুনেছি এর আগে অনেক! আবার পড়তে শুরু করলাম। টিটো মুন্সী ও শিমুল মোস্তফার কন্ঠে আরেকবার শুনলাম ‘বিদ্রোহী’। কিন্তু এবার কি হলো? 

প্রতিটি শব্দ, বাক্য নতুন করে উদ্ভাসিত হতে লাগলো। নিমিষেই যেন শেষ হয়ে গেল ১৩৯ লাইনের কবিতাটি।

সবার শেষে ঝাপটা মেরে উঠলো ‘আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির -উন্নত মম শির’ লাইনটি।

‘একা’ শব্দটি এর আগে কানে এতটা বাজেনি কেন? ‘একা চির উন্নত মম শির’। অসামান্য এক গর্ব অনুভব হলো মুহুর্তেই ।

চোখের কোনে হটাৎ পানি, বুক ধরে এলো, একা শুন্য ঘরটাতে বুকের ছাতি যেন কয়েক ইঞ্চি বেড়ে গেল। একশো বছর আগে মাত্র ২২ বছরের এক যুবক এ কি স্পর্ধার কথা বলছেন! 

‘খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির- বিষ্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর’…

‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাধ !..

উচ্চকিত নজরুলের কবিতা কখনো এভাবে আমাকে কাঁপায় দেয়নি এর আগে। আমার বোধের মধ্যে নজরুল এবার প্রবেশ করলো অবলীলায়।

‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’..

স্তব্ধ শূণ্য ঘরে আমি মিশে গেলাম দ্রোহে আর বিদ্রোহে। আর ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেল সব ক্ষুদ্রতা।

‘আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে’…।

‘বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,

জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,

আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য’!…

বিষ্ময়ের ঘোর কাটে না, একশ বছর আগে নজরুল যা বলেছে, সেতো আজকের বিকেলে আমার যে উন্মাতাল দ্রোহ, শেষ পর্যন্ত যা আকাশে উড়ে গেল, সেই কথা শতবর্ষে আগে কিভাবে এত স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন কবি। 

এভাবে তো এর আগে শুনিনি! বোধের রক্তে নতুন আগুন জ্বললো যেন। যেন পাথরে পাথরে ঘষে আগুণ জ্বলে উঠল কোন এক আদিম ইরাক্টাস মানুষের গুহায়।

‘বিদ্রোহী’ ! বিদ্রোহ! করতে করতে এই কবিতাটিকে এমন এক ট্যাগ লাগানো হয়েছে যে, শুধু ইংরেজ হটাও আন্দোলন, পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গার গান আর বিদ্রোহের কবিতা হয়ে রইল। অথচ এই কবিতা আরো বড় কিছু, মহৎ কিছু। 

মানুষের আত্নপরিচয়ের অনন্য এক প্রকাশ তো ঢাকা পড়েছে বিদ্রোহী তকমার আড়ালে।

‘আমি মানব দানব দেবতার ভয়..’ 

‘নির্জরের স্বপ্নভঙ্গে’র রবীন্দ্রনাথ ও ‘বোধে’র জীবনানন্দকে ঠিক এমন এক সন্ধ্যা কিংবা রাতে আমি বোধের ভিতর পেয়েছিলাম। এত বছর পর নজরুল এসে ধরা দিলো মনে ও মগজে। 

‘আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ’…।

‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু,ভগবান বুকে এঁকে দেই পদ-চিহ্ন’….

যে লাইনটাই পড়ছি তাই যেন মননে আর মগজে স্পষ্ট ঢুকে যাচ্ছে। একজন সত্যিকারের মানুষের তো এমনই ‘উন্নত শির’ই হবার কথা ছিল! 

কবিতার কি অসীম কাল্পনিক শক্তি! পৃথিবীর সকল প্রাণী থেকে মানুষ আলাদা বা শ্রেষ্ট হতে পারলো শুধু নিজেকে এভাবে কল্পনা করতে পারে বলে!  অন্য কোন প্রাণীরা কল্পনা করতে পারেনি তাই হয়ত তারা বিলুপ্ত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ যখন বলে ‘চিত্ত যেথা ভয় শুন্য’, নজরুল তখন গেয়ে ওঠে ‘আমি চির উন্নত শির’..

মানুষের মর্যাদা ও শক্তির এক অনবদ্য প্রকাশ দেখতে পাই এখানে, যেন এক নিশ্বা:সে মানুষের পুরো ক্যানভাস এঁকে যাচ্ছেন কবি।

‘আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’….

‘আমি সৃষ্টি আমি ধ্বংস আমি লোকালয় আমি শ্মশান’….

‘মম এক হাতে বাঁশের বাশরী আর এক হাতে রণ তূর্ষ’….

‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’….

‘আমি সেই দিন হবো শান্ত

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না’…

‘আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত মম শির’..।

প্রকাশের পরের ১০০ বছরে কবিতাটির প্রতিটি লাইন একেকটি কিংবদন্তী হয়ে উঠবে । বাঙ্গালীর জয়ে, সংগ্রামে, আন্দোলনে যুগে যুগে সাহস যোগাবে এই কবিতার পক্তিগুলো।

সবকিছু ছাপিয়ে ব্যক্তি মানুষের একার যে লড়াই সেখানে এই কবিতা হয়ে উঠবে মানুষের এক মহাকাব্যিক প্রকাশ। আর আমার মননে তা ধরা পড়বে অনেক বছর পর, এক শীতের রাতে।

---

(চলবে..)

---

 পারভেজ সেলিম

লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী