রানু মুখার্জি: রবীন্দ্রনাথ তখন ৫৭ রানু ১২


পারভেজ সেলিম


সাল ১৯১৭। 

রানু বারাণসীর মেয়ে। বাবা ফণিভূষণ অধিকারি বেনারসীর হিন্দু ইউনিভার্সিটির দর্শণের অধ্যাপক ছিলেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রানু তৃতীয়। রবীন্দ্রনাথের সাথে রানুর বয়সের তফাত পয়তাল্লিশ বছরের। রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ৫৭ বছর তখন রানুর বয়স মাত্র ১২ বছর!

রানুর জন্মই হয়েছিল ১৯০৬ সালে। তার ভালো নাম প্রীতি অধিকারী।

ছোটবেলায় মায়ের মুখে রবীঠাকুরের গান শুনে শুনেই বড় হয়েছে রানু। বড় হবার পর গভীরভাবে পরিচিত হতে থাকে রবীর লেখার সাথে।

১২ বছর বয়সে রানু প্রথম চিঠি লেখেন রবী বাবুকে। বয়সে ছোট হলেও বেশ বড় বড় কথা লিখতে লাগলেন চিঠিতে। মনে হত যেন রবীর প্রায় সব লিখায় তার পড়া শেষ। চিঠিতে অভিযোগ করছেন তিনি এত কম লিখেন কেন? 

রবীন্দ্রনাথের সাথে রানুর বয়সের তফাত পয়তাল্লিশ বছরের

রানু প্রথম চিঠি লেখেন ১৩২৪ সালের শ্রাবণ মাসে। কবি উত্তর দেন ভাদ্র মাসে।

এর নয় মাস পর ১৯১৮ সালের ১৫ মে প্রানু আর ভানুর প্রথম দেখা হয়।

রানু তার বাবার চিকিৎসার জন্য কাশি থেকে কলকাতা এসেছিলেন। উঠেছিলেন ল্যান্সডাউন রোড়ের ভাড়া করা বাড়িতে।

কলকাতা পৌঁছে তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলেন। গিয়ে হাতের উপর হাত রেখে মন ভরে দেখেছিলেন তার এত দিনের প্রিয় মানুষটাকে।

অতুল সেনের আকা লেডি রানু

রবীর বড় মেয়ে মাধুরীলতা মারা গিয়েছিলেন যক্ষায়। মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে দেখতে গিয়ে যখন জানতে পারেন সে আর দুনিয়াতে নাই তখন সিঁড়ি থেকেই ফিরে এসেছিলেন কবি।

বাড়ি ফিরে বিকেলে সোজা চলে গিয়েছিলেন ল্যান্সডাউন রোডে রানুর সাথে দেখা করতে।

দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধনগ্ন রানুকে দেখতে পান রবী। রবী বাবু এসেছেন শুনে স্নানঘর থেকে সোজা চলে এসেছিলেন দরজায়। খেয়ালই ছিল না তার শরীর অনাবৃত।

পয়তাল্লিশ বছরের ছোট একটি মেয়ের সাথে সম্পর্কের শুরু এভাবেই। চিঠিতে রবী লিখেছেন ‘আমার খুব দুঃখের সময় তুমি আমার কাছে এসেছিলে’।

কাদম্বরীর ছায়া হয়ত দেখেছিলেন রানুর মাঝে। কবি লিখলেন…

‘এই বুঝি মোর ভোরের তারা এল সাঁঝের তারা বেশে

অবাক চোখে ওই চেয়ে রয় চিরদিনের হাসি হেসে

সকাল বেলা পাইনি দেখা পাড়ি দিল কখন একা

নামল আলোক সাগর-পারে অন্ধকারের ঘাটে এসে’।

রানু শান্তিনিকেতনেও এসে রবী বাবুর সাথে ছিলেন কিছু দিন। 

আর চিঠি লেখা যেন দুজনের নতুন আনন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ধীরে ধীরে রানুর বয়স বাড়ে ১৮ হয় । হৃদয়ের ঘনিষ্টতা আরো বাড়ে। কিন্তু রানু তো আর তার আজীবনের জন্য নয়।

১৯২৫ সালের ২৮ জুন স্যার রাজেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায়ের ছেলে স্যার বীরেনের সাথে

রানুর বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে রানুর মা সরয় দেবীকে চিঠি লিখেছিলেন উদ্বিগ্ন রবীন্দনাথ।

‘…রানুর জন্য আমার মনে একটা উৎকন্ঠা আছে। সেজন্যে একটি যথার্থ ভদ্রলোকের হাতে ওকে দিতে পারলে আমি খুশি হই।….যে আমার সম্বন্ধে রানুকে বোধ করি বেদনা দেবে না।’

বিয়ে হয়ে যায় রানুর। ১৯২৫ সালের ২৮ জুন স্যার রাজেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায়ের ছেলে স্যার বীরেনের সাথে। 

এই খবরে ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে পড়েন প্রায় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ।

‘আমার ভুবন তো আজ হলো কাঙাল কিছু তো নাই বাকি

ওগো নিঠুর দেখতে পেলে তা কি’।….

যামিনী রায়ের সাথে রানু

 ১৯১৭ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৪০ সাল অবধি রবীন্দ্রনাথের লেখা মোট চিঠি ২০৮টি। আর রাণুর লেখা মোট চিঠির সংখ্যা ৬৮। এই চিঠিগুলি প্রথমে ধারাবাহিক ভাবে ‘বিচিত্র’ পত্রিকায় ও পরবর্তী কালে বই হয়ে প্রকাশিত হয় ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ নামে।

রানু-ভানুর সম্পর্ক কত গভীরে পৌঁছেছিল তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় রানুর লেখা চিঠিতে।

‘আমার আপনার জন্য মন কেমন করে, আমি আপনাকে চুমু দিচ্ছি..’।

‘ভানুদা আমি এত দোষ করেছি যে আপনাকে আমি আর ভালোবাসতে পাব না?  ভানুদা আপনিই ত কতবার বলেছেন যে আমাদের সত্যিকার বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘আপনি আমাকে নাই চিঠি দিলেন কিন্তু আমি তো মনে মনে জানব যে একদিন আমি ভানুদার সমস্ত আদর পেয়েছি। আমার সমস্ত শরীর ছেয়ে সে-আদর আমার মনকে ভরে দিয়েছিল। সে ভাবনাটুকু কেড়ে নেবার সাধ্য এ পৃথিবীতে কারুর নেই, ভানুদাদা আপনারও নেই।’

‘নাই বা আপনি চিঠি দিলেন, আমি ত জানব মনে মনে যে একটা Secret আছে যা আমি আর ভানুদাদা ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কেউ জানে না। সেইটুকুতে তো কারুর অধিকার নেই।’

এসবই পাওয়া যায় রাণুর লেখা চিঠিতে।

রবীন্দ্রনাথের দেয়া আংটি

পরবর্তীতে রানু হয়ে উঠেছিল লেডি রানু মুখোপাধ্যায়। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস, কলকাতায় একটি পুর্নাঙ্গ শিল্পকলার প্রতিষ্টান গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তার নিজস্ব উদ্দ্যোগ এবং তার স্বামীর অর্থ সহায়তায়। তাদের দুটি মেয়ে এবং একটি পুত্র সন্তান ছিল। পরবর্তীতে স্বামীর সাথে তিনিও নাইট উপাধী পেয়েছিলেন।

২০০০ সালের ১৫ মার্চ ৯৪ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন রবী ঠাকুরের এই মানস সুন্দরী।


 পারভেজ সেলিম

লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী


আরো পড়ুন :

রবীন্দ্রনাথের দশ নারী উপাখ্যান (পুরো পর্ব)

আনা তড়খড়: রবীন্দ্রনাথের প্রথম নারী

লুসি স্কট: রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিদেশিনী

কাদম্বরী দেবী: রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় প্রেম

মৃণালিনী দেবী: রবীন্দ্রনাথের একমাত্র বউ

ইন্দিরা দেবী: ভাতিজির সাথে রবীর প্রেম

তোমিকো ওয়াদা কোরা: রবীন্দ্রনাথের জাপানী প্রেম

রানু মুখার্জি: রবীন্দ্রনাথ তখন ৫৭ রানু ১২

ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো: রবীর ওগো বিদেশিনী

মৈত্রেয়ী দেবী: গুরুদেবের সঙ্গে প্রেম

হেমন্তবালা দেবী: রবীন্দ্রনাথের শেষ নারী

শেষের কথা: রবীন্দ্রনাথের দশ নারী

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x