তৃতীয় ফিতনা: উমাইয়া শেষ আব্বাসীয় খিলাফত শুরু


পারভেজ সেলিম


উমাইয়া খিলাফতের শেষ দিকে মুসলমানদের মধ্যে আবারো বিভেদ আর বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। ৬৬১ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে মোট ৮৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন উমাইয়ারা। শেষে আব্বাসীয় খিলাফতের কাছে ক্ষমতা হারায় ৭৫০ সালে। 

৭৪৪-৭৫০ এই সময়কালে উমাইয়াদের সাথে অন্য মুসলমানদের বিশ্বাস ও সস্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। পরবর্তীতে তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও নৃশংসতায় রুপ নেয়। আর সেটাই ইসলামের তৃতীয় এবং শেষ ফিতনা হিসেবে পরিচিত।

অবিশ্বাস্য রকমের ধনী ও একটা স্থিতিশীল সাম্রাজ্যে পরিনত হবারও পরও কেন উমাইয়াদের বিরুদ্ধে সাধারণ মুসলমানেরাই ফুঁসে উঠেছিল? বিপ্লব করে কেন খুব সহজেই তাদের হটিয়ে দিতে পেরেছিল আব্বাসীয়রা? 

এর পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, উমাইয়ারা ইসলামকে অভিজাত আরব পরিবারের সম্পত্তি হিসাবে মনে করতে শুরু করেছিল। যা তাদের রাজ্য পরিচালনায় বারবার প্রকাশ পাচ্ছিল। ক্ষমতার শেষের দিকে এসে তার চরম আকার ধারণ করে।

৮৯ বছরে ১৪ জন উমাইয়া খলিফা মুসলমানদের শাসন করেন। এই সময় ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। অনেক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটাতে সমর্থ হয় উমাইয়া খলিফারা। তবে সংকট শুরু হয় যখন অ-আরব মানুষরা ব্যাপকহারে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে শুরু করেন।

ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী কাউকে জোর করে ধমার্ন্তরিত করা যায়।  সবাইর নিজ নিজ ধর্ম পালন করা অনুমতি দেয় ইসলাম । তাই অ-মুসলিমরা যদি তাদের নিজ ধর্ম পালণ করতে চায় তবে তাদের জিজিয়া কর দিতে হতো। 

আর মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলে তাকে যাকাত দেবার নিয়ম ছিল। 

জিজিয়ার করের চেয়ে যাকাত কম হবার ফলে অনেক জায়গায় মুসলমানে ধর্মান্তরিত হবার সংখ্যাটা দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল। 

এর ফলে দখলকৃত অমুসলিম অঞ্চলে জিজিয়া করের আয় মারাত্বক পরিমানের কমে যেতে শুরু করে। আয় কমে যাওয়ার ফলে উমাইয়া শাসকরা দু:চিন্তায় পড়ে যান ।

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য উমাইয়া শাসকরা যে সিদ্ধান্ত নেন, তা নব মুসলমানদের আরো ব্যাপকভাবে হতাশ করে।

নব মুসলিমদের জিজিয়া কর দেয়া বাধ্যতামুলক কর দেয়। মানে যারা অ-আরব নতুন মুসলমান তাদের দিতে হবে জিজিয়া কর, আর যারা পুরাতন আরব মুসলমান তাদের দেবে যাকাত।

মুসলমানদের মধ্যে শুরু হয় বৈষ্যমৈর দুই আইন। যা সরাসরি ইসলামী আইনের পরিপন্থী। উমাইয়ারদের প্রতি অ-আরব মুসলমানদের ক্ষোভ আর বিভক্তির শুরু এখান থেকেই।


 আরো পড়ুন :


তবে ৭১৭ সালে উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আজিজ ক্ষমতায় এসে এই সমস্যার ব্যাপারটি উপলব্ধি করেন এবং এই অন্যায় আইন বাতিল করেন।

ইসলামের সকল মুসলমান সমান, এই ধারণা পুন:প্রতিষ্ঠা করেন। তাই তিনি আবু বকর, উমর, উসমান ও হয়রত আলীর পরে খুলাফায়ে রাশেদিনের পঞ্চম খলিফা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিন বছরের মাথা তাকে বিষ প্রযোগে হত্যা করা হয় সুবিচারক এই উমাইয়া খলিফাকে।

এর ফলে উমাইয়া সম্রাজ্যে সকল মুসলমানের প্রতি নিরপক্ষ আচরণ নীতিরও মৃত্যু ঘটে। উমাইয়াদের প্রতি সাধারণ মানুষদের ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে।

এছাড়া অ-আরব মুসলমানদের আরব শৈলীর পোশাক পরতে দেয়া হতো না, পারস্যে জয়ে পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ফার্সি ভাষায় কথা বলা ও লিখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফার্সি ভাষা জানাদের হত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে ।

বিতর্কিত হাজ্জাজ বিন ইউসুফ পূর্ব ইরান জয়ের পর জরথুস্ট্রীয় পাদরিদের হত্যা করেছিলেন, তাদের সাহিত্য পুড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। 

এরপর ৭৪১ সালে উমাইয়ারা আদেশ জারি করে অমুসলিমরা সরকারি পদে কাজ করতে পারবেনা। এর ফলে নবমুসলিমদের পাশাপাশি অমুসলিমরাও উমাইয়াদের শাসকদের উপর হতে থাকে।

আর সুযোগটি গ্রহণ করে আব্বাসীয় বিপ্লবীরা। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক সুসংগঠিত বিপ্লব সফল করতে শুরু করে মুসলমানেরা।

কারা হবেন এই খেলাফতের প্রধান ব্যক্তি? ইসলামের  উত্তরাধিকার প্রশ্নে সাধারণ মুসলমানরা ছিলেন সন্দিহান । এমন প্রশ্নের সমাধান করেন কয়েকজন আব্বাসীয় নেতা। তারা নিজেদের মহানবী চাচা আব্বাস ইবনে আবু মোত্তালিরের চতুর্থ বংশধর দাবি করেন।

আর তাতেই সাধারন মুসলমানেরা আকৃষ্ট হয়। মহানবীর বংশের হওয়ায় উমাইয়াদের বিরুদ্ধে তারাই যোগ্য দাবিদার বলে মনে করতে থাকে। উত্তরাধিকরা নিয়ে মুসলমানদের মনে আর কোন সন্দেহ থাকে না।


 আরো পড়ুন :


উমাইয়া খেলাফতের খলিফা দ্বিতীয় উমরের সময় (৭১৭ খ্রি) পারস্যে বিপ্লবের গোপন প্রচারণা শুরু করেন আব্বাসীয়রা । অ-আরব মুসলমানেরা আব্বাসীয়দের পক্ষে সবচেয়ে সমর্থণ প্রদান করেন।

দ্বিতীয় মারওয়ানের (৭৪৪) শাসনকালের শুরুর দিকে আব্বাসীয়দের চতুর্থ বংশধর ইব্রাহিম প্রকাশ্যে বিরোধিতা শুরু করেন।

খোরাসান প্রদেশে শিয়া আরবদের কাছ থেকে সমর্থন লাভের ফলে বেশ সহজে সাধারণ মানুষদের মন জয় করতে শুরু আব্বাসীয়রা।

৭৪৭ সালে দেশদ্রোহের অপরাধে ইব্রাহিমকে গ্রেফতার করা হয় এবং কারাগারে তার মৃত্যু হয়। কারো কারো মতে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।

এরপর তার ভাই আবদুল্লাহ প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ আগিয়ে নেন।বিদ্রোহের সময় এবং পরবর্তীতে তার  নৃশংসতার জন্য তিনি আস সাফাহ বা রক্তপিপাসু নামে পরিচিত হতে থাকেন ।

৭৫০ সালে মুসলমান মুসলমান শুরু হয় যুদ্ধ। উমাইয়াদের সাথে আব্বাসীয়দের যুদ্ধ। ইতিহাসে যা ‘জাবের যুদ্ধে’ নামে পরিচিত।

এই যুদ্ধে উমাইয়ারা পরাজিত হয় । শেষ হয় ৮৯ বছরের শাসন। এরপর নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন আবুল আব্বাস আস সাফাহ। ৫ আগস্ট মিশরের বুসিরের গির্জার বাইরে দ্বিতীয় মারওয়ানকে মেরে ফেলা হয়।

আব্বাসীয়রা যখন উমাইয়া পরিবারের সদস্যদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন তখন ৮০ জন ক্ষমা পাওয়ার জন্য জাফায় জড়ো হয়। কিন্তু সবাইকে গণহত্যা করে আব্বাসীয়রা। মুসলমান ভাই এর হাতে অন্য মুসলমানভাই হত্যার শিকার হয়।

আব্বাসীয়দের প্রথম খলিফা আবুল আব্বাস আস সাফাহর মৃত্যুর পর ৭৫৪ খ্রি. দ্বিতীয় খলিফা হন আবু জাফর আল মনুসর।

 এরপর আব্বাসীয়দের নিজের মধ্যে দ্বন্দ শুরু হয়। আল মনসুরের চাচা আব্দুল্লাহ সিরিয়ার বিদ্রোহ করে বসে । তাকে দমন করার জন্য অসাধারণ সামরিক সংগঠক আবু মুসলিমকে প্রেরণ করে ।

আবু মুসলিম ও আব্দুল্লাহর মধ্যে যে যুদ্ধটি হয় ইতিহাসে তা নাসিবিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত । সেই যুদ্ধে আবু মুসলিমের নৈপুন্যে কারন আবদুল্লাহ পরাজিত হয় । আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুরের আর কোন প্রতিদ্বন্দী থাকে না ।

নাসিবিনের যুদ্ধ জয়ের পর আবু মুসলিমের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর বিধর্মী ও দেশদ্রোহের অভিযোগ এনেছিল। আবু মুসলিমকে ৭৫৫ সালে প্রসাদে মৃতুদন্ড দেয়া হয়েছিল। 

অনেকে মনে করেন ভবিষ্যতে খিলাফতের প্রতি হুমকি স্বরূপ মনে করে আল মনসুর গুপ্তঘাতক দ্বার হত্যা করেন আবু মুসলিমকে ।

তৃতীয় ফিতনা ফলে আব্বাসীয়দের বিজয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতে রয়েছে। কেউ কেউ এটিকে আরবদের বিরুদ্ধে অআরবদের বিদ্রোহ মনে করে। কারো কারো মতে এটি পারস্যের বিজয় আরবদের পরাজয়।

এই বিপ্লবের ফলে অআরব নব মুসলমানেরা তাদের ভোটাধিকার ফিরে পায়।

৭৫০-১২৫৮ পর্যন্ত ৫০৮ বছরের বেশি সময় ধরে চলে ৩৭ জন  আব্বাসীয় খলিফার শাসন ।

১২৫৮সালে মঙ্গোলের কুখ্যাত হালাকু খানের হাতে বাগদাদ দখলের আগ পর্যন্ত বজায় ছিল আব্বাসীয়দের শাসন।

ইসলাম যদিও শান্তির ধর্ম নামে পরিচিত  তবু নিজেদের মধ্য দ্বন্দ, ফ্যাসাদ আর নৃশংসতা ইসলামের আকাশের এই কলঙ্কজনক অধ্যায় ।


পারভেজ সেলিম

লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী


ভিডিও সৌজন্য : Banglabox

২৪ thoughts on “তৃতীয় ফিতনা: উমাইয়া শেষ আব্বাসীয় খিলাফত শুরু

  1. Howdy! I realize this is sort of off-topic however I had to ask.

    Does managing a well-established website such
    as yours take a large amount of work? I am brand new to blogging but I do write in my diary everyday.
    I’d like to start a blog so I can share my own experience and views online.
    Please let me know if you have any kind of ideas or tips for new aspiring bloggers.
    Thankyou!

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x