দ্বিতীয় ফিতনা: ইয়াজিদ, কারবালা ও উমাইয়ার সময়কাল


পারভেজ সেলিম ।


ফিতনা শব্দটি আরবী। এর ভিন্ন ভিন্ন অর্থ আছে। বিপর্যয়, নৈরাজ্য, অন্তর্ঘাত, অরাজকতা ইত্যাদি।

ইসলামে মুসলমান মুসলমান মতবিরোধের জেরে যে দ্বন্দ, ফ্যাসাদ বা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেটাই ফিতনা নামে পরিচিতি।

ইসলামের ইতিহাসে তিনটি ফিতনা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।  

৬৫৬-৬৬১ খ্রি. এই পাঁচ বছর ব্যাপি চলে প্রথম ফিতনা, ৬৮০-৬৯২ এই বারো বছর চলে দ্বিতীয় ফিতনা আর তৃতীয় ফিতনা চলে  ৭৪৪-৭৫০ সাল পর্যন্ত ছয় বছর।

এরপর মুসলমান মুসলমান আরো  অনেক কয়েকটি যুদ্ধ হয়, তবে তা ফিতনা নাকি শুধুই ক্ষমতার দ্বন্দ তা নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে ।

দ্বিতীয় ফিতনার শুরু এবং শেষ  উমাইয়া খিলাফতের আমলেই।

উমাইয়া খিলাফতের সুফিয়ানিদ বংশের খলিফা  ইয়াজিদের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই ফিতনা। সময়টা ৬৮০ সালের অক্টোবর মাস। কারবালা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় ফিতনার চূড়ান্ত রুপ।

আর ৬৯২ সালে উমাইয়া খিলাফতের মারওয়ানিদ বংশের শাসক আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। এক যুগ ধরে চলা ফিতনায় নিহত হয় প্রায় ৭০ হাজার মুসলমান। 

শুরুটা কয়েক বছর আগে।

৬৬১ সালে মুয়াবিয়া ক্ষমতা গ্রহণের পর ক্ষমতায় থাকেন ১৯ বছর। প্রথম ফিতনা শেষ হবার পর এই সময়কালে শান্ত থাকে মুসলিম উম্মাহ।

তবে মৃত্যুর আগে শর্তভঙ্গ করে পুত্র ইয়াজিদকে যখন খেলাফতের উত্তরাধিকার নির্বাচিত করে যান মুয়াবিয়া, সংকটের শুরু হয় তখনই।

অন্যায়ভাবে ইসলামে এমন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদ করেন মহানবীর প্রিয় নাতি ইমাম হোসাইন (রা.) সহ বিশিষ্ট সাহাবীরা। তারপরও ৬৮০ সালের অক্টোবরে জোর করে ক্ষমতায় বসেন ইয়াজিদ।

সাহাবাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত রুপ নেয় যুদ্ধে।

৬৮৩ সালে ১০ অক্টোবর কারবালার প্রান্তরে সংগঠিত হয় ইসলামের সবচেয়ে বেদনার ইতিহাস ‘কারবালার যুদ্ধ’।

ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে শহীদ হন ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার ৭২ জন সঙ্গী।

এই নির্মম হত্যাকান্ডের পর আবারো দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়েন মুসলমানেরা। বিদ্রোহ দেখা দেয় মক্কা, মদিনা আর কুফায়। 

ইয়াজিদ ও তার সৈন্যরা প্রতিবাদি মুসলমানদের দমন করতে  প্রথমে মদিনায় আক্রমণ চালায়, পরে অবোরোধ করে মক্কা। সেসময় ইয়াজিদের সৈন্যদের গোলার আঘাতে আগুন ধরে যায় কাবা ঘরে। ইসলামের এমন এক কলংকজনক অধ্যায়ের শুরু হয় মুসলামানদের হাতেই।

মক্কা তখন আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।

কাবা ঘরে যখন আগুন জ্বলছে তখনই হঠাৎ খবর আসে বিরল এক রোগে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেছেন ইয়াজিদ। সময়টা ৬৮৩ সালের ১২ নভেম্বর।

চারিদিকে এক প্রশান্তির আবহাওয়া বিরাজ করতে শুরু করে।

ইয়াজিদের মৃত্যুর পর ইসলামে শান্তি ফিরে আসবে বলে অনেকে মনে করতে শুরু করেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটতে থাকে উল্টো ঘটণা। ইয়াজিদের মৃত্যুর পর দ্বন্দ ফ্যাসাদ আরো বেড়ে যায়।

বিতর্কিত ইয়াজিদের মৃত্যুর পর মক্কা, মদিনা, কুফা আবদুল্লাহ ইবনে জুয়ায়েরার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়।

অন্যদিকে দামেস্কে ইয়াজিদের পুত্র মুয়াবিয়াকে ক্ষমতায় বসানো হয়। ছয় মাসের মাথায় তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিলে ক্ষমতায় বসে মারওয়ান ইবনে হাকাম। যিনি প্রথম মুয়াবিয়ার চাচাতো ভাই এবং দীর্ঘদিনের সহযোগী। দামেস্কে শুরু হয় উমাইয়া খিলাফতের মারওয়ানিদ বংশের শাসন।

অপরদিকে কিছুদিনের মধ্যে ৬৮৫ সালের অক্টোবরে কুফায় এক বিদ্রোহে ক্ষমতায় বসেন মুখতার আল সাকাফি। কারবালা হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি কুফায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।

ইসলাম তখন তিনটি শহর থেকে তিনজনের নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে।

ধীরে ধীরে ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে।

মক্কা-মদিনায় আবদুল্লাহ জুবায়ের, কুফায় মুখতার আল সাকাফি আর দামেস্কে মারওয়ান ইবনে হাকামের নেতৃত্বে সংগঠিত। এই হচ্ছে সেসময়ে বিভক্ত মুসলমানদের সামগ্রিক চিত্র।



৬৮৭ সালে কুফা ক্ষমতা দখল করে নেয় আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের। শহীদ হন কারবালার হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ গ্রহণকারী মুখতার আল সাকাফি ও তার ১৯ জন সঙ্গীকে।হত্যা করা হয় আত্নসমর্পনকারী মুখতারের ৬ হাজার অনুসারিকে। ইসলামে এ এক নির্মম নৃশংসতার ইতিহাস।

অন্যদিকে দামেস্কেও ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। মারওয়ান মাত্র এক বছরের ক্ষমতায় থাকার পর মৃত্যু বরণ করেন, ক্ষমতায় বসেন তার পুত্র আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান। সময়টা ৬৮৫ । এরপর উমাইয়া বংশের পঞ্চম এই শাসকের হাতে কঠোরভাবে শাসিত হতে থাকে মুসলমানেরা।

৬৯২ সালের নভেম্বরে মক্কা অবরোধ করেন আব্দুল মালিক এবং শেষে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরকে নির্মমভাবে হত্যা করে পুরো মুসলিম উম্মাহ ক্ষমতার অধিকারি হয় উমাইয়ারা। 

এই হত্যাকান্ডের নেতৃত্ব দেন উমাইয়াদের কুখ্যাত সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। গোটা মুসলিম বিশ্ব শুরু হয় উমাইয়া খিলাফতের শাসন।  

৭৫০ সালে আব্বাসীয় খিলাফতের হাতে ক্ষমতা হারোনোর আগ পর্যন্ত চলে উমাইয়া বংশের শাসন।

৬৮০ সালে ইয়াজিদের ক্ষমতা গ্রহণের পর  মুসলমানদের মধ্যে যে ফিতনা শুরু হয়েছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটে ৬৯২ সালে এসে। এক যুগ ধরে চলা ফিতনায় নিহত হয় প্রায় ৭০ হাজার মুসলমান। 

এক ভাই এর রক্তে রঞ্জিত হয় অন্যভাইয়ের হাত। এক মুসলমান হত্যা করে অন্য মুসলমানকে। ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের এ যেন এক নির্মম নিয়তি।

ইহুদী,খৃষ্টান কিংবা অন্য ধর্মের সাথে যুদ্ধে যত মুসলমান শহীদ হয়েছেন তার চেয়ে বেশি মুসলমান শহীদ হয়েছে নিজেদের মধ্য যুদ্ধের ফলে। মুসলমানদের গৃহযুদ্ধ তাই  ইসলামের এক কালো অধ্যায় এবং নির্মম বাস্তবতার অন্ধকার ইতিহাস ।

পারভেজ সেলিম

লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী


ভিডিও সৌজন্য : Banglabox

৫২ thoughts on “দ্বিতীয় ফিতনা: ইয়াজিদ, কারবালা ও উমাইয়ার সময়কাল

  1. Definitely believe that that you stated. Your favourite justification seemed to be on the net the simplest factor to take into account of. I say to you, I certainly get irked while other folks consider worries that they just don’t realize about. You controlled to hit the nail upon the top and defined out the entire thing without having side-effects , people could take a signal. Will likely be again to get more. Thank you

  2. Эта статья оказалась исключительно информативной и понятной. Автор представил сложные концепции и теории в простой и доступной форме. Я нашел ее очень полезной и вдохновляющей!

  3. Have you ever thought about adding a little bit more than just your articles? I mean, what you say is fundamental and everything. But think of if you added some great images or video clips to give your posts more, “pop”! Your content is excellent but with pics and clips, this site could definitely be one of the most beneficial in its field. Good blog!

  4. Unquestionably believe that which you said. Your favorite justification seemed to be on the internet the easiest thing to be aware of. I say to you, I certainly get irked while people consider worries that they plainly don’t know about. You managed to hit the nail upon the top and also defined out the whole thing without having side effect , people can take a signal. Will probably be back to get more. Thanks

  5. With havin so much written content do you ever run into any issues of plagorism or copyright violation? My blog has a lot of unique content I’ve either authored myself or outsourced but it looks like a lot of it is popping it up all over the internet without my agreement. Do you know any solutions to help prevent content from being ripped off? I’d certainly appreciate it.

  6. Автор приводит примеры из различных источников, что позволяет получить более полное представление о теме. Статья является нейтральным и информативным ресурсом для тех, кто интересуется данной проблематикой.

  7. Я только что прочитал эту статью, и мне действительно понравилось, как она написана. Автор использовал простой и понятный язык, несмотря на тему, и представил информацию с большой ясностью. Очень вдохновляюще!

  8. Эта статья – источник ценной информации! Я оцениваю глубину исследования и разнообразие рассматриваемых аспектов. Она действительно расширила мои знания и помогла мне лучше понять тему. Большое спасибо автору за такую качественную работу!

  9. Я только что прочитал эту статью, и мне действительно понравилось, как она написана. Автор использовал простой и понятный язык, несмотря на тему, и представил информацию с большой ясностью. Очень вдохновляюще!

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x