পারভেজ সেলিম ।
বাংলা ভাষা গড়ে উঠেছে অনেক মহান সাহিত্যিকদের চেষ্টা, শ্রম আর মেধায়। চর্যাপদকে যদি সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শণ ধরি তাহলে বাংলা ভাষার বয়স মাত্র এক হাজার বছর। এই এক হাজার বছরের রুপান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা আজকের এই অবস্থানে এসেছে।
আমাদের ভাষার সবচেয়ে বড় বাঁকটি হয়েছে সাহিত্যের আধুনিক যুগে এসে। এ যুগে যে কয়েকজন সাহিত্যিকের হাত ধরে বাংলা ভাষা সুউচ্চ আসনে উঠল তাদের মধ্যে প্রধানতম ব্যক্তিটি হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বাংলা সাহিত্যের শুধু এক অন্যন্য সৃষ্টি প্রথম মহাকাব্যই নয়, বাংলায় যে জাগরণের কথা বলা হয়, সাহিত্যে তা এই ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ দিয়েই তার যাত্রা শুরু।
এর স্রষ্টা মধুসূদন যদি আর কোন গ্রন্থ রচনা নাও করতেন তবু শুধু এই একটি মহাকাব্যের জন্য বাঙ্গালীর মানসে তিনি উজ্জ্বল হয়ে থাকতেন। এছাড়াও মাইকেল মধুসূদন দত্তের সৃষ্টি আরো ব্যাপক, মৌলিক এবং প্রথম।
মধুসুদনের পরিচয় :
সাহিত্যিক মুধুসূদন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে যে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা এখন সর্বজন স্বীকৃত। তবে এর চাইতেও হয়ত বেশি আকর্ষনীয় তার বৈচিত্রময় জীবন।
ব্যক্তিজীবনে মধুসূদন যেন মহাকাব্যের এক ট্রাজিক নায়ক, যার আকর্ষণে গত দেড়শ বছর ধরে বিমোহিত হয়ে আছে সারা বিশ্বের বাঙ্গালীর মন।
বঙ্কিমচন্দ্রের মতে,‘বাঙ্গালীর মধ্যে মনুষ্য জন্মিয়াছে কে? আমরা বলিব ধর্ম্মোপদেশকের মধ্যে শ্রী চৈতন্যদেব, দার্শনিকের মধ্যে রঘুনাথ, কবির মধ্যে শ্রী জয়দেব ও শ্রী মধুসূদন’।
সায়ম বন্দোপাধ্যায় বলছেন ‘মধুসূদন একসেন্ট্রিক জিনিয়াস। উদভ্রান্ত কবি। ক্ষোভে, অভিমানে আত্নবিনাশে উদ্যত। ধুমকেতুর মতো আর্বিভাব তার। তিনিই বাংলা কবিতার প্রথম আন্তর্জাতিক পুরুষ’।
আর গবেষক গোলম মুরশিদ এর মতে ‘মধুসূদন রেনেসাঁসের শিল্পী’।
জন্মেছেন বর্তমান বাংলাদেশের যশোরের সাগরদাঁড়িতে। জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখ, সালটি ১৮২৪।
মনে প্রাণে হতে চেয়েছিলেন ইংরেজি বড় সাহিত্যিক। গোড়া হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া মধু খ্রিষ্টান হয়েছিলেন সাহিত্যিক হবার আশায়। মধুসূদন হয়েছিল মাইকেল মধুসূদন।
কিন্তু তার নাম যশ খ্যাতি কিছুই আসেনি ইংরেজি সাহিত্য সাধনা থেকে। তিনি ধুমকেতুর মতো এসে খুব অবলিলায় একের পর এক সোনা ফলিয়েছেন বাংলা ভাষায়।
কি বিচিত্র মধুর জীবন :
মধুসূদনের লেখার চাইতেও কি ব্যক্তিজীবন বেশি আকর্ষনীয়ও ? নাকি দুটোই । সাহিত্যে তার অবদান খোদাই করা হয়ে গেছে। তার এমন কিছু লেখা আছে যারা সাহিত্যের বিচারে খুবই উন্নত। তার দুএকটি লেখায় হয়ত তার মেধার অপচয় হয়েছে যেমন মায়াকানন, যেহেতু লেখাটি তিনি শেষ করে জাননি ধরে নেয়া যায় অন্যেরা সেটা শেষ করেছেন ।
গবেষক গোলাম মুর্শিদের মতে তিনি বাংলার প্রথম রেনেসাঁস ম্যান,বাংলার জাগরনের প্রথম মানব। তার কারণ যথার্থ। মধুসূধনের আগে আর কেউই ধর্মের প্রচলিত মিথকে ভিন্নচোখে ব্যাখা করেননি।
জন্ম ও ছোটবেলা কেটেছে যশোরের সাগরদাড়িতে। কলকাতার বড় উকিল পিতা রাজনারায়ন দত্ত। একমাত্র পু্ত্রকে ছেলেবেলায় শিক্ষায় কমতি রাখেননি পিতা মাতা।
মা জাহ্ননী দেবীর হাতেই রামায়ন মহাভারত পুরাণ মগজে ঠুকে গেল। পাড়ার মৌলভীর কাছে শিখলের ফার্সি। আরো পরে ইংরেজি সহ ৬/৭ টি ভাষা। নতুন ভাষা শেখায় যেন মধুসসূদন বুদ হয়ে থাকতেন।
কলকাতার প্রথম জীবন :
ছোটবেলা কাটল বাংলাদেশের কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে। বাবা কলকাতায় বড় বাড়ি কিনলেন ছেলেকে লেখাপড়া করাবেন বলে। ১৩ বছরে বয়সে কলকাতায় আসল মুধু। ভর্তি হলেন হিন্দু কলেছে ( বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় )।
কি তার মনের ইচ্ছা ? মধু কবি হতে চায়। মহাকবি হওয়াই তার মনের একান্ত বাসনা। মিল্টন, দান্তে, শেলি, বায়রন কিংবা হোমার তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা চলতে থাকে তার। ইংরেজি কবিতা লিখে বন্ধুদের মাঝে তখন তুমুল জনপ্রিয় আর আকর্ষনীর চরিত্র হয়ে ওঠে মধু।
হঠাৎ এক বিশাল কান্ড করে বসে মধুসূদন। হিন্দু থেকে খ্রিষ্টান হয়ে যান। সাল ১৮৪২ মধুর বয়স তখন সবেমাত্র ১৮। একেবারে পাদ্রীর কাছে ধর্মান্তরণের মন্ত্র পাঠ করে হিন্দু মধুসুদন দত্ত হয়ে যান খ্রিষ্টান মাইকেল মধুসূধন দত্ত।
মুধু কি সত্যি খ্রিষ্টান ধর্মকে এতটা ভালোবেসেছিল ? পরবর্তী পুরো জীবন ঘেটেও তার কোন প্রমাণ উদ্ধার করা যায় না। সেই সময় এই ধর্মান্তরনের ঘটনা বিশাল এক আলোচনা ব্যাপার হয় দাঁড়িয়েছিল। কেন তিনি এমনটি করেছিলেন?
বন্ধুদের সব সময় চমকে দেওয়া মধু এতটাই চমকিয়ে দিয়েছিল যে তাকে ভয় পেতে শুরু করেছিল বন্ধুরা। হিন্দুদের গোড়ামী কি তাকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল ? গ্রাম্য এক বালিকার সাথে তাকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল তার বাবা সেখান থেকে পরিত্রানের জন্যই কি এই ব্যবস্থা ? সঠিক কারনটি একমাত্র মুধুই বলতে পারবেন।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে যেমন আর কোন ধর্ম গ্রহণ বা বর্জণ করেনি তেমনি কখনোই খ্রিষ্টন ধর্ম পালনও করেননি তিনি। পিতা রাজনারায়ন ত্যাজ্য পুত্র করেছিল শেষ পর্যন্ত এই ধর্মত্যাগের জন্য।
খ্রিষ্টান হওযায় আর হিন্দু কলেজে পড়া হলো না তার। বের হয়ে ভর্তি হলেন বিশপ্স কলেজে। পৃথিবীর তাবৎ মহৎ সাহিত্যের সাথে পরিচিত হতে থাকলেন এই কলেজে। কিন্তু ইংরেজদের অহংকার আর বৈষম্য তাকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। কলেজে হিন্দু পোষাক পরতে না দেয়ায় গন্ডগোল বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন মধুসূদন।
মাদ্রাজ গমন:
এরপর একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ মাদ্রাজ চলে যায় মধু। সাল ১৮৪৪, বয়স তখন ২০ বছর। সেখানে এক আনাথ ইংরেজ মেয়ে রেবেকাকে বিয়ে করেন। ৮ বছর সংসার ছিল তাদের। চারটি সন্তান দুই ছেলে দুই মেয়ে।
এখানেই বসে ‘ক্যাপটিভ লেডি’(১৮৪৯) নামের একটি ইংরেজি কাব্য লেখেন মধুসুদন। এই কাব্য প্রকাশের পর বন্ধু গৌর বসাক বেথুনসাহেবকে এক কপি দিয়েছিলেন। সেই লেখা পড়ে মুগ্ধ বেথুন মধুকে অনুরোধ করে চিঠি লিখেছিলেন যেন বাংলায় লেখালেখি শুরু করে মধু। এত বড় প্রতিভা বাংলা ভাষার জন্য খুবই প্রযোজন। মাদ্রাজে থাকতেই মারা যান মা এবং পরে বাবাও।
মধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ ছয় বছর:
কলকাতায় ফিরে আসেন স্ত্রী সন্তানকে মাদ্রাজে রেখে। ততদিন অর্থকষ্ট শুরু হয়ে গেছে মুধুর । পিতার সম্পত্তি অন্যেরা ভোগদখল করে খাচ্ছে আর নিজে আছেন অর্থকষ্টে । অর্থসংস্থানের আশায় ফিরে আসেন কলকাতায় ১৮৫৬ সালে। এই ফিরে আসাই হলো বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল বড় ঘটনা।
এর পরবর্তী ৬ বছরে বাংলা সাহিত্যে মাইকেল এক অবিসংবাদিত সূর্য়ের ন্যায় আবির্ভূত হবেন। একের পর সোনা ফলাবেন বাংলা সাহিত্যে। রইরই পড়ে যাবে চারিদেকে।
তিলত্তোমাসম্ভব কাব্য, শর্মিষ্ঠা, মেঘনাদবধ কাব্য সহ তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো এই কয়েক বছরে লিখে ফেললেন। ছয়টির মধ্যে পাঁচটি নাটকই তার এই সময়টুকুতে লেখা।
বাংলার শ্রেষ্ট কবি হিসেব আবির্ভূত হলেন মধুসূদন। জীবনদশায় এমন নাম আর খ্যাতি খুব বেশি কবির ভাগ্য জোটেনি বাংলায়।
হাহাকার নিয়ে ইউরোপ যাত্রা:
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্টত্ব অর্জন করেও যেন মন ভরেনি মধুসুদনের। কি এক না পাওয়া তাকে অতৃপ্ত করে রেখেছে। খ্যাতি হলেও মুধুর অর্থকষ্টের সমাধান হয়নি তখনও। কাব্য চর্চাও যেন মনকে আর শান্তি দিতে পারছেনা কবিকে !!
এবার মধুর যাত্রা ইউরোপের দিকে নতুন কিছু আশায়। এর আগে মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় আসার কিছুদিনের মধ্যে হেনরিয়েটনা নামের এক ফরাসী মেয়ের সাথে থাকতে শুরু করেছে মধু। হেনরিয়েটা আর সন্তানদের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করে রেখে এবং নিজের জন্য টাকা পাঠানের বন্দোবন্ত করে ইংল্যান্ড চলে যান মধু ব্যারিষ্টারি পড়তে।
ইংল্যান্ডে থাকতেই স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে আসেন নিজের কাছে কিন্তু কলকাতা থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে গেলে মহাসংকটে পড়ে মধু। ভালো চাকরি জোগাড়ের চেষ্টাও ব্যর্থ হন তখন ।
ইংল্যান্ড থেকে এরপর প্যারিসের ভার্সাই নগরীতে চলে যান স্বপরিবারে। এখানে বসেই তার প্রিয় মাতৃভূমির জন্য কেঁদে ওঠে তার মন। এখানে বসেই তার বিখ্যাত চতুদর্শপদী বা সনেটগুলো লিখতে থাকেন ‘এ ভিখারি দশা কেনরে তোর আজি ? যা ফিরি অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে’।
অর্থকষ্ট ও ঈশ্বরচন্দ্রের মানবিকতা:
এসময় অর্থের সংকট এত প্রবল হয় যে দেনার দায়ে জেল যাবার জোগাড় হয়। আত্নহত্যার শংকার কথা জানিয়ে চিঠি লেখে বিদ্যাসাগরকে। ত্রাণকর্তার মত হাজির হন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ততক্ষনাৎ দেড় হাজার টাকা পাঠিয়ে উদ্ধার করেন। এরপর ধারদেনা করে আরো টাকা পাঠানোয় ঈশ্বরচন্দ্রের মহানুভবতায় ব্যারিস্টারি শেষ করে কলকাতায় ফিরতে পারেন মধুসূদন।
শেষ জীবন কলকাতায় :
এরপর আর খুব বেশি লেখা হয়নি মধুসূদনের। ব্যারিস্টারি শুরু করা নিয়ে আদালতে নানা ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে। হোটেল ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করতে হয় অর্থাভাবে। দুহাতে আয় করে আবার দুহাতে খরচ করে উড়ানোই যেন তার নিয়তি তখন। অমিতব্যয়িতা ছিল মধুর আজন্ম নিয়তি। এর কারনে পুরো জীবন ভুগতে হয়েছে তাকে।
বাবার বাড়ি বিক্রি করে অন্যের কাছ থেকে নেয়া ঈশ্বরচন্দ্রের দেনা শোধ করা, মদ আর ধূমপান বাড়িয়ে নিজেকে নি:শব্দে শেষ করে দেয়া, এ সবই যেন নিয়তির এক অমোঘ নিয়মে ঘটে চলেছে মধুর জীবনে।
এক অতৃপ্ত জীবন নিয়ে জন্মেছিল মধু। যা চাই তা না পাওয়ার এক হাহাকার নিয়ে জীবনের তীরে পৌঁছে গেলেন বাংলার মহান কবি মধুসূদন দত্ত।
এপিটাফে পরিচয় নিশ্চিত করলেন মহাকবি ‘দাঁড়াও পথিক বর জন্ম যদি তব বঙ্গে… শ্রী মদুসূধনে।
মুধুসূদনের ভান্ডারে তব কত বিবিধ রতন!
মধুসূদন দত্তের লেখক জীবন শুরু ইংরেজি সাহিত্য দিয়েই। ইংরেজিতে কবিতা লিখেই কিছুটা নাম কামিয়ে ফেলেছিলেন তরুণ বয়সেই।
প্রথম কাব্যগ্রন্হ ‘ক্যাপটিভ লেডি’ (১৮৪৯) যখন প্রকাশ পায় ইংরেজিতে ,তখন তার বয়স মাত্র ২৫। তিনি তখন ঘরসংসার করছেন মাদ্রাজের এক অনাথ ইংরেজ নারীর সাথে।
এই কাব্যটি মাদ্রাজে কিছুটা সমাদর পেলেও কলকাতায় তেমন কোন আলোচনায় আসতে পারেনি। হতাশ হয়েছিলেন মধু। তবে এই বইটি প্রকাশের ফলে বাংলা সাহিত্যের বড় উপকার হলো।
কাব্যটি ব্যর্থ হবার ফলে মধুর যে মনভঙ্গের বেদনা তৈরি হয়, তা বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার দিকে মধুকে ঠেলে দেবার সূচনাও বলা যেতে পারে। বন্ধু গৌর বসাকের হাত ঘুরে বইটি ভারত প্রেমি ব্রিটিশ বেথুন সাহেবের হাতে পড়লে বিমোহিত হন তিনি। এর কাব্যগুণ বিচার করে মধুকে চিঠি লিখে বাংলায় সাহিত্যচর্চা শুরুর পরামর্শ দেন। যদি এই কাব্যটি খুব সফল হতো তাহলে বাংলার মধুসূদনকে হয়ত আমরা পেতামই না।
প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের পরের দশ বছর আর কোন গ্রন্থ প্রকাশ পায়নি মধুর। ধর্ম পরিবর্তনের ফলে পিতার সাথে সম্পর্ক চরমে ত্যাজ্য পুত্র তখন তিনি। অর্থ সংকট শুরু হয়েছে সংসারে ।
কবি মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন ১৮৫৬ সালে। কলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে নাটক দেখতে গিয়ে এর দৈন্যতা আর অর্থের অপচয় দেখে জেদের বসে নিজেই বাংলা নাটক লেখা শুরু করেন। রচিত হয় বাংলার প্রথম মৌলিক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯) । এটি শুধু একটি নাটক নয় এটি বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেবার শুভসূচনা মাত্র ।
বিশাল প্রতিভাধর কবি বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন এই নাটকটি দিয়ে। এরপর নেশার মত নাটক লিখতে থাকেন বাংলায়। মাত্র ৩ বছরে লেখেন ৫ টি নাটক।
‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ (১৮৬০), ‘আর একেই বলে সভ্যতা’ (১৮৬০) লিখে রোশানলে পড়েন নব্য শিক্ষিত একদল হিন্দু আর ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা গোড়া পন্ডিতদের। নাটক দুটি মঞ্চস্থই হতে পারেনা কলকাতায়। অভিমানে নাটক লেখা ছেড়ে দেন তিনি।
মৃত্যুর আগে ‘মায়াকানন’ (১৮৭৩) নামে আর একটি মাত্র নাটক লিখায় হাত দিয়েছিলেন যা শেষ করে যেতে পারেননি।
এরপর কবি হাত দেন তার শ্রেষ্ট শিল্পকর্ম সৃষ্টির দিকে। এবার শুরু করেন বাংলায় কাব্য চর্চা। অমৃত্রাক্ষর ছন্দ প্রথম শুরু হয় তার হাতে।
যদিও এই ছন্দ প্রথম ব্যবহার করেন নাটক ‘পদ্মাবতীতে’ (১৮৫৯)। কাব্যে প্রথম এই ছন্দ ব্যবহার করেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে’(১৮৬০) এবং এরপর রচনা করেন তার সর্বশ্রেষ্ট সাহিত্যকর্ম ‘মেঘনাদবধ কাব্য’(১৮৬১)।
এই সাহিত্যকর্ম একটা বিদ্রোহ। বাংলা ভাষা এতদিন আটকে ছিল অন্তমিলের এক আজন্ম শৃঙ্খলে, যেন এই ভাষার একমাত্র নিয়তি মিত্রাক্ষর ছন্দ। তিনি এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেললেন সেই শৃঙ্খল। ভাষা পেল নতুন এক আলোর দিশা, মুক্ত হলো বাংলা ভাষা।
মধুসূদনই বাংলা ভাষার প্রথম বিদ্রোহী কবি এবং মুক্তিদাতা। বাংলা ভাষার প্রথম এবং একমাত্র মহাকাব্যটি মধুসূদনের লেখা। শুধু এই একটি মাত্র গ্রন্থ দিয়েই তিনি অমর হয়ে থাকতে পারতেন।
এই কাব্যে তিনি যে শুধু ভাষায় নতুনত্ব আনলেন তা নয় কাহিনীর ক্ষেত্রে তিনি বিশাল এক বিদ্রোহ করে বসলেন।
গল্প ধার করলেন রামায়ন থেকে। হাজার হাজার বছর ধরে যাকে মানুষ নায়ক হিসেবে জেনে এসেছে সেই রামকে তিনি বানিয়ে দিলেন দেশ দখলদার খলনায়কে আর এতদিনের রাক্ষস রাবনকে বানিয়ে দিলেন পুত্রশোকে কাতর এক মহানায়কে।
রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এত বড় বিপ্লবকে প্রথমদিকে মেনে নিতে পারেননি। যদিও পরে তিনি মেনে নিয়েছিলেন মধুসূদনের এই অসাধারণ সৃষ্টির বৈচিত্রতাকে।
পুরাণকে নতুনভাবে ব্যাখ্যার জন্য ইউরোপে রেনেসাঁস শব্দটি তখন জনপ্রিয়। মধুসূদন এই রেনেসাঁস শব্দ শোনার আগেই সৃষ্টি করছেন রেনেসাঁসের শিল্প।
গবেষক গোলাম মুরশিদের মতে মধুসূদন তাই প্রথম রেনেসাঁস শিল্পী ।
লেখক মধুসূদনের মৌলিকত্ব এখানেই যে তিনি যখনই যা লিখেছেন তাতেই নতুনকিছু সৃষ্টি করেছেন।৷ বাংলা ভাষায় যা একেবারে প্রথম। যদিও বেশিরভাগ কাঠামোই তিনি ইউরোপিয় শিল্প,সাহিত্য থেকে গ্রহণ করেছেন।
পত্রকাব্যে নারীদের নতুন করে চেনালেন মধুসূদন। চরিত্র খুঁজে আনলেন সেই মহাভারত আর পুরাণ থেকে। তিনি ‘ব্রজঙ্গনা কাব্যে’ (১৮৬১) লিখলেন রাধার বিরহের কথা আর ‘বীরাঙ্গানা কাব্যে’ (১৯৬২) লিখলেন প্রেমিক কিংবা স্বামীকে লেখা ১১ পুরাণ নারীর দু:খ-বেদনার চিঠি । ‘কৃষ্ণকুমারী’র (১৮৬১) গল্প নেয়া রাজস্থানের উপকথা থেকে।
পুরাণের অবহেলিত,বঞ্চিত চরিত্রগুলো মধুরহাতেই হয়ে উঠল প্রতিবাদী আর দৃঢ়চেতা রক্তমাংসের আধুনিক এক নারী।
মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফেরার পর ১৮৫৬-১৮৬২ এই কয়েক বছরই তার সৃষ্টির স্বর্ণযুগ। তিনি তার গুরুত্বপূর্ণ স্বর্নগুলো ফলিয়েছেন এই ছয় বছরে। এরপর তিনি ইংল্যান্ড হয়ে ফ্রান্সে চলে যান ।
এরপর তার উল্লেখযোগ্য কাব্যটি তিনি লিখেন সুদূর ফ্রান্সে বসে।
পশ্চিমের সনেট প্রথম তার হাত ধরে বাংলা ভাষায় ঢুকলো ‘চতুর্থদশপদী কবিতাবলী’(১৮৬৬) কাব্যে।
শুধু যে সনেট প্রথম বাংলায় লেখা হলো তা নয় কবি মধুসূদনের বাংলায় প্রতি যে মায়া জন্মেছে, দেশের প্রতি যে প্রেম তার চরমতম বহি:প্রকাশ ঘটে এই ১০২টি সনেটে।
এটি একমাত্র কাব্যগ্রন্থ যেখানে মধুসূদনের ব্যক্তিভাবাগের ছবি পাওয়া যায়। ছোটবেলার কপোতাক্ষ নদের কথা মনে করে আপ্লুত কবি কপোতাক্ষকেই তার মতোই অমর করে দিয়ে গেলেন ইতিহাসে।
ফ্রান্স থেকে ফিরে হোমারের ইলিয়াডকে গদ্যে লিখতে শুরু করেছিলেন ‘হেক্টর বদ’ (১৮৭১) নামে। কিন্তু পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি। শেষ করতে পারলে মধুসূদনের হাতে গদ্য না জানি কি সুন্দরই হতো!
লেখার বিষয়বস্তু :
মধুসূদন মাত্র ৪৯ বছর বেঁচেছিল। সবমিলিয়ে ১৭ টি গ্রন্হ লিখেছিলেন যার মধ্যে ইংরেজি ৫ টি। নাটক লিখেছিলেন ৬ টি বাকিগুলো কাব্যে আর কিছু অনুবাদ।
শুরুর দিকে লেখায় তার ব্যক্তি ভাবাবেগ দেখা যায়নি। সৃষ্টির রসদ তিনি নিয়েছিলেন পুরাণ, রামায়ন মহাভারত কিংবা উপকথা থেকে।
‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ আর ‘একেই বলে সভ্যতা’ ছাড়া লেখায় সমসাময়িক কোন বিষয়ে তার আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। তার সাহিত্যচর্চার পুরোটাই পুরাণ আর হিন্দু ধর্মের চরিত্রের নুতনভাবে হাজির করা নিয়ে।
ফ্রান্সে বসে যখন তিনি সনেটগুলো লিখছেন তখনই প্রথম মধুসূদন রংক্তমাংসের মানুষ হিসেবে আবিভূত হলেন। লিখতে থাকলেন নিজের দু:খ, কষ্ট আর বেদনার কথা। স্বীকার করলেন ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়…”
আজকের আধুনিক কবিরা যেমন খুব সহজে বলছে ‘আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ এই কি মানুষজন্ম? এই যে নিজের বোধকে এত উম্মুক্তভাবে প্রকাশ করা এটাও মদুসূদনই শুরু করেছিলেন।
ছোটবেলার কপোতাক্ষকে মনে পড়ে মধুসূধন বললেন ‘সতত হে নদ তুমি পড়ো মোর মনে, সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে,….আর কি হে হবে দেখা ? ।
গদ্যের রাজ্যত্ব শুরুর আগে মধুসূদনই তো বাংলা সাহিত্যের রাজা। কে আছে তার আগের রাজারা? বড়ু চন্ডিদাস নাকি কাহ্নপা ! মাঝখানে মধুসূদন। তারপরে বঙ্কিম, রবিন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ! এইতো বাংলা সাহিত্যের সম্রাটদের সংক্ষিপ্ত তালিকা। মধুসূদন সাহিত্যের যুগসন্ধির এক মহাণ সম্রাট।
১৮৭৩ সালের ২৯ জুন অস্তমিত হয় বাংলা সাহিত্যের এক আসামাণ্য প্রতিভাধর, বিদ্রোহী এবং বাংলা জাগরণের প্রধানতম মানুষটির। বয়স তখন তার মাত্র ৪৯ বছর।
পারভেজ সেলিম
লেখক,সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী
child porn
Menemen eskort ,
Hi my family member I want to say that this post is awesome nice written and come with approximately all significant infos I would like to peer extra posts like this
You have a gift for writing engaging content. I was hooked from start to finish.
온라인 카지노 | 토토 사이트 먹튀 방지
먹튀 없는 안전한 메이저 사이트 추천 / 토토 사이트 카지노 사이트 먹튀 검증으로 먹튀 방지 / 먹튀 사이트 정보 제공 / 먹튀 신고 / 토토 커뮤니티 / 카지노 커뮤니티 / 먹튀검증 커뮤니티
온라인 카지노 | 토토 사이트 먹튀 방지