ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের ইতিহাস (পুরো পর্ব)


পারভেজ সেলিম
পারভেজ সেলিম ।।

ফিলিস্তিন বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিধ্বস্ত ভবনের পাশে বিষন্ন কোন শিশুর মুখ। আর ইসরাইল বলতে ভারী আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একদল সৈন্যের বন্দুকের সামনে নিরস্ত্র ভয়হীন কোন যুবকের ছবি।ইসরাইল-ফিলিস্তিনের ইতিহাস মানেই বিপন্ন মানুষের ইতিহাস।

ইসরাইল ফিলিস্তিনের এই দ্বন্দ্বের পিছনের কারণ কি? এই সংঘাত কি হঠাৎ শুরু হওয়া ইহুদী মুসলমানের সংঘাত ? নাকি এর পিছনে রয়েছে কয়েক হাজার বছরের দ্বন্দ্বের ইতিহাস ?  পুরো বিষয়টি বুঝতে বর্তমান ও প্রাচীন ইতিহাসের দিকে নজর দিতে হবে।

সংকটের শুরু: 

ফিলিস্তিনের মূল শহর হল ‘জেরুজালেম’। ঐতিহাসিকভাবে ইহুদী, খ্রিস্টান আর মুসলমানদের কাছে এটি একটি পবিত্র শহর। একসাথে তিন ধর্মের মানুষ এখানে পাশাপাশি বাস করতো দীর্ঘকাল ধরে।সংকটের মূলে আছে এই শহরের মালিকানা।

মাত্র ৭৫ বছর আগে মানে ১৯৪৭ সালে এই অঞ্চলটি ছিল ফিলিস্তিনি আরবদের।পেশি শক্তির জোরে পুরো এলাকাটি এখন দখলে নিয়েছে পশ্চিমা মদদপুষ্ট ধর্ম ভিত্তিক ইহুদী রাষ্ট্র ‘ইসরাইল’।

আজকের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৭৮ শতাংশ ইসরায়েলের দখলে। আর মাত্র ১২ শতাংশ ভুমি নিয়ন্ত্রণে আছে ফিলিস্তিনিদের। পৃথিবীর ইতিহাসে ফিলিস্তিন একমাত্র দেশ যারা মানবিকতা দেখাতে গিয়ে নিজেদের ভুখন্ড সম্পুর্ন হারাতে বসেছে।

তবে এর সবটাই একদিনে দখল হয়নি।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের আমূল পরিবর্তন হতে শুরু করে।আর তখনি সূত্রপাত হয় বর্তমানে চলমান পৃথিবীর দীর্ঘতম এই সংঘাতের ।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম : 

আঠারো শতকের শেষের দিকে জায়ানিজম বা ইহুদীবাদ ধারণা গড়ে উঠতে শুরু করে ইউরোপে। ইউরোপ ও রাশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ।

তবে ইহুদী ধর্ম মতে তাদের নবী ‘মশীহ’ আবারও পৃথিবীতে না আসা পর্যন্ত তাদের নিজস্ব কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে না। ইহুদীদের সেই ধর্ম বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে জায়ানবাদিরা একটি স্বতন্ত্র ইহুদী রাষ্ট্র তৈরির আন্দোলন বেশ জনপ্রিয় করে তোলে ইউপরোপ আমেরিকায়। 

১৮৯৭ সালে থিওডোর হার্সেল নামের্ এক ইহুদি ‘ওয়াল্ড জায়ানিষ্ট অর্গানাজেশন’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন । তারা প্রথমে ধারণা করেছিলেন ইউরোপের কোথাও ইহুদীদের জন্য একটি ছোট রাষ্ট্র হবে।কিন্তু সেসময় এন্টি সেমিটিজম বা ইহুদী বিদ্বেষ গোটা ইউরোপ জুড়ে এত প্রবল ছিল যে, সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ হয়ে যায় ।  

হার্সেল এই সময় আন্দোলনকে আরো জোরদার করে তোলে।জায়ানবাদিরা মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন ভুখন্ডে তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকে । কারণ তারা মনে করে ফিলিস্তিনই তাদের আদি ভুখন্ড । কয়েক হাজার বছর আগে সেখান থেকেই ইহুদীরা বিতাড়িত হয়েছিল। 

তাদের বিশ্বাস ইহুদীদের পরিত্রাতা ‘মসীহ’ ফিরে আসবেন ফিলিস্তিনের পবিত্র শহর জেরুজালেমে। তাই ইহুদিদের কাঙ্খিত রাষ্ট্রের যোগ্যতম স্থান হলো ফিলিস্তিন। একটি স্লোগান সেসময় খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইউরোপে ‘ মানুষ বিহীন দেশটি হবে, দেশহীন মানুষদের জন্য’ । জায়ানবাদিরা প্রচার করছিল ফিলিস্তিনের জনমানব শুন্য জায়গায় তারা ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। তাদের এই প্রচারণা সঠিক ছিল না।

শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কুটচালে ফিলিস্তিন ভুখন্ডে ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন পুরন হয় ইহুদীদের। সাথে ধ্বংস হয়ে যায় স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন । 

অনেকে মনে করেন ইউরোপিয়রা অবিশ্বাস করতো ইহুদীদের, ইউরোপে ইহুদীদের দেশ হোক এটা কেউই চায়নি, মধ্যপ্রাচ্য ইহুদিদের পাঠিয়ে দিয়ে তাই ইউরোপিয়রা নিজেদের রক্ষা করেছে বলেই অনেকের ধারণা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরুস্ক হেরে গেলে শেষ হয় কয়েকশো বছরের উসমানীয় মুসলসানদের শাসন। ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দখলে। দুইটি ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদি রাষ্ট্র ভাগাভাগি করে ত্রিশ বছর শাসন করতে থাকে ফিলিস্তিনকে।

১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর  বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে  ইহুদীদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি পথ প্রশস্ত করে ব্রিটেন। ব্যারন রথচাইল্ড ছিলেন সেসময়ের একজন ডাকসাইটে ব্রিটিশ ইহুদী নেতা। তাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেমস বেলফোর । সেই চিঠিতেই প্রথম  ইহুদী রাষ্ট্র গঠনে  তাদের সম্মতির কথা জানায় ব্রিটেন । পাঁচ দিন পর চিঠিটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেলে ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি হিসেবে  ‘বেলফোর ঘোষণা’ সারাবিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

এই ঘোষণার পর দলে দলে ইহুদীদের ফিলিস্তিন ভুখন্ডে যাওয়া বাড়তে থাকে। এর আগে ১৯০২ সালে ইহুদিদের  ৩৫ হাজারের একটি দল ফিলিস্তিনে পৌঁছায়। যাকে বলা যায় ইহুদিদের প্রথম আলিয়া। আলিয়া মানে হল ইহুদীদের পুনর্বাসন। এরপর ১৯১৪ সালে ৪০ হাজার, ১৯২৩ সালে ৪০ হাজার ফিলিস্তিনে পৌঁছায়। ১৯২৮ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২ হাজারে ।  

ফিলিস্তিনের কিটবুস অঞ্চলে তারা এসে প্রথমে বসতি গড়ে। গাজা থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দুরুত্বে কিটবুস। সেখানে  প্রাচীনকাল থেকে কিছু ইহুদি স্থানীয় আরবদের সাথে বাস করতো।

এসেই তারা কৃষিকাজের সাথে যুক্ত হয়।জমি কিনি বসতি গড়তে থাকে। প্রথমে স্থানীয় আরবরা তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। তারা বুঝতে পারেনি এই জায়গা দেয়াই তাদেরই একদিন কাল হবে , উচ্ছেদ হয়ে যেতে হবে নিজেদের ভুখন্ড থেকে। এটাই ছিল ফিলিস্তিনিদের প্রথম ভুল। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি গভীর সংকটের দিকে যেতে থাকে।

১৯০২ সালে ফিলিস্তিনে ছিল মাত্র কয়েক হাজার ইহুদি । ১৯৩১ সালে সেই সংখ্যা যায় ১ লাখ ৮০ হাজার। স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করে ।

১৯৩৩ সালে জার্মানিতে ক্ষমতায় আসে হিটলার। নাৎসীদের সাথে চুক্তিতে আবার ৫০ হাজার ইহুদি পাঠানো হয় ফিলিস্তিনে। এটাকে বলা হয়  ৫ম আলিয়া । ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখ ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেঁচে যাওয়া ১ লাখ ইহুদীকে যখন ফিলিস্তিনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা তখন পরিস্থিতি নতুন দিকে মোড় নেয় । 

ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ব্রিটেন তারাই এবার বিরোধীতা করতে শুরু করে।  ব্রিটেনের মতে এই বিশাল সংখ্যক ইহুদি সেখানে গেলে, স্থানীয় আরবদের মধ্যে সংঘর্ষের মাত্রা বেড়ে যাবে। যা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। 

এমন কথায় ইসরায়েলিরা এক সময়ের মিত্র ব্রিটেনকে শক্র মনে করতে শুরু করে। এবার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে ইহুদীরা। আরব আর ব্রিটিশ দুপক্ষের বিরুদ্ধে একসাথে যুদ্ধ করতে থাকে রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর ইহুদীরা। 

ব্রিটেন শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বিষয়টি নিয়ে যায় জাতিসংঘে । ১৯৪৮ সালের ১৪ মে জাতিসংঘ একটি নতুন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় ফিলিস্তিনিদের উপর।

ফিলিস্তিন ভুখন্ড ভাগ হয় তিন ভাগে। ৫৬.৫ শতাংশ নিয়ে গঠিত হয় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল আর ৪৩.৫ শতাংশ নিয়ে হয় আরব রাষ্ট্র ফিলিস্তিন। পবিত্র শহর জেরুজালেমকে রাখা হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে। 

ফিলিস্তিনিরা সাথে সাথে এ অন্যায় সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখান করে। অন্যদিকে এই সিদ্ধান্তে উল্লাসে ফেটে পড়ে জায়ানবাদিরা। দীর্ঘদিনের কাঙ্খিত একটি দেশের স্বপ্ন পুরুন হয় ইহুদীদের। স্বপ্নের সেই দেশের নাম রাখা হয় ‘ইসরায়েল’।

ফিলিস্তিনিদের পরাজয় শুরু : 

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের কাছে ক্ষমতা দিয়ে ব্রিটেন-ফ্রান্স চলে যায় ১৯৪৮ সালে ১৫ মে। সেই দিনকে স্বাধীনতা দিবস হিসবে ঘোষণা করে ইসরায়েলিরা। 

এই অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদে এবার একসাথে ফুঁসে ওঠে আরবরা। সেইদিনই ৬টি আরব দেশ একসাথে আক্রমণ করে ইসরায়েলকে। শুরু হয় ইসরায়েল-আরব প্রথম যুদ্ধ।

মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও সৌদি আরবের আক্রমণে পালাতে থাকে ইসরায়েলিরা।পুনরুদ্ধার হতে থাকে দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখন্ড।

রাজধানী তেল আবিবে কোনঠাসা ইসরায়েল যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখনই ঘটে বিপত্তি। জাতিসংঘ থেকে যুদ্ধ বিরতির জন্য চাপ আসে দুপক্ষের কাছে। এবার আরবরা তাদের দ্বিতীয় ভুলটি করে। ইসরাইলকে পুরোপুরি পরাস্ত না করেই যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়। হেরে যাওয়া ইসরায়েল আবারো প্রাণ ফিরে পায়।

চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে অবৈধভাবে অস্ত্র গোলাবারুদ সংগ্রহ করে আবারো যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল। এবার পিছু হটতে বাধ্য হয় আরব বিশ্ব। প্রথম যুদ্ধই পরাজয় বরণ করে আরবরা। ফলাফল ফিলিস্তিন ভাগ হয়ে যায় তিন ভাগে।

জর্ডান দখলে রাখে পশ্চিম তীর ও পশ্চিম জেরুজালেম, মিশর দখল করে রাখে গাজা, আর ইসরায়েল দখল করে নেয় ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ জমি। সাথে নিজেদের দখলে নেয় মুসলমান ও ইহুদী দুইধর্মের পবিত্র ভূমি পুর্ব-জেরুজালেম।

৭ লক্ষ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে যায়। বাকিরা নিজ ভুখন্ডে পরবাসী হতে শুরু করে। শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের অনন্তকালের দূর্ভোগ।এই দিনটিকে তারা পালন করে ‘নাকবা বা বিপর্যয়ের দিন’ হিসেবে। আর ইসরায়েল পালন করে তাদের ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে।

ছয়দিনেই পুরো ফিলিস্তিন দখল:

আরবদের সাথে ইসরায়েলের যুদ্ধ হয় মোট চারটি । ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩। সব কয়টি যুদ্ধেই জয়ী হয় ইসরায়েল। আমেরিকা ও ইউরোপের মদদ পুষ্ট ইসরায়েলের সাথে শক্তিতে পেরে ওঠেনা গোটা আরব বিশ্ব।

১৯৬৭ সালের জুন মাসে হয় ইসরায়েল- আরব তৃতীয় যুদ্ধ। মাত্র ছয় দিনে হেরে যায় আরবরা। ইতিহাসে এটি ‘ছয়দিনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। সিরিয়া ও জর্ডানকে হটিয়ে দিয়ে এবার পুরো ফিলিস্তিনিই দখল করে নেয় ইহুদীরা। নিজ দেশ থেকে এবার সম্পূর্নরুপে বিতাড়িত হয়ে যায় ফিলিস্তিনিরা। 

মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে মানবিকতার কারনে যাদের ঠাঁই দিয়েছিল সেই ইহুদীদের কাছেই নিজভুমি হারাতে হয় ফিলিস্তিনিদের। 

ফিলিস্তিনীদের জন্য আর এক ইঞ্চি জায়গাও মুক্ত থাকে না। পুরো ফিলিস্তিন জুড়ে বসতি স্থাপন শুরু করে ইসরায়েলিরা। 

জাতিসংঘ এটিকে অবৈধ ও অন্যায় আগ্রাসন মনে করে। কিন্তু ইসলায়েল নিজেকে এতই শক্তিশালি ভাবতে শুরু করে যে, সকল আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাগুলি দেখিয়ে তারা চালাতে থাকে তাদের দখলদারিত্ব। 

সাধারণ ফিলিস্তিনির মধ্যে অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করতে থাকে। সেই জনরোষ শুরু হয়েছিল আরো আগে। সেই সময় ১৯৬৪ সালে জন্ম নেয় হয় পিএলও বা ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’। দখলদার ইসরায়েলের কাছ থেকে নিজের মাতৃভুমিকে মুক্ত করাই এই রাজনৈতিক সংগঠনটির একমাত্র লক্ষ্য।

তবে জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের ভূবন্টন সিদ্ধান্তকে মেনে নেয় পিএলও। চলে কুটনৈতিক আলোচনা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধি হিসেবে মানতে শুরু করে পিএলওকে। আলোচনা ও ছুটাছুটি চলতে থাকে কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না।

১৯৭৩ ইসরায়েল-আরব আবারও যুদ্ধ বাধে।‘ইয়ম কিপুর’ বা ‘রমজান যুদ্ধ’ নামে পরিচিত এই যুদ্ধ। রাশিয়া এবং আমেরিকা তাদের মিত্রদের সহায়তা করতে থাকলে সারা বিশ্বে অস্থিরতা তৈরি হয়। 

ফলাফল যা দাঁড়ায় তা হল, ক্যাম্প ডেডিড চুক্তি সম্পন্ন হয় ১৯৭৮ সালে । মিশর ফিরে পায় তাদের সিনাই উপত্যাকা, বিনিময়ে প্রথম আরব রাষ্ট্র হিসেবে মিশর স্বীকৃতি দেয় ইসলায়েলকে।

 ইন্তিফাদা’র শুরু : 

কয়েক বছরের মধ্যে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের গণবিস্ফোরণ ঘটে। ১৯৮৭ সালে প্রথম ‘ইন্তিফাদা’ বা গণঅভূত্থান দেখা দেয়। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি রাস্তায় নেমে আসে নিপীড়ন ও দখলদারির বিরুদ্ধে। শিশু, তরুণ, যুবকরা শুধু পাথর ছুড়ে নাস্তানাবুদ করতে থাকে ইসরায়েলি সৈন্যদের। নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের এমন অসীম সাহস আর মনোবল দেখে নড়েচড়ে ওঠে গোটা বিশ্ব। ভয় পেয়ে যায় দখলদার ইসরায়েলও।

এবার গঠিত হয় ফিলিস্তিনিদের ইসলামিক রাজনৈতিক সংগঠন ‘হামাস’। যারা সরাসরি  ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অস্বীকার করে। পিএলও যতটা নরম, হামাস ততটা কঠোর।সাধারণ ফিলিস্তিনীরা ‘হামাস’কে সমর্থন করতে থাকে।ফলাফল ইসরায়েল কিছুটা নমনীয় হতে শুরু করে। 

আমেরিকার মধ্যস্ততায় ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি হয় ইসরাইল ও পিএলও এর মধ্যে। ইসরায়েল প্রথম কোন ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ফিলিস্তিনি নেতা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ইয়াসির আরাফাত। চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল পর্যায়ক্রমে তাদের দখলকৃত এলাকা ছেড়ে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়।

তবে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ভুমি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন জটিলতা দেখা দেয়। শর্ত অনুযায়ি অধিকৃত ভুমি নিয়ন্ত্রিত হবে তিনভাবে। অঞ্চল ‘এ’ নিয়ন্ত্রণ করবে ফিলিস্তিনিরা, অঞ্চল ‘বি’ নিয়ন্ত্রণে করবে দুপক্ষ মিলে এবং অঞ্চল ‘সি’ পুরোপুরি দখলে থাকবে ইসরায়েলের ।

তিন নম্বর অঞ্চলটি ছিল পশ্চিম তীরে যেখানে পানির যোগান বেশি এবং কৃষিকাজ ভালো হয়। এই সুবিধাজনক জমিগুলো ইসরাইলিরা নিতে চাইলে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা অস্বীকৃতি জানায়। আবারো সংঘর্ষ বাধে। 

শুরু হয় দ্বিতীয় ‘ইন্তিহাদা’। ২০০০-২০০৫ সালে ভয়াবহ এই গণরোষে রক্তাত্ব হয় ফিলিস্তিন। ৫ হাজার ফিলিস্তিনি আর ১ হাজারের বেশি ইসরায়েলি নিহত হয় সেই সংঘর্ষে।

২০০৬ সাল থেকে গাজায় অবরুদ্ধ হয়ে আছে ২১ লাখ মানুষ আর পশ্চিম তীরে অবৈধভাবে ভুমি দখল করে যাচ্ছে ইসরাইল ।

২০২১ সালের ৬ থেকে ২১ মে পর্যন্ত হামাস আর ইসরাইলের যুদ্ধে নিহত হয় ২১৬ জন ফিলিস্তিনি আর ১২ জন ইসরাইলি। ২১ মে যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয় হামাস ও ইসরাইল।

সবশেষ ৭ অক্টোবর, ২০২৩

হামাস এক নজীরবিহীণ হামলা চালিয়েছে ইসরাইলে। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর এটিই সবচেয়ে বড় ঘটণা।

মাত্র ২০ মিনিটে ৫০০০ হাজার রকেট ছোড়ে। ইসরাইলের সর্বাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোমের’ অভেদ্যের ইমেজকে চুর্ণবিচুর্ন করে দেয়।

সাথে প্যারগ্লাডাইডার দিয়ে আকাশপথে ইসরাইলের ভুখন্ডে ঢুকে, একটি সঙ্গীত অনুষ্ঠানে ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায় হামাস। সীমান্ত বেষ্টনী বুলডোজার দিয়ে ভেঙ্গে ইসরাইলে ঢুকে তাদের জিম্মি করে নিয়ে আসে যোদ্ধারা।

যুদ্ধে পঞ্চম দিন পর্যন্ত ইসরাইলি নিহত হয়েছে ১২০০ আর ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছ ৯৫০। ইসরাইল ও হামাস দুপক্ষই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যুদ্ধ চলমান।

ব্যাপক হত্যাকান্ডের আশংকা করা হচ্ছে। ইসরাইলিরা অনেকে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। আর গাজায় ২.৬ লক্ষ মানুষ বাস্তুচুত্য হয়েছে ইতিমধ্যে। আবারো এক বড় মানবিক বিপর্যের মুখে ইসরাইল -ফিলিস্তিনির মানুষ।


আরো পড়ুন : খলিফা হত্যাকাণ্ড: ইসলামের রক্তাক্ত ইতিহাস


বর্তমান ফিলিস্তিন নেতৃত্ব : 

২০০৪ সালে ফিলিস্তিনিদের স্বপ্ন অসমাপ্ত রেখেই মারা যায় ইয়াসির আর‍াফাত। দুরুত্ব তৈরি হয় ফিলিস্তিনির সক্রিয় দুই রাজনৈতিক দল হামাস ও ফাতাহর মধ্যে ।

২০০৬ এ নির্বাচনে জয়ী হয় হামাস। আন্তর্জাতিক চাপে সরকার গঠন করতে পারেনা তারা। ইসরায়েল, আমেরিকা, ইউরোপ সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দেয় ‘হামাস’কে। চীন, রাশিয়া, ইরান এর বিরোধীতা করে।

২০০৭ সালে ফাতাহকে হটিয়ে দিয়ে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় ‘হামাস’। তারপর থেকে পশ্চিম তীরে চলছে দুর্বল মাহমুদ আব্বাসের ‘ফাতাহ’র শাসন আর গাজা শাসন করছে ইসমাইল হানিয়ার নেতৃত্বে কঠোর ‘হামাস’ । এক দেশ শাসন করছে দুই দল।

এখন গাজাকে চারিদিক দিয়ে অবোরোধ করে রেখেছে ইসরায়েল। বিভক্ত নেতৃত্বের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ইসরা্য়েল। সংকটে আর দূর্ভোগে মরছে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা। 

মানচিত্রে ইসরাইল-ফিলিস্তিন :

ফিলিস্তিন ভুখন্ডের সাথে চারটি দেশের সীমান্ত যুক্ত হয়েছে। এর পশ্চিমে ভুমধ্য সাগর, পুর্বে জর্ডান। উত্তরে সিরিয়া ও লেবানন আর গোলান মালভুমি, দক্ষিনে মিশর ও সিনাই উপত্যাকা।

১৯৪৭ এর আগে পুরো জমির মালিক ছিল ফিলিস্তিন। ১৯৪৮ এসে তা ভাগ হয়ে যায় ৪৪ শতাংশে। ১৯৬৭ তে এসে তা নেমে যায় ২২ শতাংশে। আর বর্তমানে ফিলিস্তিনের দখলে আছে মাত্র ১৫ শতাংশ ভুমি। ধীরে ধীরে ভূমির পরিমান আরো কমছে। গাজা ও পশ্চিম তীর এই দুটি বিচ্ছিন্ন ভুখন্ড নিয়ে এখন ফিলিস্তিন।

ইসরাইলের প্রাচীন ইতিহাস:

প্রাচীনকালে ইসরায়েলিরা পরিচিত ছিল ‘হিব্রু জাতি’ হিসেবে। তাদের আদি পুরুষ আব্রাহাম বা ইব্রাহিম নবী ছিলেন মেসোপটেমিয়া মানে আজকের ইরাক অঞ্চলের মানুষ।

ইহুদীরা প্রথম দিকে যাযাবরের মতো ঘুরেছে। ঘুরতে ঘুরতে আব্রাহাম একসময় কেনান (আজকের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন) অঞ্চলে এসে বসতি গড়ে তোলে।

আব্রাহামের দুই ছেলে ইসমাইল ও ইসহাক। ইসমাইলকে মায়ের সাথে মক্কায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। কেনানে থেকে যায় ইসহাক।

ইসহাকের ছেলে ইয়াকুব বা জ্যাকোবের আরেক নাম ছিল ইসরাইল। তাদের বংশধরেরাই বনী ইসরাইল নামে পরিচিত। ইয়াকুবের ১২ সন্তানে মাধ্যমে বনী ইসরাইলে ১২ গোত্রের সৃষ্টি হয়েছিল বলেই বিশ্বাস ।

এক সন্তান ইউসুফ মিশরের ক্ষমতার উচ্চপদে বসেছিলেন, তিনি বনী ইসরাইলের পুরো বংশকে মিশরে নিয়ে আসেন।

সময়ের পরিক্রমায় ইহুদীরা মিশরে ফেরাউনের (রেমেসিস) দাস হতে বাধ্য হয়।

কয়েকশ বছর পর মুসা নবী ইহুদীদের উদ্ধার করে অলৌকিকভাবে লোহিত সাগর পার করে নিয়ে আসেন কেনান বা আজকের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন।

উত্থান পর্ব : 

‘হিব্রু জাতি’র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা শুরু করেন ডেভিড বা দাউদ নবী। সেটা ১০০০ খ্রি.পুর্বের ঘটনা। তিনি ছিলেন একজন সামান্য মেষপালক।হিব্রু বাইবেল অনুযায়ী এক যুদ্ধে গলিয়াদ নামের বিশাল এক যোদ্ধাকে পাথর ছুঁড়ে পরাজিত করেছিলেন মেষবালক ডেভিড। 

পরবর্তীতে ডেভিড ইসরাইলের সবচেয়ে বড় যোদ্ধা হয়ে ওঠেন।ইসরাইলকে এক বিশাল সাম্রাজে পরিনত করেন। ডেভিডের জনপ্রিয়তায় ঈর্শান্বিত হয়ে তাকে খুনের চেষ্টা করেন রাজা সাউল। 

সাউল বা তালুত ছিলেন ইসরাইলের প্রথম রাজা। ১০২৪ খ্রি.পূর্বাব্দে তিনি রাজা হয়েছিলেন। সাউলের উপর অভিমান করে শেষ পর্যন্ত ইসরাইল থেকে চলে যান ডেভিড।

স্থানীয় ফিলিস্তিনরা ছিলো পৌত্তলিক ধর্ম বিশ্বাসী। আর ইহুদীরা ছিল এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলের ছিল চির বৈরিতা ।

ডেডিভ না থাকায় ফিলিস্তিনিদের কাছে এবার পরাজিত হন সাউল। যুদ্ধে মারা যায় তার ছেলে। সন্তানের শোকে যুদ্ধের মাঠে আত্মহত্যা করেন সাউল ।

নির্বাসনে থাকা অবস্থায় ডেভিড এবার রাজা হন ইসরায়লের। এবার ডেভিড তার জনগনের জন্য নতুন শহর দখল করতে থাকেন। 

খুব সহজেই জেরুজালেম দখল করে নেয় ডেভিড ও তার বাহিনী। তারপর থেকেই ‘জেরুজালেম’ পবিত্র ভূমি হয়ে ওঠে ইহুদীদের কাছে। এটি পবিত্র ‘ডেভিডের শহর’ নামেও পরিচিত। 

দীর্ঘদিন শাসন করার পর ডিভিড বৃদ্ধ হলে ছেলে সুলোমন বা সুলায়মান নবীকে ইসরাইলের রাজা বানিয়ে নিজে ছুটি নেন। ৯৭০ খ্রি.পুর্বাব্দে মারা যান ডেভিড। 

এরপর ইসরাইলে শুরু হয় সুলেমানের যুগ। ইহুদীদের স্বর্নযুগ। জেরুজালেমে তিনি ‘প্রথম টেম্পল’ বা ‘টেম্পল অফ সলোমন’ নির্মাণ করেন। ইতিহাস বলে এটি জেরুজালেমের নির্মিত ‘প্রথম উপাসানালয়’। ইসলামে যা ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ নামে পরিচিত।

পতন পর্ব :

বিশাল এক সাম্রাজ্য রেখে ৯৩০ খ্রি.পুর্বে তিনি মারা যান সুলেমান। তার মৃত্যুর পর জেরুজালেম চলে যায় মিশরীয়দের দখলে। ইহুদীরা বিতাড়িত হতে থাকে জেরুজালেম থেকে। সুলেমানের মৃত্যু পর পতন শুরু হয় ইসরাইলের।

৫১৬  খ্রি. পূর্বে রাজা হেরড সেখানে ‘দ্বিতীয় টেম্পল’ তৈরি করেন । টেম্পলের চারিদিক দিয়ে প্রাচীর দিয়ে দেন । এই প্রাচীরই ইহুদীদের ‘কেবলা’ বা মুসলমানদের ‘বুরাক দেয়াল’ নামে পরিচিত। ৫৮৫ বছর এট টিকে ছিল । রোমানরা এটি ধ্বংস করে ৭০ সালে ।

আলেকজান্ডারও দখল করেছিল এই ভূখণ্ড। গাজায় আলেকজান্ডারের বাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়েছিল। গাজায় অনেক মানুষ হত্যা করেছিল আলেকজান্ডার।

যীশু খ্রিষ্টের জন্মের সময় এই অঞ্চল দখলে ছিল রোমানদের। ৭০ খ্রি. রোমানরা এসে জেরুজালেম শহর ধ্বংস করে দেয়। ইসরায়েল নামের আর কোন ভুখন্ড থাকে না।

বিতাড়ন পর্ব :

রোমানরা যখন ‘হেরোদ দ্যা গ্রেট’কে জুদাহ রাজ্যের রাজা বানান,  তখন ইহুদী অঞ্চল বেথেলহেমে জন্ম নেন খ্রিস্ট ধর্মের প্রধান পুরুষ যীশু বা ঈসা নবী। যীশুকে ক্রুশ বিদ্ধ করার পিছনে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র ছিল বলে খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করে। তাই ইহুদীদের সবসময় সন্দেহের চোখে দেখত খ্রিষ্টানরা ।

এরপর রোমানদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম যত জনপ্রিয় হতে থাকে ততই ইহুদী বিদ্বেষ বাড়তে থাকে।

৬৪ সালে নিজেদের সুরক্ষার জন্য একটি আইন জারি করে ইহুদিরা। তাতে ৬ বছরের বেশি বয়সী সকল ইহুদীদের পড়াশুনা বাধ্যতামুলক করা হয়। এরপর থেকেই ইহুদীরা শিক্ষাকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহন করে । 

৬৬ সালে রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে ইহুদীরা। এর চরম মুল্য দিতে হয় তাদের। ১০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করা হয় এবং রোমনরা জেরুজালেম থেকে তাদের বিতাড়িত করতে থাকে।

এরপর ইহুদী ধর্মই নিষিদ্ধ করে সম্রাট হাদ্রিয়ান ১৩১ সালে। জেরুজালেমের নামই পাল্টিয়ে করা হয় ইলিয়া কাপাতোলিনা।আর ইহুদি প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘ফিলিস্তিন’ বা ‘প্যালেস্টাইন’।

সম্রাট কন্সট্যান্টিয়ান রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে খ্রিষ্ট ধর্ম চালু করেন ৩১২ সালে.।  এরপর ইহুদীদের সংকট আরো বেড়ে যায়। আরো তিনশ বছর ইহুদীরা জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা বিশ্বে ।

মুসলমানেরা জেরুজালেম জয় করে দ্বিতীয় খলিফা উমরের সময় । ৬৩৭ সালে। খলিফা উমর নিজে গিয়েছিলেন জেরুজালেম শহরের চাবি গ্রহণ করতে ।

৬৯১ সালে আজকের সেই বিখ্যাত সোনালী গম্বুজ নির্মাণ করেন খলিফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানী। আর মসুজিদুল আকসা নির্মাণ হয় ৭০৫ সালে ।

 ১০৯৯ সালে খ্রিস্টানদের দখলের আগে জেরুজালেম মুসলমানদের অধীনেই ছিল ।

৮৮ বছর পর ১১৮৭ সালে খ্রিস্টানদের কাছে থেকে আবারও জেরুজালেম জয় করেন সালাহুদ্দিন আইযুবি। 

অটোমান সম্রাট সুলতান সুলেমান ১৫৩৮ সালে জেরুজালেমকে ঘিরে বিখ্যাত দেয়াল তুলেন । যেটি এখন ওয়াল ও জেরুজালেম নামে পরিচিত। চারভাগে এখানে এখনও ইহুদী, খ্রিষ্টান , মৃসলমান ও আর্মেনিয়ানরা বাস করে ।

১৯১৭ সাল পর্যন্ত জেরুজালেম অটোমানদের দখলেই থাকে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরুস্ক হারা পর ব্রিটেন ও ফান্স নিয়ন্ত্রণ নেয় ।

ধ্বংস পর্ব :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই জার্মানীসহ পুরো ইউরোপে ইহুদী বিদ্বেষ শুরু হয়। হিটলার ৬০ লাখ ইহুদীকে হত্যা করে। ইতিহাসে যা হলোকস্ট নামে পরিচিত।

বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৮ সালে জায়ানবাদী আন্দোলনের ফলে ইহুদীদের একটি রাষ্ট্রের ব্যবস্থা করে পশ্চিমারা। সেটা মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনের ভুখন্ডকে ভাগ করে। জন্ম হয় ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল ।

৭০ খ্রি. রোমানরা ইসরাইল রাস্ট্র ধ্বংস করেছিল। এর ১৮৭৮ বছর পর ইহুদীরা হয়ত নিজেদের জন্য একটি রাষ্ট্র পায়। কিন্তু অনন্তকালের এক সংঘাতের দিকে এগুতে থাকে এই অঞ্চলের মানুষেরা।


আরো পড়ুন : কারবালা : বেদনার এক ইতিহাস (পুরো পর্ব)


ফিলিস্তিনের প্রাচীন ইতিহাস :

বর্তমান ফিলিস্তিন নামটি হয় সম্রাট হাদ্রিয়ানের সময় । ১৩১ খ্রিস্টাব্দে । যখন ইহুদি ধর্ম নিষিদ্ধ করা হয়।এই অঞ্চলটি মুলত ছিল প্রাচীনকালের কেনান অঞ্চল । এর আদিবাসিরা আসলে গ্রিসের এজিয়ান সভ্যাতার মানুষ ।তারা এসেছিল কাফতর থেকে। ইসরাইলিদের আসার কিছু আগে  ফিলিস্তিনিরা এখানে আসে। সেই ১২ খ্রি.পূর্বাব্দে দিকে ।

তার আগে এই কেনান অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি বা গোত্র বাস করত। হেবাইট , জেবুসাইট, এমরাইট, হিত্তিত, পেরিসাইট ইত্যাদি।

 

মুসা নবী ইহুদীদের মিশর থেকে বের করে নিয়ে আসার পর কেনান বা ইসরাইলে ঢুকতে পারেনি। ইসলাম ধর্ম মতে ৪০ বছর পাপের শাস্তি স্বরুপ যাযাবরের মত ঘুরে পরে কেনানে ঢুকতে পারে।

ইসয়ালেরা কেনানে এসে স্থানীয়দের সাথে বিবাহ হয় এবং বংশ বিস্তার করতে থাকে। ইসরায়েলের শরীরে কেনানীয় রক্তই বেশি।

একইভাবে ফিলিস্তিনীদের শরীরেও কেনানীয়দের রক্ত বইছে।ইসরাইল ও  ফিলিস্তিনের জিনগতভাবে  মূলত একই তবে তাদের ধর্ম বিশ্বাস ছিল আলাদা। ফিলিস্তিনের প্রাচীন কালে ধর্ম ছিল পৌত্তলিক। পরে তার খ্রিষ্টান হয়েছে এবং সব শেষ মুসলিম হয়েছে।

ফিলিস্তিন কি কোন রাষ্ট্র ? না এখনও পুর্নাঙ্গ রাস্ট্রের মর্যাদা পায়নি ফিলিস্তিন । ২০১২ সালে পর্যবেক্ষক রাস্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। তাদের কোন সেনাবাহিনী নাই। তাদের দেশে কোন সীমানা নির্ধারণ নাই।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পশ্চিম তীরে যেকোন জায়গায় যখন তখন অপারেশন চালায়। 

জেরুজালেম কার ?

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শহরগুলোর একটি হচ্ছে জেরুজালেম।পাঁচ হাজার বছর আগে গড়ে ওঠে ছোট এই শহরটির।আয়তন মাত্র ৬৫২ বর্গকিলোমিটার। আমাদের ঢাকা শহরের চেয়ে সাড়ে তিনগুন ছোট শহর জেরুজালেম।  

জেরুজালেমের গুরুত্ব অন্য যেকোন শহরের তুলনায় অনেক বেশি। কয়েক হাজার বছর ধরে ধর্মীয় সম্প্রাদায়ের কাছে এটি পবিত্র শহর হিসেবে পরিচিত। ইহুদী, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের কাছে এটি পবিত্রতম শহর ।

বিশ শতকের জেরুজালেম wikimedia

কারা এখানকার প্রাচীনকালে বাসিন্দা ?  ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইলিরা কেউই এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা নয়।তারা  অন্য অঞ্চল থেকে এখানে এসেছে। স্থানীয়রা মুলত কেনানদেশীয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মানুষ ছিল ।তাদের সাথেই মিলেমিশে এক হয়েছে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা । 

প্রথমে ফিলিস্তিনিরা এসেছে। তাদের হটিয়ে দিয়ে এসেছে ইহুদীরা। বানিয়েছে ইসরাইল রাষ্ট্র। এরপর ইহুদীদের বিতাড়িত করে দিয়ে জেরুজালেম দখল করেছে মিশরীয়, ব্যবিলনিয়, পারসিক, গ্রিক, রোমানরা  ও মুসলমান এ ব্রিটিশরা।

ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় এই শহরটি ধ্বংস হয়েছে দুইবার। দখল হয়েছে ২৩ বার আর আক্রমন হয়েছে ৫২ বার।

কেনান দেশীরা ২৪০০ খ্রী.পুর্বাব্দে এই শহরের নাম দিয়েছিল ‘উরুসালিম’। মানে সালিমের শহর। সালিম ছিলেন তাদের দেবতা। হিব্রুতে যার অর্থ ছিল শান্তির শহর। ধর্মের প্রভাব নিয়ে এই শহর গড়ে উঠেছে সেই সাড়ে চার হাজার বছর আগ থেকেই। 

খ্রি.পূর্ব ৯৫৭ সালে ডেভিড বা দাউদ নবী এসে জেরুজালেম দখল করে নেয় জেবুসাইটদের কাছ থেকে । তারপর এখানে তিনি শহর গড়ে তোলেন। তখন আরবীতে এই শহরের নাম ছিল ‘কুদস’ । 

ডেভিডের ছেলে সলোমন বা সোলাইমান নবী এই শহরে ‘টেম্পল মাউন্ড’ বা ঈশ্বরে ঘরের পাহাড় নামে একটি স্থাপনা নির্মাণ করেন। ইহুদির কাছে এটি ‘টেম্পল অফ সুলেমান’ বা ‘ফাস্ট টেম্পল’ আর মুসলমানদের কাছে এর নাম ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ । তবে মুসলমানদের কাছে ‘বায়তুল মোকাদ্দাসে’র ইতিহাস আরো পুরোনো । 

কাবা ঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর ইব্রাহিম নবী প্রথম এখানে ইবাদতের ঘর নির্মাণ করেছিলেন বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করে। যার নাম ‘মসজিদুল আকসা’। পরে অনেক নবী হাত ধরে এসে পৌঁছায় সোলায়মান নবীর কাছে । তিনি এটার সবচেয়ে বড় সংস্কারটি করেন । জ্বিনের সহায়তা নিয়ে তিনি বিশাল বিশাল পাথর নিয়ে এটি নির্মাণ করেছেন বলে কুরাআনে উল্লেখ আছে ।

খ্রি.পু অষ্টম শতকে ইসরায়েল ও জুদাহ দুটি অঞ্চলে ভাগ হয়ে যায় । জুদাহ রাজ্যের রাজধানী হয় জেরুজালেম।

দ্বিতীয় শতকে এসে রোমানরা এই শহরের নামই বদলিয়ে দেয় ইলিয়া কাপিতোলিনা’। সেই থেকে আরবীতে এর নাম হয় ‘ইলিয়া’।

এরপর ৬৩৭ সালে জেরুজালেম আসে মুসলমানদের অধিকারে। এরপর মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে শহরের নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তন হয় । সবশেষ ১১৮৭ সালে সালাউদ্দীন আইয়ুবী ৮৮ বছর পর ক্রুসেডরদের কাছ থেকে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন ।এরপর ৭০০ বছর ধরে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল জেরুজালেম । 

১৫৩৮ সালে অটোম্যান সম্রাট সুলতান সুলেমান এই শহরে বিশাল প্রাচীর দিয়ে চারটি অংশে ভাগ করেন। ইহুদী, খ্রিস্টান, মুসলমান আর আর্মেনিয়রা বাস করতে থাকে আলাদা আলাদা অংশে। এটাকে বলা হয় ‘ওল্ড সিটি’। এরপর জেরুজালেমের নতুন শহর আরো বিস্তৃত হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর  ১৯১৭ সালে শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় বৃটিশরা। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ও ইসরায়ের নামে দুটি নুতন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় জাতিসংঘে। ‘জেরুজালেম’ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকার সিদ্ধান্ত হয় । ১৯৬৭ সালে অবৈধভাবে জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরায়েল। 

এখন লাখ টাকার প্রশ্ন এই জেরুজালেম কার ? এর কোন সহজ উত্তর দেয়া সত্যিই কঠিন। জটিল এই প্রশ্নের কোন সমাধান হচ্ছে না বলেই ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের ৭৩ বছরে যুদ্ধ এখনও চলমান। যেদিন এর সমাধান পাওয়া যাবে সেদিন যুদ্ধও বন্ধ হয়ে যাবে বলেই ধরে নেয়া যায় ।

বায়তুল মুকাদ্দাস বা টেম্পল মাউন্ট :

জেরিজালেম একটি পবিত্র শহর। সেই শহরের ভিতরে পবিত্রতম স্থানটির নাম ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ বা ‘টেম্পল মাউন্ট’। ঈশ্বরের ঘরের পাহাড়। জেরুজালেমের এই জায়গাটি নিয়েই আসলে যত দ্বন্দ্ব সংঘাত।

al aska mosque
বায়তুল মোকাদ্দাসের চত্ত্বর S: Abdullah Ibn Mahmud

‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ একক কোন স্থাপনা বা মসজিদ, গির্জা বা সিনাগগ নয়। এটি অনেকগুলো স্থাপনার সমন্নয়ে গঠিত একটি বিশাল পবিত্র চত্ত্বর । এটিকে অনেক কয়েকটি নামে ডাকা হয়।মুসলমানরা বলে ‘বাইতুল মোকাদ্দাস’ বা ‘হারাম আল শরিফ’ । আর ইহুদীরা বলে টেম্পল অফ মাউন্ট, টেম্পল অফ সুলেমন, ফাস্ট টেম্পল। বাংলায়  অনেকে বলে ‘পবিত্র ঘর’।

‘বাইতুল মোকাদ্দাস’ চত্বরে অনেক কয়েকটি স্থাপনা আছে। যার কোনটি মুসলমানের জন্য, কোনটি ইহুদীদের জন্য, কোনটি গুরুত্বপূর্ণ খ্রিস্টানদের জন্য। আবার সবগুলো্ কোন না কোনভাবে সকল ধর্মের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে ।

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আছে তিনটি। এক . আল আকসা মসজিদ, দুই. ডোম অফ দ্যা রক, তিন. ওয়েস্টার্ন ওয়াল। এছাড়া কিব্বাত আস সিলসিলা, কুব্বাত আল মিরাজসহ বেশ কিছু গম্বুজ রয়েছে এ্খানে।

ইসলাম ধর্ম মতে ইব্রাহিম নবী কাবা শরীফ ছাড়াও আরো একটি উপসানার স্থান নির্মাণ করে ছিলেন। সেটি এই জেরুজালেমে। মসজিদুল আল আকসা। কাবা নির্মাণের ৪০ বছর পর খ্রি. পূর্ব ২১৭০ সালে এটি নির্মাণ করেন। মক্কা থেকে এটি দুরে হওয়ায় এর  নাম ‘আল আকসা’ বা ‘দুরবর্তী মসজিদ’ নামকরন করা হয়। 

তবে স্থানটি সঠিক কোন জায়গায় তার নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেনা। ধারণা করা হয় বায়তুল মুকাদ্দাসের কোন এক জায়গায় তিনি মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন । 

ইব্রাহিমের পুত্র ইসহাক এখানে এক আল্লাহর প্রার্থনা করতেন।পরে ইসহাকের দ্বিতীয় পুত্র ইয়াকুব এটিকে আরো বর্ধিত করেন।

পরবর্তীতে সুলায়মান নবী খ্রি.পুর্ব ১০০৪ সালে এটি নির্মাণ করে। যা ইহুদীদের মতে  ‘প্রথম টেম্পল’। আর মুসলমানেরা বিশ্বাস করে এটি নির্মাণের সময় জ্বীনদের ব্যবহার করা হয়েছিল।

খ্রী.পুর্ব  ৫৮৬ সালে ব্যবিলনের রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার এটি ধ্বংস করে । 

২০৮ খ্রি. পুর্বাব্দে এখানে আবার স্থাপনা নির্মাণ হয় ,রাজা হোরোড দ্যা গ্রেটের সময়।ওয়েস্টার্ন ওয়ালটা তার সময় নির্মাণ শুরু হয়। 

৭০ খ্রি রোমানরা এসে আবার ধ্বংস করে দেয়  এবং এখানে দেবতা জুপিটারের উপসনার স্থান নির্মাণ করে ।

৩১৫ খ্রি. রোমান খ্রিস্টানরা এটিকে ময়লা ফেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করতো।ইহুদিরাও এটাকে পবিত্র স্থান বলে মনে করতো না। পরবর্তীতে মুসলমানেরা জেরুজালেম দখল করলে খলিফা উমর নিজে এই ময়লার জায়গাটি পরিস্কার করে একটি কাঠের মসজিদ নির্মান করে।এই পুরো এলাকাটিকে বলা হয় ‘আল আকসা মসজিদ’ ।

আল আকসা মসজিদ :

এটিও কোন একক মসজিদ নয় । কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদকে একসঙ্গে বলা হয় আল আকসা মসজিদ। ‘বায়তুল মোকাদ্দাসে’র  বিশাল চত্ত্বরেই সব মসজিদের অবস্থান ।

পাখির চোখে আল আকসা source : wikimedia

শেষ নবী মেরাজে যাবার আগে সকল নবীদের নিয়ে যেখানে নামাজ পড়েছিলেন সে স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, সেইটি ‘কিবলি মসজিদ’। পশ্চিম ওয়ালের কোথাও বোরাককে বেঁধে রেখে নামাজ পড়েছিলেন। সেই প্রাচীরে উল্টোদিকেই ‘বুরাক মসজিদ’। বোরকাকে বেঁধে রাখার কড়াটি এখনও সেখানে দেখা যায়।

‘আল আকসা মসজিদ’ ছিল মুসলমানদের জন্য প্রথম কেবলা। প্রথমে মুসলমানের এই দিকে মুখ করে নামাজ পড়তো। পরে মক্কার দিকে মুসলমানদের কেবলা ঘুরে যায় । তাই মুসলমানদের কাছে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ন ।

 ডোম অব দ্যা রক :

পুরো চত্ত্বরে সোনালী গম্বুজের সবচেয়ে সুন্দর স্থাপনাটির নাম ‘ডোম অব দ্যা রক’ বা ‘কুব্বাতুস সাখারাহ’ । অনেকে এটাকেই ‘আল আকসা মসজিদ’ ভেবে ভুল করেন। আসলে এটি পুরো চত্ত্বরে অনেক কয়েকটি মসজিদের মতোই আরেকটি মসজিদ। যার নাম ‘সোনালী গম্বুজের মসজিদ’  বা ‘কুব্বাতুস সাখরাহ’। যেখানে পাথরে উপর দাঁড়িয়ে মুসলমানদের শেষ নবী উর্দ্ধাকাশে গমন করেছিলেন ।

রায়তুল মোকাদ্দাস আলোর দেশে
ডোম আব দ্যা রক/ কুব্বাতুস সাখরাহ wikimedia

৬৯১ সালে খলিফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান এটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। এটি ইসলামের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনার নিদর্শণ। 

মসজিদেে বাইরের দেয়ালের পাথরগুলো এতটাই উজ্জ্বল যে ১৫০০ বছর পরও  মনে হয় যেন কিছুক্ষন আগে রং করা হয়েছে। এটিই ‘বায়তুল মুকাদ্দাসে’র সবচেয়ে আকর্ষনীয় স্থাপনা এটি। এর গায়ে আরবীতে লিখা ‘সুরা ইয়াসিন’ ।

এর ভিতরে বিশাল এক পাথর আছে । পাথর কেটে ভিতরে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে । যেখানে একসঙ্গে কয়েকজন মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন ।

এখন সোনালী রঙের গুম্বুজটাই গোটা ‘বাইতুল মোকাদ্দাস’ বা ‘আল আকসা মসজিদে’র প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।

ইহুদীরা মনে করে এই স্থানেই ছিল তাদের ‘ফাস্ট ও সেকেন্ড টেম্পল’। যা রোমানরা এসে ধ্বংস করে দেয় ৭০ খ্রি.। এটিই হচ্ছে তাদের ফাউন্ডেশন স্টোন । ভিত্তিপ্রস্তর । তাদের মতে মহা বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান। ধর্মগ্রন্থ তোরাহ বা তাওরাত অনুয়ায়ি জাকোব বা ইয়াকুব নবী যে বেদি নির্মাণ করেছিলেন এটি সেই পাথর ।

 ইব্রাহিম নবী তার সন্তানকে এই পাথরের উপর কুরবানী দিতে চেয়েছিলেন।সকল ধর্মের কাছে তাই এটি খুবই গুরত্বপূর্ন ।

১০৯৯ সালে ক্রসেডররা এটি দখল করার পরে এটাকে খ্রিষ্টানদের গির্জা বানিয়েছিল। ১১৮৭ সালে  সুলতান সালাউদ্দিন আইযুবি জেরুজালেম দখল করলে চুড়ার ক্রুশকে সরিয়ে সেখানে চাঁদ বসিয়ে দেন।

ওয়েস্টার্ন ওয়াল  বা বোরাক দেয়াল :

একটি ১৬০ ফিটের লম্বা একটি দেয়াল যা বাইতুল মোকাদ্দাসকে ঘিরে আছে সেটি ‘বুরাক ওয়াল’ বা ‘পশ্চিম দেয়াল’ নামে পরিচিত। এর উচ্চতা ৬০ ফুট। ইহুদীদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন । এটি তাদের প্রথম কেবলা। এর দিকে মুখ করে তারা দিনে তিনবার প্রার্থনা করেন। 

ওয়েস্টার্ন ওয়াল/ বুরাক দেয়াল Source : wikimedia

রাজা হোরোড দ্যা গ্রেটের সময় এটি নির্মাণ কাছ শুরু হয়। ‘ফাউন্ডেশন স্টোন’ ইহুদীদের সবচেয়ে পবিত্র পাথর হলেও ধর্মমতে ইহুদির সেখানে তাদের যাবার অনুমতি নেই । পবিত্রতা রক্ষার্থে তাই এর চারিদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এই প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে ইহুদীরা প্রার্থনা করে। এটার নাম ‘উইলিং ওয়াল’ বা ‘প্রার্থনা দেয়াল’ ও বলা হয়।

মুসলমানদের শেষনবী মুহাম্মাদ মিরাজে যাবার সময় বোরাককে এই দেয়ালের পাশে বেঁধে রেখে নামাজ পড়েছিলেন।তাই এর নাম ‘বুরাক ওয়াল’। ওয়েস্টার্ন ওয়ালের উল্টো দিকেই ‘বোরাক মসজিদ’। তাই মুসলমানদের কাছেও এটি খুবই গুরত্বপুর্ন।

 চত্ত্বরের বাইরে : 

বায়তুইল মোকাদ্দাসের বাইরে পুর্ব পাশে আছে ‘উমর মসজিদ’ ও খ্রিস্টানদের ‘পবিত্র গির্জা সেপালচার’। এখানেই যীশুকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছিল  এবং এখান থেকেই তার পুনর্জন্ম হয়েছিল। খ্রিষ্টানদের জন্য এটি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ন জায়গা ।

পবিত্র গির্জা সেপালচার source : wikimedia

মুসলমানেরা যখন জেরুজালেম জয় করে তখন জেরুজালেমের খ্রিস্টান শাসনকর্তা পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াস একটি শর্ত জুড়ে দেন । তিনি খলিফা ছাড়া অন্য কারো হাতে শহরের চাবি দিতে রাজি নন। তখন মদিনা থেকে খলিফা উমর এসেছিলেন  জেরুজালেম শহরের চাবি গ্রহণ করতে। সেসময় চার্চের ভীতর নামাজ পড়তে বললে তিনি তা নাকচ করে দিয়ে বাহিরে এসে নামাজ পড়েন। তিনি বলেছিলেন খলিফা যদি চার্চের ভিতর নামাজ পড়ে তাহলে পরবর্তীতে মুসলমানেরা এটিকে মসজিদ বানিয়ে ফেলবে। খলিফা উমর চার্চের বাইরে যেখানে নামাজ পড়েছিলেন সেখানে পরবর্তীতে মুসলমানেরা মসজিদ বানায়। নাম দেয় ‘মসজিদে উমর’। মুসলমানদের জন্য তাই এই এলাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


আরো পড়ুন : দেশভাগ : বাঙ্গালীর এক নীল বেদনার অধ্যায় !!


বিশ্ব মোড়ল ও আরবদের রাজনীতি :

২০১৮ সালে ১৪ মে ডোনাল্ট ট্রাম্প আমেরিকার দুতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে আনে জেরুজালেমে। আমেরিকার এতদিনের নীতি থেকে সরে এসে এমন পদক্ষেপে ফিলিস্তিনিরা মারাত্বকভাবে ক্ষুদ্ধ হয়। তবে জন্মের পর থেকেই ইসরাইলের সবচেয়ে বড় বন্ধু  আমেরিকা ।

ইসরায়েল রাষ্ট্রের ধারণাকে বাস্তবে রুপ দিতে সবার প্রথম এগিয়ে এসেছিল ব্রিটেন। ১৯১৭ সালের ‘বেলফোর ঘোষণা’ ছিল ইহুদীদের দেয়া ব্রিটিশদের প্রথম প্রতিশ্রুতি।সবসময় ইসরাইলের স্বার্থ দেখেছে ব্রিটেন । 

হিটলার জার্মানীতে ক্ষমতায় আসার পর ইহুদী নিধন শুরু হয়। ফলে জায়ানবাদিদের জন্য সহানুভূতি বেড়ে যায় সারাবিশ্বে।এতে ইহুদী রাষ্ট্র গঠন ত্বরান্তিত হয়েছিল।  

দ্বিতীয় যুদ্ধের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিন থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয় । সেদিন ১৫ মে, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে। তাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন ডেভিড বেন গুরিওন। 

 ১৬২ টি দেশ ইসরায়লকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ৩৫টি দেশে বিরোধিতা করে যার বেশিরভাগই মুসলিমদের দেশ। পৃথিবীর একটি দেশ যার সাথে বাংলাদেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক নাই সেটি  ইসরায়েল।  বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে কেউ  ইসরায়েলে যেতে পারেনা । 

১৯৪৮ এ ব্রিটেন চলে যাবার পর লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, মিশর একসঙ্গে আক্রমন করেছিল।কিন্তু হেরে যায় ।  ১৯৬৭ সালে যুদ্ধে হেরে গিয়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

প্রথম মুসলিম দেশ হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দেয় তুরস্ক ১৯৪৯ সালে । 

আর ১৯৭৯ সালে স্বীকৃত দেয় প্রথম আরব দেশ মিশর। এজন্য মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত নোবেল পুরস্কার পান শান্তিতে। আরব লীগ বিরোধিতা করে মিশরের সদস্যপদ বন্ধ রাখে দশ বছর। শেষ পর্যন্ত এই সংকট খুন হন আনোয়ার সাদাত।

ইরান কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল ইসরাইলের সাথে ।পরে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হলে  ছিন্ন হয়ে যায় সেই সম্পর্ক ।

কয়েক বছর  পর জর্ডান ১৯৯৪ সালে ইসরাইলেকে স্বীকার করে শান্তি চুক্তি করে । কথা দেয় তাদের ভুখন্ড ব্যবহার করে তৃতীয় কেউ ইসরাইল আক্রমন করতে পারবেনা । মিশর স্বাগত জানায় , সিরিয়া প্রত্যাখান করে ।

এরপর ২০২০ সালে  সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন স্বীকৃতি প্রদান করে । সৌদি আরব স্বীকৃতি দেয়ার দারপ্রান্তে । 

তবে সবসময় রাশিয়া, চীন ও ইরান ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থেকেছে ।

২০০২ সালে সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে আরব বিশ্বের ২২ টি দেশ ঘোষণা দিয়েছিল যে, ‘১৯৬৭ সালে যুদ্ধে দখল করা ভুমি ছেড়ে দিয়ে জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনির রাজধানী মেনে নিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে দিতে হবে। না দিলে ইসরাইলের সাথে আরব বিশ্বের সম্পর্ক  ভালো হবে না’। তাদের সেই অবস্থান থেকে এখন সৌদি আরব সরে এসেছে বলেই মনে হয়।

চারটি আরব দেশ  শান্তি চুক্তি করলেও সাধারন জনগনের সাথে ইহুদীদের সম্পর্ক ভালো হয়নি এখনও। আজ ৪০ বছরেও মিশরের জনগন ইহুদিদের মন থেকে গ্রহণ করতে পারেনি, তেমনি পারেনি জর্ডানের জনগনও।

তাই নতুন নতুন শান্তি চুক্তি এ অঞ্চলে কতটুক শান্তি বয়ে আনবে তা নিয়ে সংশয় থেকে যায় ।

দ্বন্দ্বের কারণ গুলো কি কি ?

ইসরায়েল দাবি করে জেরুজালেম শহরের উপর তাদের সার্বভৌম অধিকার আছে । ১৯৬৭ সাল থেকে তারা শহরটিকে তাদের রাজধানী হিসেবে দখল করে রেখেছে।আর ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকেই তাদের রাজধানী হিসেবে চায়।

ফিলিস্তিনীরা চায় ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগে সীমান্ত যেমন ছিল সেভাবেই  ফিলিস্তিন রাস্ট্র গঠিত হবে। ইসরাইল এখন তা মানতে নারাজ।

১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল যেসব এলাকা দখল করে বসতি গড়ে তুলেছে সেসব অবৈধ বসতির অপসারণ চায় ফিলিস্তিন । ইসরায়েল তাতে রাজি নয় । আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ৫ লাখ ইহুদীর বসতি স্থাপন করেছে পশ্চিম তীরে

১৯৪৮ সালে পর থেকে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল । বর্তমানে তাদের বংশধরদের সংখ্যা ১ কোটি ছয় লাখ। তারা তাদের পৈত্রিক ভিটায় ফিরতে চায়। ইসরাইল এদের অধিকারকে মানতে নারাজ। ইহুদীরা মনে করে তারা ফিরলে ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে টিকতে পারবে না। বর্তমানে  ইসরাইলে মোট ইহুদী ৯০ লাখ। ১৯৪৮ সালে তারা ছিল ৬ লক্ষ।


আরো পুড়ন : বখতিয়ার খলজি: বাংলার প্রথম মুসলিম শাসক


 সংকট সমাধানের পথ কি আছে ?

এই সংকটের সমাধান আদৌ কি আছে ? খুব কঠিন প্রশ্ন । আচ্ছা একটি সাম্ভব্য সমাধান দেখা যাক, ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিয়েছে ইসরাইল। সাথে ১৯৪৮ এর জাতিসংঘের ভুমি বন্টন চুক্তিকে মেনে নিয়েছে। নিজস্ব ভুখন্ডে ফিলিস্তিনিদের চলাচল অবাধ করা হয়েছে। হামাসকে মেনে নিয়েছে ইসরাইল। তাহলে কি সমাধান হবে না ?  হবে হয়ত। কারন ইয়াসির আরাফাতের ফিলিস্তিনের স্বপ্ন তো এমনই ছিল। কিন্তু ইসরায়েল কি এখন তা করবে ? মনে হয় না।

আর উল্টো দিকে ফিলিস্তিনসহ পুরো আরব বিশ্ব একটি ইহুদী রাষ্ট্র হিসেবে যদি মেনে নেয় ইসরাইলকে। সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যদি পরিহার করে হামাস এবং রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয় ইসরাইলকে। তাহলে কি সংকট সমাধান হবে না ? হবে হয়ত । কিন্তু ফিলিস্তিন কিংবা পুরো আরব বিশ্ব কি তা করবে ? মনে হয় না।

সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন হচ্ছে জেরুজালেম কার হবে ? এই সংকটের সমাধান হলেই হয়ত সকল সংঘাতের সমাধান সহজ হতো।কিন্তু এ বিষয়ে ফয়সালা হওয়াই সবচেয়ে জটিল।

সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলমান  ইসরাইল- ফিলিস্তিন যুদ্ধে এক লক্ষের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। গৃহহীন হয়েছে কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনি।বাকিরা এক অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ নিয়ে সেখানে বসবাস করছে । 

কত প্রজন্মের অপেক্ষার পর, আর কত মানুষের মৃত্যু হলে, শান্তি ফিরে আসবে ফিলিস্তিনে, তা সত্যিই মানুষের অজানা।


পারভেজ সেলিম

লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার

ইসরায়েল ফিলিস্তিন নিয়ে আরো পড়ুন :

৫,৭৪৩ thoughts on “ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের ইতিহাস (পুরো পর্ব)

  1. Вот пятнадцать топовых сериалов для подлинных любителей ужасов.
    Бумажный дом 5 сезон 7 серия смотреть онлайн в
    онлайн-кинотеатре cDvNA полностью без рекламы.

    Закачивайте по намеченой дате выхода, Сериалы жанра “Ужасы”.
    В свою очередь мы даёт меню каналов Че,
    HD СТБ, 4K BBC World News, прямой эфир Канал Disney, трансляция Пятый канал.

  2. Hey I know this is off topic but I was wondering
    if you knew of any widgets I could add to my blog that
    automatically tweet my newest twitter updates. I’ve been looking for a plug-in like this for quite some time and was
    hoping maybe you would have some experience with something like this.

    Please let me know if you run into anything. I truly enjoy reading
    your blog and I look forward to your new updates.

  3. Pingback: 2expenditures
  4. Hello I am so delighted I found your web site, I really found you by mistake,
    while I was browsing on Digg for something else, Anyways I
    am here now and would just like to say thanks a lot for
    a incredible post and a all round interesting blog (I also
    love the theme/design), I don’t have time to read through it all at the minute but I have book-marked it and also included your RSS feeds,
    so when I have time I will be back to read a great deal more,
    Please do keep up the fantastic job.

    Also visit my web page; купить диплом

  5. Der Hersteller gibt an, dass ReduSlim zu Ihrer Ermächtigung dient, Eliminieren Sie Übergewicht und machen Sie
    schlank und schlank. Manche Menschen schaffen es, innerhalb
    eines Monats bis zu 7-10 kg Übergewicht zu verlieren, wenn sie eine Diät einhalten und Sport
    treiben. Krankheiten, wie Diabetes, kann auch verhindern, dass Menschen abnehmen.
    Reduslim ist eine Pillenergänzung, die Ihnen beim
    Abnehmen hilft. Wie lange dauert es, bis man Ergebnisse mit Reduslim sieht?
    Wozu dient ReduSlim und wie funktioniert es, um mich schlank und schlank zu halten? Acetylcarnitin: Die Härte der Inhaltsstoffe
    ermöglicht es, auf die Giftstoffe einzuwirken und alle schädlichen Abfälle aus dem Körper zu entfernen. Einige Fatburner enthalten Inhaltsstoffe mit einem
    hohen Anteil an löslichen Ballaststoffen. Die Formel enthält
    nur natürliche Inhaltsstoffe und das Produkt hat ein Qualitätszertifikat.
    Diese Inhaltsstoffe sollen die Fettverbrennung ankurbeln und
    den Stoffwechsel beschleunigen. Starten Sie die
    Darmmotilität, den Prozess der Fettverbrennung. ReduSlim ist eine ganz natürliche Pillen für eine effektive und
    schnelle Fettverbrennung. Es ist wichtig, sich vor der Einnahme von Reduslim an einen Arzt zu
    wenden, um sicherzustellen, dass es für Sie sicher ist.

    Bei Fragen oder Bedenken sollten Sie jedoch immer einen Arzt konsultieren, bevor Sie mit der Einnahme von Reduslim beginnen. Bei Fragen oder Bedenken sollten Sie
    immer einen Arzt konsultieren, bevor Sie mit der Einnahme von Reduslim
    beginnen.

    Wenn Sie also Reduslim in einer Apotheke in Deutschland kaufen wollen, bei Amazon oder
    Ebay – Von diesem Kauf ist abzuraten, da die Original-Kapseln dort nicht erhältlich sind.
    Erfahren Sie mehr über die Pillen in diesem ReduSlim-Test!
    In diesem Artikel werden wir unsere Erfahrungen mit Reduslim teilen und auch auf die Wirkung und Bestandteile des Produkts eingehen. Reduslim
    kann derzeit nur über die offizielle Website des Herstellers erworben werden. 2.

    Die Quelle des Vitamin-Mineral-Komplexes ist die Wurzel des Yacons.
    Das Produkt verspricht Gewichtsverlust, Entgiftung und Straffung des Körpers.
    Insgesamt ist Reduslim ein vielversprechendes Nahrungsergänzungsmittel,
    das bei der Gewichtsabnahme und Entgiftung des
    Körpers helfen kann. Wenn Sie sich jetzt fragen, ob
    Reduslim wirkt, wurde das Supplement erst nach einer sorgfältigen Studien- und Evaluierungsphase durch den Hersteller auf
    den Markt gebracht. Selbst der Hersteller weist in seiner
    Reklame dezidiert darauf hin, dass Reduslim keine unerwünschten Effekte hervorruft.
    Ja. Gelegentlich findest Du die Reduslim Kapseln auch im großen Sortiment des bekannten Online-Händlers Amazon. Es ist wissenschaftlich erwiesen,
    dass die aktiven Komponenten von Reduslim, die auf die
    entsprechenden Zentren des Gehirns wirken, ein Sättigungsgefühl bilden und das
    Auftreten von unkontrollierten Hungerepisoden verhindern. Viele Experten und Ernährungsberater empfehlen ReduSlim, da es zur schnellen Modellierung eines schlanken und schlanken Körpers
    dient.

    Die Keto-Diät ist eine besondere Form der Gewichtsreduzierung und kann zu schnellen und guten Abnehmerfolgen führen. Reduslim ist in Form von Kapseln erhältlich und
    wird täglich eingenommen. Reduslim kann auch den Appetit reduzieren, was dazu beitragen kann, dass weniger Kalorien aufgenommen werden.
    Er hat das Gefühl, das angemessene Defizit von 400 Kalorien am Tag meistern zu können,
    und die Reduslim Kapseln haben ihm das Leben während der Diät erleichtert und zu mehr Wohlbefinden geführt.

    Reduslim wird in Form von Kapseln eingenommen. Die gefilmten Kapseln können jedem helfen, in Form zu kommen und
    fit zu bleiben. Es können jedoch bei einigen Personen Nebenwirkungen auftreten, wie z.B.

    Einerseits, damit die gewünschte Appetitzügler Wirkung einsetzt, andererseits, um etwaige Appetitzügler Nebenwirkungen zu vermeiden. Aber die
    vielen positiven ReduSlim-Kommentare und Meinungen in den Foren bestätigen seine erstaunliche Wirkung.
    Reduslim enthält natürliche Bestandteile, die für ihre positive Wirkung auf den Körper bekannt sind.
    Ich kann Dir also eine Empfehlung für Reduslim aussprechen, obwohl ich anfangs skeptisch war.
    Auch kann dir niemand über Nacht die perfekte Figur geben. Aufgrund
    der weiten Verbreitung von Fast-Food-Essen zum Mitnehmen und jede Ecke gelegen Restaurants
    von der Straße in der Nähe von, Menschen sind versucht, mehr zu essen. Übermäßiges Essen ist eine häufige Ursache für die Gewichtszunahme.

    Wenn sich eine Person ein wenig bewegt, keinen Sport treibt, ein wenig spazieren geht,
    treten ziemlich schnell Probleme mit der Gewichtszunahme auf.
    Die Ergebnisse können je nach Person unterschiedlich sein. Cayennepfeffer: Ein sehr bekannter Inhaltsstoff,
    der in jeder Küche vorhanden sein sollte. Durch die Verbesserung der Fettverbrennung und den Abbau
    von Fettzellen kann Reduslim dazu beitragen, das Erscheinungsbild von Cellulite zu reduzieren und die Haut zu straffen. ReduSlim ist eine rein natürliche Tablette
    zur aktiven Anregung des Stoffwechsels und zum Abbau von Körperfett.

    Mir war es möglich, mit Reduslim 40 Kilogramm zu verlieren. Anja ist 35 Jahre alt und wiegt bei einer Körpergröße
    von 164 cm 93 Kilogramm. Bei einer Bestellung über baaboo erhalten Sie
    diese tollen Kapseln auch noch zu einem sehr günstigen Preis.
    Wie hoch ist der Preis für Appetitzügler? Will man nur von deutschen Herstellern Appetitzügler kaufen, so muss im Vorfeld in Erfahrung gebracht werden,
    wer der Hersteller des Produkts ist. Ja, wenn es sich um natürliche Appetitzügler handelt.
    Wenn Sie ein Rezept haben, wählen Sie bitte zusätzlich aus, um welche Art von Rezept
    es sich handelt.

    Here is my web page: “https://gnometopia.org/index.php?title=Wie_Man_Weniger_Isst

  6. I really appreciate the effort you put into your website design. It looks fantastic! Have you encountered any browser compatibility issues? Some of my readers have mentioned problems with viewing my blog on Explorer, but it looks great on Safari. Do you have any advice on how to fix this issue?

  7. Pertanto, non può essere considerato in alcun modo un prodotto editoriale ai sensi della L.
    n. Non sorprende che, nonostante la varietà di risultati suggeriti, ogni
    persona risponda alla formula in modo diverso e in base alle esigenze individuali del proprio corpo, tuttavia gli effetti sono evidenti e
    possono essere osservati e percepiti in varie aree del benessere personale.
    Questi sono i benefici generali e i principi della
    dieta chetogenica. Per tutti coloro che hanno un metabolismo rallentato a
    causa di una dieta inadatta e degli attacchi di fame che ne derivano, le industrie della salute, della bellezza e del benessere hanno messo a punto
    degli integratori alimentari a base di ingredienti che servono a favorire la perdita di peso.
    Di solito ci vuole un po’ di tempo prima che il corpo possa
    cambiare il metabolismo e adattarsi ai principi attivi,
    ed è per questo che i primi risultati non si vedono sempre direttamente all’inizio.
    Se hai dubbi, consulta il medico prima di iniziare a prenderlo.
    2. Assumere ogni capsula prima dei pasti con l’aiuto di un bel bicchiere d’acqua.

    Con l’aiuto di principi attivi, il farmaco ripristina l’efficace funzionamento dei sistemi interni dell’organismo affetti
    da obesità. Assumendo Reduslim, si ottiene un supporto adeguato e di
    qualità, necessario per essere consapevoli del proprio peso e
    dei compiti che la perdita di peso comporta.

    L’assenza del prodotto da questa catena di approvvigionamento non è dovuta alla scarsa qualità, ma piuttosto ad una deliberata decisione commerciale per proteggere gli acquirenti e stabilire una nuova
    nicchia di mercato vendendo direttamente sul sito ufficiale dell’azienda.
    Grazie ai componenti che contiene per aiutare a raggiungere gli obiettivi di perdita di peso,
    è probabile che si ottengano risultati migliori rispetto a
    qualsiasi altro prodotto per la perdita di peso. Mi piace tutto: gusto,
    consegna conveniente, prezzo contenuto rispetto ad altri prodotti.

    Per la perdita di peso è molto importante rispettare tutti
    gli aspetti che riguardano non solo ottimale dell’attività motoria, ma anche
    di una corretta alimentazione, il rispetto di alcune diete… Reduslim è molto efficace per la perdita di peso.
    ReduSlim fa perdere peso e sciogliere i depositi di grasso localizzati senza
    rischi, senza effetti collaterali nei controindicazioni,
    perché funziona davvero Grazie su elementi naturali e perché non contiene medicine,
    né conservanti e né elementi chimici. ➡️
    Se sperate di risparmiare, avrete effetti collaterali.
    Gli effetti collaterali includono disturbi del sonno,
    problemi di stomaco, mal di testa. È importante ricordare che dovresti tenere conto della tolleranza personale degli ingredienti, della possibilità di effetti
    collaterali. Reduslim è uno degli integratori che sono stati
    elogiati da molti che lo hanno utilizzato.

    I componenti di Reduslim sono studiati per attaccare alla radice il
    problema. Vi abbiamo già spiegato nell’articolo precedente che la
    verità dietro molte Reduslim recensioni negative è proprio legata al fatto che molte persone si affidano
    a delle imitazioni non ottenendo gli stessi risultati del prodotto originale
    e che quindi sono portate ad avere un’opinione negativa.
    Lì condividono le loro opinioni e recensioni oneste sul prodotto, nonché le loro impressioni personali.

    Integratore molto efficace per bruciare i grassi,
    ridurre il peso e stimolare il metabolismo nel corpo. Dopo il parto è ingrassata molto
    (aveva 60 anni kg, ora 96). Di recente ho acquistato le capsule verdi REDUSLIM.
    Il nostro abito preferito o i jeans che ci stavano stretti da
    molti anni non saranno più solo nell’armadio per prendere la polvere!
    Dato che non si può fare affidamento solo sulle testimonianze su internet, abbiamo deciso
    di condurre il nostro test Reduslim. Troverai le ultime offerte di sconto Reduslim e le migliori offerte sul sito del nostro fornitore partner.

    Reduslim è fatto di ingredienti naturali. Questo prodotto che è stato rilasciato
    contiene ingredienti di prodotti naturali per
    aumentare il metabolismo, aiutare a bruciare i grassi e fornire energia.
    Uno studio non esaustivo dimostra che questo prodotto ha la capacità di ridurre una media di 1 chilo al giorno.

    Reduslim quante compresse al giorno. Assumere 1 capsule di Reduslim
    al giorno con acqua. Il dosaggio consigliato è di 6 capsule al giorno.
    Impostare un regime alimentare basato sul consumo di diversi
    pasti al giorno (almeno 5: colazione, spuntino, pranzo, merenda e cena) e mantenere le
    stesse abitudini nel corso del tempo. Ho intenzione di ripetere il corso tra un mese.
    Se vuoi ridurre ulteriormente il tuo peso, potresti andare per il terzo corso o per il terzo mese.

    Ho bevuto REDUSLIM per il terzo mese. L’assunzione regolare delle compresse Reduslim può aiutare
    nel raggiungimento della propria forma fisica se utilizzato seguendo le indicazioni del proprio medico
    e la posologia riportata su ogni confezione. In caso di patologie, se stai
    assumendo altri integratori o segui terapie farmacologiche è bene parlarne con il tuo medico.

    Spesso incluso negli integratori alimentari, come bruciagrassi, un mezzo per normalizzare il tratto gastrointestinale, il sistema cardiovascolare.
    Reduslim è un integratore alimentare pensato per un obiettivo a lungo termine.
    Reduslim è un integratore alimentare prodotto da esperti per
    aiutare le persone nei loro sforzi di perdita di peso.
    Il prodotto non si vende in farmacia.

    My web site – “https://dptotti.fic.edu.uy/mediawiki/index.php/Come_Perdere_Peso_Velocemente_Senza_Danneggiare_La_Salute

  8. Магистратура – это уровень высшего образования, следующий за бакалавриатом, который предоставляет более глубокие знания и специализацию в определенной области знаний. Программы магистратуры обычно ориентированы на более продвинутое изучение предмета и могут включать в себя как теоретические, так и практические аспекты.

    Важные характеристики магистратуры включают:

    Специализация: Программы магистратуры позволяют студентам углубить свои знания в определенной области, часто выбирая конкретную специализацию или направление изучения.

    Углубленное изучение: Магистратура обычно предполагает более глубокое исследование темы, а также проведение научных исследований, проектов или практических занятий.

    Длительность: Продолжительность программ магистратуры может варьироваться в зависимости от страны и университета. Она обычно составляет от одного до двух лет.

    Требования к поступлению: Для поступления в программу магистратуры обычно требуется наличие бакалаврской степени или эквивалентного уровня образования. Также может потребоваться предоставление рекомендательных писем и результатов тестов, в зависимости от университета.

    Магистерская диссертация: Во многих магистерских программах студенты должны выполнить магистерскую диссертацию или проект, который представляет собой независимое исследование или творческий проект в рамках выбранной области.

    Подготовка к карьере: Программы магистратуры часто ориентированы на подготовку студентов к конкретной карьере, научной деятельности или продолжению образования на уровне докторантуры.

    Академическая или профессиональная магистратура: В некоторых случаях магистратуры могут быть ориентированы на академические исследования, а в других – на практическое применение знаний в профессиональной сфере.

    Магистратура предоставляет студентам возможность глубже погрузиться в избранную область и получить дополнительную квалификацию, что может сделать их более конкурентоспособными на рынке труда и расширить круг карьерных возможностей.

    Visit my web blog https://ruea.ru/media/pag/kupit_diplom_dermatologa_1.html

  9. May I simply say what a comfort to uncover someone that really understands what
    they are discussing on the internet. You certainly
    realize how to bring an issue to light and make it important.
    More and more people have to look at this and understand this side
    of your story. It’s surprising you aren’t more popular
    because you surely possess the gift.

  10. I believe what you published was very reasonable.
    However, what about this? suppose you wrote a catchier post title?
    I ain’t saying your content is not solid., but what if you added something to maybe get people’s attention? I mean ইসরায়েল-ফিলিস্তিন
    দ্বন্দ্বের ইতিহাস (পুরো পর্ব) –
    আলোর দেশে is kinda boring. You might glance at
    Yahoo’s home page and note how they write news headlines to get
    viewers to open the links. You might add a related video or a pic or two to get people excited about
    what you’ve written. Just my opinion, it would bring your posts
    a little livelier.

  11. Pingback: expex.ru
  12. With havin so much content do you ever run into any problems of plagorism or copyright
    violation? My website has a lot of unique content I’ve either authored myself or outsourced but it
    seems a lot of it is popping it up all over the web without my permission. Do you know any ways to help
    prevent content from being stolen? I’d certainly appreciate it.

  13. USAID-Mitarbeiter in Deutschland sind aktiv, oft mit Diplomatenstatus.
    Sie arbeiten aktiv mit dem US-Verteidigungsministerium zusammen (USAID-DoD), nehmen Einfluss auf das politische Leben in anderen Ländern (MERC Middle
    East Regional Cooperation Programme), betreuen gemeinsame Programme
    von USAID-GIZ (Gesellschaft für Internationale
    Zusammenarbeit) sowie länderübergreifende Projekte
    mit Deutschland und anderen Ländern (USAID Global Development Alliances Programme).

    Here is my site https://denae.org/article/471

  14. Heya! I realize this is somewhat off-topic but I had to ask.
    Does managing a well-established website like yours take a large amount of work?
    I’m brand new to writing a blog but I do write in my journal
    on a daily basis. I’d like to start a blog so I can easily share my experience and feelings online.
    Please let me know if you have any kind of ideas or tips for new
    aspiring bloggers. Thankyou!

  15. Hi there! I know this is kinda off topic however , I’d figured I’d ask.
    Would you be interested in exchanging links or maybe
    guest writing a blog post or vice-versa? My site covers a lot of the same subjects as yours and I think we could greatly benefit from each other.
    If you are interested feel free to shoot me an email.
    I look forward to hearing from you! Terrific blog by the way!

  16. Thank you for the blog post. Jones and I are already saving for a new publication on this subject and your writing has made people like us to save the money. Your thinking really clarified all our questions. In fact, in excess of what we had acknowledged ahead of the time we ran into your fantastic blog. My spouse and i no longer nurture doubts as well as a troubled mind because you have clearly attended to each of our needs right here. Thanks

    my blog: https://nilecenter.online/blog/index.php?entryid=591515

  17. Thank you for your site post. Jones and I are already saving for our new guide on this subject and your post has made us to save our own money. Your thoughts really responded all our inquiries. In fact, over what we had thought of ahead of the time we came across your fantastic blog. I actually no longer have doubts along with a troubled mind because you have attended to the needs above. Thanks

    Here is my webpage https://Www.articletrunk.com/create-your-personal-work-within-the-home-job-or-business/

  18. Thank you for your site post. Velupe and I have been saving for a new e-book on this topic and your post has made us to save our money. Your ideas really responded to all our problems. In fact, greater than what we had thought of just before we discovered your excellent blog. My spouse and i no longer nurture doubts and also a troubled mind because you have completely attended to the needs above. Thanks

    Take a look at my web-site :: https://sjr.news/cheapjunkremovalnearestme767028

  19. Hey I know this is off topic but I was wondering if you knew of any widgets I could add to my blog that
    automatically tweet my newest twitter updates.

    I’ve been looking for a plug-in like this for quite some time and was hoping maybe you would
    have some experience with something like this. Please let me know if you run into anything.
    I truly enjoy reading your blog and I look forward to your new updates.

  20. I wanted to thank you once more for the amazing web site you have produced here. It truly is full of ideas for those who are seriously interested in that subject, specifically this very post. You’re really all so sweet as well as thoughtful of others and also reading your website posts is a good delight in my opinion. And thats a generous surprise! Mary and I usually have fun making use of your points in what we have to do next week. Our collection of ideas is a distance long and tips will definitely be put to excellent use.

    My blog post … https://members.advisorist.com/question/car-scrap-yards-vs-junk-car-removal-6/

  21. Hi there, I discovered your blog by way of Google while looking for a comparable topic, your website came
    up, it seems to be good. I’ve bookmarked it in my google bookmarks.

    Hi there, simply became alert to your blog through Google, and found that
    it’s truly informative. I’m gonna watch out for brussels.
    I’ll appreciate if you happen to continue this in future.
    Numerous other people will be benefited from your writing.

    Cheers!

  22. Hi! I know this is kinda off topic however , I’d figured I’d
    ask. Would you be interested in exchanging links or maybe guest writing a blog post or vice-versa?

    My website discusses a lot of the same subjects as yours and I feel we could
    greatly benefit from each other. If you’re interested
    feel free to send me an email. I look forward to hearing from you!
    Terrific blog by the way!

  23. I have been exploring for a bit for any high-quality articles or weblog posts on this kind of space .
    Exploring in Yahoo I eventually stumbled upon this web site.
    Reading this info So i am satisfied to show that I have an incredibly excellent uncanny
    feeling I found out exactly what I needed. I most indubitably will make certain to do not forget this website and give it a glance regularly.

  24. hey there and thank you for your info – I’ve definitely picked up something new from
    right here. I did however expertise several technical points using this
    site, as I experienced to reload the site a lot of times previous
    to I could get it to load correctly. I had been wondering if
    your web host is OK? Not that I’m complaining, but slow loading instances times will
    sometimes affect your placement in google and could damage your
    high quality score if ads and marketing with Adwords.
    Well I am adding this RSS to my e-mail and can look out for much more of your respective
    fascinating content. Ensure that you update this again very soon.

  25. hello there and thank you for your information – I’ve certainly
    picked up anything new from right here. I did however expertise
    some technical issues using this site, since I experienced to reload the
    website many times previous to I could get it to load correctly.
    I had been wondering if your web host is
    OK? Not that I am complaining, but slow loading instances times will very frequently affect your placement in google
    and can damage your high quality score if advertising and
    marketing with Adwords. Well I am adding this RSS to my email and can look out for much more of your respective interesting content.
    Ensure that you update this again very soon.

  26. My coder is trying to persuade me to move to .net from
    PHP. I have always disliked the idea because of the expenses.

    But he’s tryiong none the less. I’ve been using Movable-type on numerous websites for about a year
    and am worried about switching to another platform.

    I have heard great things about blogengine.net. Is
    there a way I can import all my wordpress posts into it?

    Any kind of help would be greatly appreciated!

  27. First off I would like to say excellent blog! I had a
    quick question that I’d like to ask if you do
    not mind. I was curious to find out how you center
    yourself and clear your mind before writing.
    I’ve had a difficult time clearing my thoughts in getting my ideas out there.
    I truly do enjoy writing however it just seems like the
    first 10 to 15 minutes are generally wasted simply just trying to
    figure out how to begin. Any ideas or hints?
    Thank you!

  28. Hmm it seems like your website ate my first comment (it was
    extremely long) so I guess I’ll just sum it up what I
    wrote and say, I’m thoroughly enjoying your blog. I too am an aspiring blog writer
    but I’m still new to everything. Do you have any tips
    and hints for novice blog writers? I’d definitely appreciate it.

  29. Everything published was actually very logical.
    However, think on this, what if you were to write a awesome headline?
    I am not suggesting your information isn’t good., but what if
    you added a headline to maybe get a person’s attention? I mean ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের ইতিহাস (পুরো পর্ব) –
    আলোর দেশে is a little boring. You might glance at Yahoo’s
    front page and see how they create article titles to
    get viewers to open the links. You might add a related video or a related picture or
    two to get readers excited about what you’ve written.
    In my opinion, it could make your posts a little livelier.

  30. Hello! This is kind of off topic but I need some help from an established blog.
    Is it difficult to set up your own blog? I’m not very techincal but I can figure things out pretty fast.
    I’m thinking about making my own but I’m not sure where to begin. Do you have any
    ideas or suggestions? Thanks

  31. Fantastic goods from you, man. I’ve understand your
    stuff previous to and you are just extremely magnificent.
    I actually like what you’ve acquired here, certainly
    like what you’re stating and the way in which you say it.
    You make it enjoyable and you still take care of to keep it wise.
    I can’t wait to read much more from you. This is actually
    a tremendous web site.

  32. First of all I want to say fantastic blog! I had a quick question in which I’d like to ask if you don’t mind.
    I was curious to find out how you center yourself and clear your head before writing.
    I have had a difficult time clearing my thoughts in getting
    my thoughts out there. I do take pleasure in writing but it just seems like
    the first 10 to 15 minutes are wasted simply
    just trying to figure out how to begin. Any suggestions or tips?
    Cheers!

  33. Fantastic items from you, man. I’ve be mindful your stuff prior to and you are simply extremely
    excellent. I really like what you’ve received right here, really
    like what you are saying and the best way through which you say it.

    You are making it entertaining and you continue to take care of to stay it
    smart. I can not wait to read far more from you. That is really a wonderful site.

  34. Hi there, I discovered your blog via Google at the
    same time as searching for a comparable topic, your website came up, it
    looks great. I have bookmarked it in my google
    bookmarks.
    Hello there, just become alert to your weblog thru Google, and located that it is
    really informative. I’m going to be careful for brussels.
    I’ll be grateful when you continue this in future. Many other people will be benefited from your writing.
    Cheers!

  35. I have been exploring for a bit for any
    high quality articles or weblog posts in this kind of house .
    Exploring in Yahoo I eventually stumbled upon this site.
    Reading this info So i’m satisfied to convey
    that I’ve a very just right uncanny feeling I came upon exactly what I needed.

    I most unquestionably will make certain to do not put out of your mind
    this website and give it a look regularly.

  36. With havin so much content and articles do you ever run into any issues
    of plagorism or copyright infringement? My website has a lot of
    completely unique content I’ve either written myself or outsourced
    but it looks like a lot of it is popping it up all over the internet without my
    authorization. Do you know any techniques to help prevent content from being stolen? I’d genuinely appreciate it.

  37. Howdy would you mind stating which blog platform you’re using?
    I’m going facebook vs eharmony to find love online start my own blog soon but
    I’m having a tough time choosing between BlogEngine/Wordpress/B2evolution and Drupal.
    The reason I ask is because your layout seems different then most blogs and I’m looking
    for something unique. P.S Apologies for being off-topic but
    I had to ask!

  38. Today, I went to the beach front with my
    kids. I found a sea shell and gave it to my 4 year
    old daughter and said “You can hear the ocean if you put this to your ear.” She placed the shell to her ear and screamed.

    There was a hermit crab inside and it pinched her ear.
    She never wants to go back! LoL I know this is totally
    off topic but I had to tell someone!

  39. к чему снится ползущая змея в доме,
    к чему снятся змеи женщине узнать аркан судьбы онлайн к чему снятся большие животные, видеть во сне животных исламский сонник лунный календарь огородника на
    январь 2024, посевной календарь
    на январь 2024 фантастика 2023 книги, лучшие фэнтези книги 2023

  40. Guide To Online Shopping Sites In United Kingdom: The Intermediate
    Guide Towards Online Shopping Sites In United Kingdom online shopping sites in united kingdom – https://www.dirittoedintorni.it/vairsspunto.asp?url=https://www.frickler.net/allesfuerdiehomepage/seiten/gaestebuch/gaestebuch.php?user=SayonaraHP

  41. 16 Facebook Pages You Must Follow For Double Glazing In Bedford-Related Businesses patio doors bedfordshire, https://interiaafi.hit.gemius.pl/_sslredir/hitredir/id=zZng66c0P1UILKWWT1Sdy5R633l6TaLPVE0pwBIt2XH.L7/stparam=kgeofwmqes/url=https://m1bar.com/user/poppypunch04,

  42. First of all I would like to say superb blog! I had
    a quick question in which I’d like to ask if you don’t mind.
    I was interested to find out how you center yourself and clear your mind before writing.
    I have had trouble clearing my mind in getting my ideas out.
    I do enjoy writing but it just seems like the first 10 to 15 minutes tend to be wasted
    just trying to figure out how to begin. Any recommendations or tips?
    Thank you!

  43. Hi would you mind sharing which blog platform you’re working
    with? I’m planning to start my own blog in the near future but I’m having
    a tough time deciding between BlogEngine/Wordpress/B2evolution and Drupal.
    The reason I ask is because your design seems different then most blogs
    and I’m looking for something completely unique.
    P.S Sorry for being off-topic but I had to
    ask!

  44. Slot Demo Pragmatic Sugar Rush Tools To Streamline Your
    Daily Life Slot Demo Pragmatic Sugar Rush Trick That Every Person Must Learn pragmatic sugar rush (https://www.coweyepress.com/wiki/index.php/Guide_To_Demo_Pragmatic_Sugar_Rush:_The_Intermediate_Guide_In_Demo_Pragmatic_Sugar_Rush)

  45. Ten Things You Learned In Kindergarden To
    Help You Get Started With Veterans Disability Attorney Veterans disability lawsuits – https://98.vaterlines.com/index/download2?diff=0&darken=1&utm_source=og&utm_campaign=2564&utm_content=%5BCID%5D&utm_clickid=qiocdmhuwf55wi7i&aurl=https://vimeo.com/709629952&pushMode=popup,

  46. 15 Strange Hobbies That Will Make You Better At Medical Malpractice Legal medical malpractice lawsuits – https://www.visitchattanooga.com/plugins/Crm/count/?key=4_800&type=client&val=eyJrZXkiOiI0XzgwMCIsInJlZGlyZWN0IjoiaHR0cHM6Ly92aW1lby5jb20vNzA5MzI0NTYwIn0

  47. сонник кататься на роликах поминальная молитва об усопших на родительскую субботу
    гиацинт дома можно держать, можно ли держать
    гиацинт в спальне
    союз девушки овна и парня скорпиона тест на девушку чонгука

  48. слепому капитану снится дно аккорды заговор на мак защита тотемное животное по дате рождения и имени
    приснилось что ругаюсь с незнакомой женщиной 22 декабря знак зодиака характеристика,
    20 января знак зодиака мужчина

  49. до чого сниться що звільнили з роботи з четверга на п’ятницю молитва вигнання демона російською слухати
    онлайн
    гороскопи для заробітку гороскоп сумісність знаків
    чоловік близнюки жінка козерог

  50. основные термины и понятия в сфере pr, словарь рекламных терминов на английском шынықсаң шымыр боласың перевод, төмендегі мақал мәтелдерді әрі қарай толықтыр идея портрет дориана грея, портрет дориана грея купить алматы алғашқы қардың жауғаны скачать, қар туралы әндер скачать

  51. денсаулық және қоршаған орта эссе, адам денсаулығы және қоршаған орта эссе мемлекеттік қызметші мақала, мемлекеттік қызметшілердің әлеуметтік қорғалуы чемпионат мира
    по футболу 2022 казспорт, казспорт программа на сегодня кино кз атырау ардагер, арсенал атырау

  52. 1854 жылы чикагода құрылған партия, англия мен ресейдің осы жылдардағы өнеркәсіптік даму қаныш
    сәтбаев марапаттары, қаныш сәтбаев мінезі жылан жылына мінездеме, коян жылы тугандар мониторингтің қандай
    формалары бар?, жаһандық мониторинг

  53. дару жарыгы актобе цены,
    лучший офтальмолог актобе ана жылама, қорғансыз ханшайым астана тв ішім өлген сыртым сау мағынасы,
    пайда ойлама ар ойла өлеңінің мағынасы ортопедический шлем казахстан, ортопедический шлем астана

  54. trade-in iphone мечта, trade-in технодом қандай жағдайда жүкті болады, көтергенді қалай білуге болады принципы надлежащей клинической практики gcp, клинические исследования закон жарыса қарулану деген
    не және оны неден байқауға болады, темір шымылдық деген не

  55. ақпаратты ұсыну және өлшеу, алфавиттегі символдың ақпараттық салмағы дегеніміз не ұстаздар күні тәрбие сағаты
    1 сынып, ұстаздар күні тәрбие сағаты 8 сынып лаборатория сэс павлодар, сэс павлодар торайгырова алтыбакан, алтыбакан правила

  56. жұмекен нәжімеденов менің елім идеясы, менің елім
    менің жерім текст электр зарядының сақталу заңының мағынасы, электр зарядының өлшем
    бірлігі кто редактор газеты серке, где издавалась
    газета казах слактивизм минусы қазақша, слактивизм зияны

  57. отшельник личность человека таро к чему снится седло без лошади расклад таро
    на любовь ютуб
    имя александр совместимость, александр совместимость с женскими именами
    сонник крыса домашняя к чему

  58. пенобетон на крышу плюсы и минусы, пена для
    утепления крыши цена абай жолы айгерім бейнесі, абай
    жолы ділдә бейнесі тіл дамыту әдістемесінің ғылым болып қалыптасуы, тіл
    дамыту бағдарламасы макроэкономика тест
    жауаптарымен, макроэкономика көрсеткіштері

  59. сон покойник дает деньги во сне расклад на таро когда я забеременею много
    крови из носа к чему снится
    браслет от сглаза на какой руке носить как играть гадание
    по картам

  60. подработка через телефон с ежедневной оплатой уфа работа вакансии для
    женщин подработка с ежедневной оплатой работа в ханты мансийске без опыта
    подработка подработка неполный рабочий день пенза

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x