শিল্পিত পারু ।।
আলেকজান্ডার হচ্ছেন পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী যোদ্ধা। মাত্র ৩২ বছর বয়সে যিনি পৃথিবীর অর্ধেকটাই দখল করে ফেলেছিল। গ্রিস থেকে ভারতের পাঞ্জাব দখলে তিনি একটি যুদ্ধেও হারেনি। ইতিহাসের এই পরাক্রমশালী যোদ্ধার কথা মানুষ দুই হাজার বছর পরও মনে রেখেছে। সবাই তাকে চেনে আলেকজান্ডার, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট নামে ।
পুরোধারাবাহিক জুড়ে আমরা নজর দেবো আলেকজান্ডারের জন্ম, মৃত্যু, শিক্ষা, প্রেম এবং যুদ্ধসহ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর দিকে। আজ দ্বাদশ কিস্তিতে নজর দেয়া যাক আলেকজান্ডারের বিশেষ কিছু চমকপ্রদ ঘটনার দিকে
পর্ব : ১২
১. আলেকজান্ডারের দুই চোখের রং ছিল দুই রকম। তার একটা চোখ ছিল কালো অন্ধকার আর একট ছিল আকাশের মতো নীল । এটাকে বলা হয় ‘হেডারোক্রোমিয়াম ইরোডাস’। পৃথিবীতে এক হাজার জন মানুষের মধ্যে মাত্র ৬ জনের এমনটা হয়ে থাকে ।
২.আলেকজেন্ডারের ঘোড়ার নাম ছিল বুসেফেলিস। প্রাচীন গ্রিকে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল প্রানীটি। ৩২৬ খ্রি.পূ হাইডোসপিসের যুদ্ধে মারা যায়। মৃত্যু আগ পর্যন্ত সকল যুদ্ধে ঘোড়াটি তার সাথে ছিল। এ নিয়ে একটি মিথ চালু আছে।
যখন এই ঘোড়াটি তার বাবা কিনতে যায় তখন কেউ ঘোড়াটিকে কেউ সামলাতে পারছিল না। কিন্তু কিশোর আলেকজান্ডার বুঝতে পারছিলেন কি সমস্যা। তাই তার বাবার সাথে বাজি ধরেছিল যে সে ঘোড়াটিকে বশে আনতে পারবে। বাবাও রাজি হলেন। আলেকজান্ডার দেখলেন ঘোড়াটি তার নিজের ছায়াকে ভয় পাচ্ছে, সে ঘোড়ার মাথাটি সূর্য থেকে ঘুরিয়ে দিলেন যাতে ছায়া দেখা না যায়। এরপর ঘোড়ার পিঠে চলে আলেকজান্ডার দৌড়াতে থাকেন। ঘোড়ার নাম রাখেন বুসেফেলিস যা অর্থ ষাড়ের মাথা।
৩. বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটল তার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন ও আর সে সময়ের আরেক বিখ্যাত দার্শনিক ডায়াজিনাসের সাথে তাদের সাক্ষাতের কথোপোকথন এখনও বিখ্যাত হয়ে আছে।
এই জ্ঞানী ছিলেন আরাম-আয়েশ আর পার্থিব বস্তু বিবর্জিত। তিনি একটি পিপার মধ্যে থাকতেন, তার একটি থালা, একটি আলখাল্লা আর একটি মাত্র লাঠি ছিল সম্বল ।
অথেন্স জয়ের পর আলেকজেন্ডার এই জ্ঞানী মানুষটিকে দেখতে এসে বলেছিলেন, ‘আমি কি করতে পারি আপনার জন্য ? ডায়াজিনাস স্পষ্ট এবং তৎক্ষনাৎ বলেছিলেন ‘আপতত একটু সরে দাঁড়াও যাতে রোদটুকু আমার কাছে আসতে পারে, কারন তুমি আমাকে যা দিতে পারো না তা থেকে আমাকে বঞ্চিত করতে পারো না’ ।
আশেপাশের অনেকে এ নিয়ে ঠাট্টা করলে আলেকজেন্ডার বলেছিলেন’ আমি যদি আলেকজেন্ডার না হতাম তবে আমি ডায়াজোনিস হতাম’। এটা শোনার পর দার্শনিক অবশ্য বলেছিলেন অন্যভাবে ‘আমি যদি ডায়াজনিস না হতাম তাহলে আমিও ডায়াজিনাস হতে চাইতাম’।
৪. আলেকজান্ডারের নামে ৭০ টি শহরের নামকরন করা হয়েছিল। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় তাকে সমাহিত করা হয়। তার প্রিয় ঘোড়া বুসেফেলিসের নামেও কয়েকটি শহরের নামকরন হয়েছিল। এখনও পাকিস্তানে এই নামে একটি শহর আছে বলে জানা যায় ।
৫. আলেকজান্ডার প্রথম ইউরোপিয়ান যিনি এশিয়া দখল করেছিলেন এবং এত বড় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পেরেছিলেন। একমাত্র আলেকজান্ডারই ১৫ বছরে একটি যুদ্ধেও হারেনি ।
৬ এশিয়া মাইনর বা আজকের তুরস্কের একট দেশ ছিল ‘গরডিয়ন’। আর সেই দেশে কোন রাজা ছিল না। একটা ষাড়ের গাড়িতে একটি জোয়ালের রশি জটিল গেরো দিয়ে বাধা ছিল। প্রচলিত ছিল যে এই জটিল গেরো কেউ খুলতে পারবে না। তবে যদি কেউ খুলতে পারে সেই হবে এই দেশের রাজা এবং সে পুরো এশিয়া শাসন করবে । আলেকজেন্ডার এটা শোনার পর তরবারি বের করে এক কোপে কেটে দুটুকরো করে ফেলে সেই গেরো ।
এর পর থেকে আপাতভাবে খুব জটিল দেখতে কোন একটি সমস্যার সমাধান যদি মুহুর্তেই খুব জোরের সাথে সহজভাবে কেউ দিয়ে দেয় তাকে বলে ‘গরডিয়ান নট’। ইংরেজি সাহিত্যে রুপক হিসেবে খুব ব্যবহৃত হয় এই ‘গরডিয়ন নট’। শেক্সপিয়ারও এটি ব্যবহার করেছেন তার সাহিত্যে ।
৭. মা অলিম্পিয়াস দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন আলেকজান্ডার। দেশ জয়ে বের হবার পর সেই মায়ের সাথে তার আর কখনো দেখা হয়নি। আলেকজেন্ডার যখন ভারত অভিযান ব্যর্থ হয়ে ব্যবিলনে ফেরেন তখন মা ছিলেন ম্যসিডোনিয়ায়। তাকে আনতে চেয়েছিলেন ব্যবিলনে তবে তার আসার আগেই মারা যান আলেকজান্ডার ।
৮. বাবার হত্যার পিছনে তার মা অলিম্পাস অথবা আলেকজান্ডার নিজে জড়িত ছিল বলে অনেকে ধারণা করেন। যদিও এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না । তবে মায়ের সকল কাজ ও কর্মে এটি অস্বাভাবিক বলে মনেও হয়না অনেকের ।
৯. ইসলাম ধর্মে এক পরাক্রমশালী বাদশার নাম বলা আছে তিনি হলেন ‘জুলকারনাইন’। অনেকের মতে আলেকজান্ডারই জুলকারনাইন। মধ্যপ্রাচ্য তাকে বলে ‘ইস্কানদার’ আর ভারতে এসে সেই নাম হয়ে গেছে ‘সিকান্দার’। ইতিহাসের জুলকারনাইন, ইস্কানদার, সিকান্দার ও আলেকজান্ডার আসলে একই ব্যক্তি বলে মনে করেন অনেকে । আবার আলেকজান্ডার জুলকারনাইন নন বলেও বিশ্বাস আছে মুসলমানদের মধ্যে ।
১০. আলেকজান্ডারকে আলেকজান্দ্রিয়ায় সমাহিত করেছিল তার সহযোদ্ধা বন্ধু টলেমি। কিন্তু কোথায় তাকে দাফন করা হয়েছে তা কেউ জানেনা। আলেকজান্দ্রিয়ায় কোথায় শুয়ে আছে তা আজো এ অমীমাংসিত রহস্য ।
(চলবে….)
শিল্পিত পারু
কবি ও লেখক
শিল্পিত পারু
কবি ও লেখক
আলেকজান্ডারের অন্যান্য পর্ব :