পারভেজ সেলিম
(পর্ব : ০৯)
সাল ১৯৮৪ । মে মাস
সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। পাঞ্জাবের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন ভিন্দ্রানওয়ালের হাতে। স্বর্নমন্দির তার হেডকোয়ার্টার।
মন্দিরের ভিতরে অনেক অস্ত্রশস্ত্র জড়ো করেছেন ভিন্দ্রানওয়ালের সমর্থকরা।
কখন কার মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হচ্ছে তার ঠিক নেই। আকাল তখতে বসে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন একজন, তিনি হলেন জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে।
গান্ধী সরকার কয়েকবার আত্নসমর্পণ করানোর চেষ্টা করলেও কোন কর্নপাত করেননি এই প্রভাবশালী শিখ সাধু। পাঞ্জাবের আইনশৃংখলার পরিস্থিতি সেসময় খুব নাজুক অবস্থায় চলে গিয়েছিল।
কেন্দ্রিয় সরকার এবার কঠিন শক্তিপ্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাবাহিনী প্রযোগ করে ভিন্দ্রানওয়ালে ও খালিস্তান বিদ্রোহী মুক্ত করতে চায় স্বর্নমন্দিরকে। স্পর্শকাতর এই সিদ্ধান্ত ছিল ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ঝুকিপূর্ন সিদ্ধান্ত।
শিখদের স্বর্নমন্দিরে সেনা অভিযানের যে সিদ্ধান্ত নেবার পর, শুধু ইন্দিরা গান্ধির জীবন নয়, পুরো ভারতের রাজনীতির ইতিহাসই বদলে গিয়েছিল। ইতিহাস বদলে দেয়া এই অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন ব্লু স্টার’।
ইন্দিরা কেন এমন নৃশংস অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলেন?
১৯৮৪ সালের মে মাসের উপনির্বাচনে ভরাডুবি হয় কংগ্রেসের। কংগ্রেসের হেরে যাওয়া অনেক আসনের মধ্যে একটি ছিল লক্ষৌয়ের কাছের মালিহাবাদ আসনটি। এটিতে জয়ী পায় শাশুড়ি বউ এর দ্বন্দে কিছুদিন আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া মানেকা গান্ধীর ‘রাষ্ট্রীয় সঞ্জয় মঞ্চ’।
ছোট ছেলে সঞ্জয়ের মৃত্যু পর উচ্চাবিলাসী মানেকার সাথে শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধির সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, বাড়ি ছেড়ে দিয়ে হয়ে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দী হিসেবে মাঠের রাজনীতিতে নামেন এবং জয় লাভ করেন।
সেই মানেকা পরের বছর (১৯৮৫) সাধারণ নির্বাচনে আমেঠি থেকে দাঁড়াবেন বলে ঘোষণা দেন। এই আসন থেকে ইন্দিরার প্রিয় পুত্র রাজিব গান্ধির দাঁড়ানোর কথা রয়েছে।
মালিহাবাদে পরাজয় , মানেকার ঘোষণা এবং ছেলে রাজিবের রাজনীতির ভবিষ্যৎ ইন্দিরা গান্ধিকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল বলে ধারণা করা হয়।
যে ভিন্ড্রানওয়ালে, জঙ্গিবাদ এবং খালিস্তান আন্দোলনকে জিইয়ে রেখেছিলেন নিজের রাজনীতির ফায়দার জন্য সেটাকে এবার বিসর্জন দিতে চান ইন্দিরা।
বিদ্রোহীদের সাথে প্রথমে আলোচনার জন্য নরসিমা রাও কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা ভেস্তে যায় । জুন
চন্ডিগড়কে পাঞ্জাবকে দিয়ে দেবার শর্তে , আকালী দলকে ‘ধর্মযুদ্ধ মোর্চা’ তুলে নিতে চাপ দেয়া হয়। আবোহার শহরটি হরিয়ানাকে দিয়ে দেয়া হবে শর্তজুড়ে দেয়া হয়েএর সাথে। দ্রুত একটা কমিশন গঠনের প্রতশ্রুতিও দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
আকালী দল প্রথমে না না করলেও পরে রাজি হয়, কারণ ‘ভিন্ড্রানওয়ালে সংকট’ তখন তাদেরকেও আষ্টেপিষ্টে বেধে ফেলেছিল।
ভিন্ড্রানওয়ালের কাছে এসব প্রস্তাব নিয়ে যান ‘শিরোমনি গুরুদুয়ারা প্রবন্ধক কমিটি’র প্রধান গুরুচরণ সিং তোহরা।
প্রস্তাব শুনে জার্নেইল সিং অপমান করে তোহরাকে। ইন্দিরার দালাল ও মুখ্যমন্ত্রী হবার লোভে এসব করছে বলে তিরস্কার করেন। ‘আনন্দপুর রেজুলেশন’ পুরোপুরি মেনে নেয়াই একমাত্র সমাধান বলে সাফ জানিয়ে দেন ভিন্ড্রানওয়ালে ।
সরকারের প্রস্তাবে রাজি স্বর্নমন্দির থেকে তাদের বের করে দেবে সরকার এমন হুমকি দেন তোহরা। তাতেও কোন কর্নপাত করেন না খালিস্তানের স্বপ্নে বিভোর বিদ্রোহীদের প্রধান। আলোচনার সকল চেষ্টা ভেস্তে যায়।
ইন্দিরা গান্ধী এবার খুবই স্পর্শকাতর এক সিদ্ধান্ত নেন। শিখ স্বর্ণমন্দিরে সেনাবাহিনী পাঠানোর নির্দেশে স্বাক্ষর করেন ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রী।
৩১ মে, ১৯৮৪ সন্ধে বেলা।
মীরেটে নিজের বাংলোতে ব্যাগ গোছাচ্ছিলেন মেজর জেনারেল কুলদীপ সিং ব্রার। পরেরদিন পুরো পরিবার সহ ছুটি কাটতে যাবার পরিকল্পনা ম্যানিলায়।
হঠাৎ ফোন ওয়েস্ট কমান্ডার হেডকোয়াটার থেকে। আগামীকাল চন্ডিগড়ে একগুরুত্বপুর্ন মিটিং এ তাকে উপস্থিত থাকতে হবে। মিটিং এর ইস্যু ‘অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা’ সংক্রান্ত আলোচনা।
স্ত্রীকে দিল্লী পাঠিয়ে দিয়ে কুলদীপ সিং রওয়ানা দিলেন চন্ডিগড়ের দিকে। মিটিংএ সেনার বড় কর্তারা তাকে জানান প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি অমৃতস্বরের স্বর্নমন্দির ও পাঞ্জাবে গুরোদুয়ারগুলো ‘খালিস্তান জঙ্গি’দের কবল থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করেছেন।
স্বর্নমন্দির অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মেজর জেনারেল কুলদিপ সিং ব্রারকে। তেসরা জুন থেকে এই অপাররেশ শুরু হবে। অভিযানের কোড নেম ‘অপারেশন ব্লু স্টার’।
শুরু ইতিহাস বদলে দেয়া স্বর্নমন্দিরে সেনা অভিযান ।
অপারেশনের পরিকল্পনা চলাকালিন সময় ১ জুন স্বর্নমন্দির চত্তরে অধাসামরিক বাহিনী সিআরপিএফ সাথে গুলিবিনিময় হয় খালিস্তান পন্থীদের। সাড়ে বারোটা থেকে শুরু হয়ে চলে সাতটা পর্যন্ত। নিহত হয় ১১ জন জঙ্গী।
পরের দিন গোটা পাঞ্জাবজুড়ে সংসিহতা ছড়িয়ে পড়ে। মারা যায় আরো ১২ জন।
২ তারিখে ইন্দিরা গান্ধি ভাষণ দেন রাষ্ট্রীয় টিভিতে। তার আগে স্বরস্বতী বন্দনা ও ‘সাঁরা জাহা সে আচ্ছা’ সঙ্গীত বাজানো হয় সরকারি প্রচার মাধ্যমগুলোতে।
ভাষণে আকালী দলের সব দাবি মানলেও তারা নতুন নতুন দাবি জানাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। তারা মুলত খালিস্তানি জঙ্গিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এমন অভিযোগ আনেন। এটা আর চলতে দেয়া হবে না বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন ইন্দিরা গান্ধি।
পরের দিন ৩ জুন সেনারা মন্দির চত্তরের বাহিরে অবস্থান দেয়। সেই দিন ছিল শিখদের ধর্মীর গুরু অর্জুন সিং এর জন্মোৎসবের আনুষ্টানিকতা। কার্ফু কিছুক্ষণের জন্য তুলে নেয়া হয় যাতে তীর্থ যাত্রীরা গুরু অর্জুন সিং এর জন্মোৎসব পালন করতে পারে। এই সুয়োগে কয়েকশ জঙ্গি ছদ্দবেশে স্বর্নমন্দির হতে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।
অপারেশন শুরু আগে কুলদীপ সিং ঘোষণা করেন ‘এই লড়াই শিখদের বিরুদ্ধে নয়, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে। তারপরও কারো যদি ধর্মবিশ্বাসের উপর আঘাত লাগে ,সে যেন এই অপারেশন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন’।
তার এমন বক্তব্যের পরও কোন শিখ সৈন্য বা সাধারণ অফিসার নিজেকে সরিয়ে নেননি ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ হতে।
এরপর পাঞ্জাবের সকল সাংবাদিকদের সরিয়ে নেয়া হয় হরিয়ানায়।
অপারেশন শুরু :
৪ জুন, ১৯৮৪। ভোর পাঁচটায় শুরু হয় ‘অপারেশন ব্লুস্টারে’র প্রথম ফায়ারিং।
পাঁচঘন্টা ধরে প্রথম দিনের গোলাগুলি চলে। স্বর্নমন্দিরের প্রবেশদ্বার যে এত শক্তিশালী হবে তা সেনারা কল্পনাও করতে পারেনি। গোয়েন্দা রিপোর্ট ভয়ানক ভাবে ব্যর্থ হয় জঙ্গিদের শক্তির ব্যাপারে। প্রথমদিনেই ১০০ সেনা সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
স্বর্নমন্দিরে চারিদিকের ১৭ টি বিল্ডিং এ কয়েক স্তরে খালিস্তান বিদ্রোহীরা প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করেছিল। মেজর জেনারেল শাহবাগ সিং ছিলেন ভিন্দ্রানওয়ালের প্রধান সমারিক উপদেষ্টা। তিনি ছিলেন এমন দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষার মুল পরিকল্পনাকারী।
এই শাহবাগ সিং এর নাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে আছে । ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। পরে তিনি ভিন্ড্রানওয়ালের খালিস্তান আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন এবং প্রধান সামরিক কর্তাব্যক্তি হয়ে ওঠেন।
দুইদিন ধরে ব্যাপক সংঘর্ষ আর প্রানহানির পরও অপারেশনে সফলতা পান না ভারতীয় সেনারা। শেষে বন্দুক আর মর্টার শেলে কাজ না হওয়ায় কমান্ডো অপারেশন শুরু করে সেনাবাহিনী। তাতেও ব্যর্থ হয় কুলদীপ সিং। শুধু তার সৈন্যদের প্রাণ যেতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত স্বর্নমন্দিরে ট্যাংক ঢোকার অনুমতি প্রাথর্না করে অপনারেশন প্রধান। দুই ঘন্টা পর অনুমতি পায়। শুরু হয় সব শেষ যুদ্ধ।
৬ তারিখ সন্ধ্যায় স্বর্নমন্দির চত্ত্বরের দখল নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। রাতে আকাল তখতের ভিতর ঢুকে ভিন্দ্রাণওয়ালে ও শাহবাগ সিং এর মৃতদেহ আবিস্কার করেন সেনারা। তখনও বিল্ডিংগুলোতে জঙ্গিদের সাথে সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলছিল।
সরকারী ভাষ্য অনুয়ায়ী ৮৩ জন সেনা, ৫৫৪ জন শিখ বিদ্রোহী ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়। বেসরকারী হিসেব বলছে ৭০০ সেনা আর ৩০০০ জঙ্গি ও সাধারণ মানুষের প্রাণ যায় ‘অপারেশন ব্লু স্টারে’।
অপারেশন শুরু হয় ১ জুন আর পুরোপুরি শেষ হয় দশই জুন। প্রথম গুলি ছোড়ে ৪ জুন ভোর পাঁচটায়। সেনাবাহিনী স্বর্নমন্দির উদ্ধার করে ষাট ঘন্টা পর, ছয় তারিখ সন্ধ্যে ছয়টায়। এরপরের কয়েকদিন আশেপাশের বিল্ডিংগুলো থেকে বিদ্রোহীমুক্ত করে ।
অপারেশনে সহযোদ্ধাদের সাথেউ নিহত হন জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে। বহু প্রাণের বিনিময়ে শেষ হয় শিখ ইতিহাসের একটি মাত্র অধ্যায়ের। ‘অপারেশন ব্লু স্টার’কেই খালিস্তান আন্দোলনের পরিসমাপ্তি বলে ধরে নেয় অনেকে।
কিন্তু গল্পের শেষ এখনই নয়। সামনে আরো এত ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে তা কেন জানতো !
(চলবে..)
পারভেজ সেলিম
লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী
Romance Italian Cafe Ambience
I’ve perused a number of exceptional articles on this site. It’s definitely worth saving for future visits. I’m curious about the tremendous effort you’ve invested in crafting such an informative and outstanding website. I’ll certainly be returning. By the way I am a Senior Researcher at Clickmen™ Social, a Social Media Marketing (SMM) Platform providing services throughout European Union, United States & Canada.
yasam ayavefe best man
Thanks for sharing your knowledge on this topic. It’s much appreciated.