গুরু নানক: যার হাতে নতুন ধর্মের শুরু


পারভেজ সেলিম


 (পর্ব : ০২)

ভারতবর্ষ তখন মুসলমানদের দখলে। প্রায় আইড়শো বছর ধরে এ অঞ্চলের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের মানুষেরা শাসিত হচ্ছে মুসলমানদের দ্বারা।

এমন সময় ১৪৬৯ সালে তালওয়ান্ডি নামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন এক শিশু। বর্তমানে স্থানটি পাকিস্তানের নানকানা সাহিব নামে পরিচিত।

হিন্দু ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্ম িেও বড় হবার পর হিন্দু ধর্মের আচার অনুষ্ঠান তাকে আকর্ষণ করতো না। বর্ণ প্রথা আর দেব দেবীর পূজো কোনভাবেই মানতে পারতেন না তিনি।

জনশ্রুত আছে, একবার তিনি মুসলমান বন্ধু মারকানার সাথে বাইন নদীতে গোসল করতে যান। সেখানে গিয়ে ডুব দিয়ে হারিয়ে যান তিনি। তিনদিন পর ফিরে এসে বলেন তিনি ঈশ্বরের দেখা পেয়েছেন। একটি দৈববানী সবার মাঝে ছড়িয়ে দেন আর সেটি হলো, ‘কেউ হিন্দু নয়,কেউ মুসলমান নয়’। মানে সবাই মানুষ, কোন ভেদাভেদ নাই।

১৫০৮ সালের ২০ আগস্ট ৩৮ বছর বয়সে তিনি এই জাগরণ লাভ করেন।এই বিশেষ ব্যক্তিটির নাম নানক, যিনি পরবর্তীতে শিখদের প্রধান গুরু হিসেবে পরিচিতি পাবেন।পরের পুরো জীবন জুড়ে তিনি জীবনযাপনের সহজ বানী প্রচার করতে থাকেন।

তিনটি মুল মন্ত্র ছিল তার জীবনের। এক. ‘নাম জপো’ মানে প্রার্থনা করো, দুই. ‘ভাগকে শিখো’ া বার সঙ্গে ভাগ করো, তিন. ‘কিরাট করো’ বা সৎভাবে জীবন যাপন করো।পরের তিন দশক গোটা ভারতবর্ষ চষে বেড়ান তিনি।

দক্ষিণে শ্রীলংকা থেকে উত্তরের তিব্বত কিছুই বাদ যায়নি। এছাড়া মক্কা, মদিনা, মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে বেড়ান তার এই তার এই মতবাদ নিয়ে। যার মুল মন্ত্র হচ্ছে ‘সাম্যবাদ’।

তিনি লঙ্গরখানার ধারণা পৈবর্তনকরেন। যেখান বিনামুল্যে যেকোন মানুষ খাবার খাবেন। সেখানে সবাই, খাবে একই যায়গায় বসে, একই খাবার। উঁচু নিচু কোন ভেদাভেদ নাই।

তিনি মনে করেন সব ধর্মমত সমভাবে সঠিক এবং নিজ নিজ অনুসারিদের তা আলোকিত করতে পারে। ৭০ বছর বয়সে যখন তিনি মারা যান তখন তার জীবনাচারণে মুগ্ধ হয়ে অনুসারির সংখ্যা বিশাল আকার ধারণ করে। জন্ম নেয় নতুন এক ধর্মের যার নাম ‘শিখ ধর্ম’।যারা মানেন বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডে একজন মাত্র ঈশ্বর আছেন এবং পৃথিবীর সকল মানুষ সমান কেউ কারো চাইতে বড় নয়।

গুরু নানকের হাতে এই বিশেষ ধর্মের জন্ম হলেও শিখ ধর্ম শুধু এক গুরু নানকের হাতে পুরিপুর্ণ হয়নি। একে একে শিখদের দশজন গুরুর আবির্ভাব হয়। তারা সকলেই সমৃদ্ধ করেছেন নতুন এই জীবন ধর্মকে। সকলেই সমান ভাবে সমাদৃত শিখ অনুসারিদের কাছে।

ইসলাম, হিন্দু, জৈন কিংবা বৌদ্ধ ধর্মে একজন যেমন প্রধাণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেছেন, িখর্মে তেমন দশজন মিলে ক স্বতন্ত্র নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে। যেখানে সংসার, জীবিকা ও পরিবারকে সাথে নিয়ে মোক্ষম নির্বাণ লাভের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে।

দশম গুরু গোবিন্দ সিং। তিনি সিদ্ধান্ত জানালেন এর পর আর কোন গুরু আসবেন না। তিনি শেষ গুরু।এই দশগুরুর বচন, উপদেশমালা, স্তোত্র বা স্রষ্টার গুনগান সমস্তকিছু একটিমাত্র পুস্তকে সংকলণ করলেন। প্রায় ১৪৩০ টি অঙ্গে বিভক্ত বিশাল গ্রন্থকে ১৭০৭ সালে ‘শেষ গুরু’ হিসেবে ঘোষণা করলেন গোবিন্দ সিং। এটিই শিখদের চিরন্তন গুরু হিসেবে চালু হলো। নাম ‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’। শিখদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ।

এই দশ গুরুর ২.৫ কোটি অনুসারিরাই এখন শিখ ধর্মের অনুসারি হিসেবে পরিচিত।

(চলবে..)


পারভেজ সেলিম

লেখক,সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী


‘খালিস্তান আন্দোলন’ আরো কয়েকটি পর্ব পড়ুন :

পর্ব : ০১ : খালিস্তান: শিখদের স্বপ্নের স্বাধীন দেশ

পর্ব : ০২ : গুরু নানক: যার হাতে নতুন ধর্মের শুরু

পর্ব : ০৩ : দশ গুরু: শিখ ধর্ম যাদের হাতে গড়ে উঠেছে

 পর্ব : ০৪ : পাঞ্জাবের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও দেশভাগের প্রবঞ্চনা!

 পর্ব : ০৫ : পাঞ্জাব: দেশভাগের পরের উথাল পাতাল রাজনীতি

 পর্ব : ০৬ : খালিস্তান: প্রবাসী সরকার ও পাকিস্তানের মদদ

পর্ব : ০৭ : জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে: এক সাধুর উত্থান ও ট্রাজিক পতন

 পর্ব : ০৮ : কে এই জার্নেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে?

পর্ব : ০৯ : অপারেশন ব্লু স্টার: ইন্দিরা গান্ধির শেষ যুদ্ধ !

পর্ব : ১০ : ইন্দিরা গান্ধী হত্যা: শিখদের হাতেই জীবন উৎসর্গ!

x