পারভেজ সেলিম
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে রোমান্টিক পুরুষ বলা হয় রবীন্দ্রনাথকে। কত বিচিত্র বিষয়ের প্রেমে মজেছিলেন কবি তার সৃষ্ট শিল্পের দিকে তাকালেই খুব সহজেই তা অনুমান করা যায়। কবির শিল্প চর্চায় প্রকৃতি প্রেমের মতোই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে নারীর প্রেম।
প্রেমের সেই প্রকাশ তিনি যেভাবে করেছেন তা বাংলার শিল্প সাহিত্যের ভান্ডারকে করেছে ঐশ্বর্যময়।
রবীন্দ্রনাথ তার পুরো আশি বছরের জীবনে অনেক নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। সেই সম্পর্কের আবেগ এবং উষ্ণতা দিয়ে রচনা করছেন অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প। এছাড়া তার প্রেমময় সকল চিঠিপত্র তো বাংলা ভাষার এক অনন্য সম্পদ।
তবে রবীন্দ্রনাথের নারীপ্রেম বর্তমান সময়ের নারী পুরুষের প্রেমের মাণদন্ডে বিচার করলে তার সঠিক মুল্যায়ণ করা হবে না।
তার নারী প্রেমকে তিনি এমন এক অনন্য স্বকীয় উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে তার শত্রুরাও সেটাকে ‘লাম্পাট্যে’র নেতিবাচকতায় দেখতে চান না এবং সেটি সর্বজন স্বীকৃত।
সব মিলিয়ে দশ জন নারীর সাথে রবীন্দ্রনাথের মানষিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার তথ্য পাওয়া যায়। কোনটা খুব গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী আবার কোনটা ক্ষণস্থায়ী। এসব সম্পর্কের নির্যাস দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে দারুণ সব বিরহ, প্রেম, আর ভালোবাসার বৈচিত্রময় উপলব্ধির বহুমুখি বয়ান।
দেখা গেছে, যে সম্পর্ক যত গভীর হয়েছে তার সৃষ্ট শিল্পের মানও তেমন উন্নত পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানুষে মানুষে সম্পর্কের এমন অসাধারণ ও মননশীল ব্যবহার পৃথিবীর অন্য কোন শিল্পীর জীবনে এত তীব্রভাবে আর দেখা যায় না।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের সেই দশ নারীর দিকে নজর দেয়া যাক।
১. আনা তড়খড়: প্রথম নারী
বরীন্দ্রনাথের প্রথম প্রেমে পড়ার খবর পাওয়া যায় তার ১৭ বছর বয়সে। মেয়েটির আসল নাম আনা তড়খড়। সবাই চিনতো অন্নপূর্না দেবী নামে।
ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেতে যাবার আগে রবি গিয়েছিলেন মেজ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ এর কাছে। তিনি তখন আহমেদাবাদের সেশান জাজ।
মেজদাদা বোম্বেতে তার বন্ধুর বাসায় পাঠিয়েছিলেন কিশোর রবিকে, যাতে লন্ডনে যাবার আগে কিছু আদব কায়দা শিখে নিতে পারে।
বন্ধু আত্নারাম পান্ডুরঙের বিলেত ফেরত মেয়ে অন্নপূর্না দেবীর বয়স তখন বিশ বছর, কারো কারো মতে তেইশ, বরীন্দ্রনাথ তখন সবে মাত্র সতের।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রেম তার চেয়ে তিন বছরের বড় এই মারাঠি মেয়েটির সাথে। সময় ১৮৭৮। রবীন্দ্রনাথ প্রথম প্রেমিকার নাম দিয়েছিলেন নলিনী।
তরুণ রবীর মুখশ্রী এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে আনা রবিকে বলেছিলেন ‘তুমি কোন দিন দাঁড়ি রেখো না, তোমার মুখের রুপ যেন ঢাকা না পড়ে’। প্রথম প্রেমিকার সেই কথা যে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীতে রাখতে পারেননি সেটা আমরা সকলে জানি।
পরের বছরই আনার বিয়ে হয়ে যায় এক আইরিশ যুবকের সাথে। সময়টা ১৮৭৯ সালের ১১ নভেম্বর। যুবকের নাম হ্যারল্ড লিটলডেল। যিনি ছিলেন বরোদার রাজকুমার কলেজের উপাধ্যক্ষ।
১৮৯১ সালে ৫ জুলাই মাত্র ছত্তিশ বছর বয়সে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান আনা। রোগের নাম যক্ষা। মৃত্যুর আগেই বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল আনার। তার দুইটি মেয়ে সন্তান ছিল।
‘নলিনী’ নামটি তার এত পছন্দ হয়েছিল যে দেশি ও বিলেতি সংবাদপত্রে তিনি ‘আনাবাই নলিনী’ নামটি ব্যবহার করতেন।
অনেক দিন পরে পুরবী কাব্যগ্রন্থের ’ক্ষনিকা’ কবিতায় আনাকে স্মরণ করেছেন কবি
…..
ভেবেছিনু গেছি ভুলে; ভেবেছিনু পদচিহ্নগুলি
পদে পদে মুছে নিল সর্বনাশী অবিশ্বাসী ধূলি।
আজ দেখি সেদিনের সেই ক্ষীণ পদধ্বনি তার
আমার গানের ছন্দ গোপনে করেছে অধিকার;
দেখি তারি অদৃশ্য অঙ্গুলি
স্বপ্নে অশ্রুসরোবরে ক্ষণে ক্ষণে দেয় ঢেউ তুলি।……
আনার বিয়ের বছরই রবীন্দ্রনাথ বিলেতে চলে যান ব্যারিষ্টারি পড়তে।
২. লুসি স্কট: প্রথম বিদেশিনী
পরের বছর। সাল ১৮৭৯। রবীন্দ্রনাথ তখন লন্ডনে। বয়স ১৮। বিলেতের স্কট পরিবারের সাথে থাকতে শুরু করেছেন কবি।
তাদের ঘরে চার মেয়ে। লুসি স্কট সবার ছোট। সেজো ও ছোট দুজনেই একসাথে প্রেমে পড়লেন সুদর্শন কবি রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথ বেছে নিলেন লুসিকে। রবীর জীবনের প্রথম বিদেশিনী।
রবীর চেয়ে বয়সে ৬ বছরের বড় লুসি বেশ ভালো পিয়ানো বাজাতে পারতেন। তাদের প্রেমময় দিনগুলোতে লুসি পিয়ানো বাজাতেন আর রবী গান গাইতেন। কখনো কখনো একসাথে গেয়ে উঠতেন দুজনে..
‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়
তটিনী হিল্লোলে তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়
পিক কিংবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহু কুহু গায়
কি জানি কিসেরই লাগি প্রাণ করে হায়-হায়’..
রবীর সাথে লুসির সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, তবু লুসি তার পরের জীবনে আর কোন দিন বিয়ে করেননি।
বিলেতে সেইসময় আরো কিছু নারীর সাথে সখ্যতা তৈরি হয়েছিল রবীর। লুসির সাথে লং, মুল কিংবা ভিভিয়ান সেইসময়ের বিলেতের নারীদের কাউকেই ভুলেননি কবি।
১৯২৪ সালের ১৯ নভেম্বর তেষট্টি বছর বয়সে কিশোরবেলার সেই নারীদের স্মরণ করেছেন কবি তার ‘কিশোর প্রেম’ কবিতায়।..
‘এই জীবনে সেই তো আমার প্রথম ফাগুন মাস
ফুটলো না তার মুকুলগুলি
শুধু তারা হাওয়ায় দুলি
অবেলাতে ফেলে গেছে চরম দীর্ঘশ্বাস
আমার প্রথম ফাগুন মাস ।’
মৃত্যুর চার বছর আগে ‘প্রান্তিক’ নামে কবিতায় কিশোর বেলার সেই প্রেমের কথাগুলো আবারো বলেছেন কবি।
সত্তর বছর বয়সে লেখা ‘পশ্চিম যাত্রার ডায়রী’তে তিনি লুসি স্কটের কথা স্মরণ করেছেন। লুসির পুরো পরিবার রবীর জীবনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
৩৯ বছর পর ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ তখন কানাডায়, বয়স ৭০। শান্তিনিকেতনে একটি চিঠি আসে রবীন্দ্রনাথের কাছে। চিঠিটি লিখেছেন ইংরেজ এক ভদ্রলোক যিনি লুসিকে তার পিসি বলে পরিচয় দিচ্ছেন এবং তিনি রবীন্দ্রনাথ আর লুসির সম্পর্কের কথা জানতেন বলে দাবি করছেন।
পুরো জীবনে বিয়ে না করা লুসি এখন অসুস্থ বৃদ্ধা এবং দরিদ্র। কিছুু টাকা পয়সার সাহায্য প্রয়োজন, এই ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখেছেন তবে শর্ত দিয়েছেন বৃদ্ধা লুুসি স্কট যেন কোনভাবেই না জানে যে তিনি তার একসময়ের প্রেমিকের কাছে আর্থিক সাহায্য চাইছেন।
রবীন্দ্রনাথ তাকে টাকা পাঠিয়েছিলেন কিনা তা জানা যায়না। তবে লুসিকে যে রবীন্দ্রনাথ মনে রেখেছিলেন সেটা জানা যায় তার লেখাতে।
৩. কাদম্বরী দেবী: প্রথম প্রেম
১৮৮২ সাল। রবীন্দ্রনাথ ফিরেছেন বিলেত থেকে। দেড় বছর আগে রবী যে ছোট বৌঠানকে ছেড়ে গিয়েছিলেন বিদেশ সেই বৌঠান আর এখনকার বৌঠান যেন এক নয়। এ যেন নতুুন এক মানুুষের সাথে দেখা হলো কবির।
এটাই রবীর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেমের সাথে পরিচয়। অনুভূতি ভাগাভাগি করা জীবনের প্রথম বন্ধু। যাকে রবি বলতেন ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ যা সবসময় জ্বলে।
বিলেত থেকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ফিরেছেন রবীন্দ্রনাথ। দেড় বছর ধরে তার অপেক্ষায় আছে তার নতুন বৌঠান। যার নাম কাদম্বরি দেবী।
কাদম্বরী যখন এই বাড়িতে আসেন তখন তার বয়স নয় বছর আর রবীন্দ্রনাথের সাত। দুজনে হয়ে উঠেছিলেন দুজনের খেলার সাথী।
পতী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার থেকে দশ বছরের বড়। স্বামীর সাথে কাদম্বরীর যেন সম্ভ্রম এবং শ্রদ্ধার সম্পর্ক।
ছেলেবেলার খেলার সাথী ছিলেন দুজন। দুজনে প্রায় সমান বয়সী। নতুন বউ এর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ দেবর রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুর পরিবারে রবীই হয়ে ওঠেছিলেন সুখ দুখের সঙ্গী।
এরপর রবীর বিলেত যাত্রা। হঠাৎ যেন এক বিরহ যন্ত্রণা শুরু।
দেড় বছর পর বিলেত থেকে ফিরে নতুন এক বৌঠানের সাথে দেখা হয়ে গেল রবীর।
এই সময়টুকুতে যত অনুভূতি, বেদনা আর ভালোবাসার আদান প্রদান হয়েছে, পরবর্তী জীবনে আর কারো সাথে এমন অনুভূতির তীব্র প্রকাশ হয়নি কবির। অন্তত তার সৃষ্টির দিকে তাকালে তাই দেখা যায়।
দুজনের মান অভিমান আর ভালোবাসা ছিল চূড়ান্ত। রবীন্দ্রনাথের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেমের নাম কাদম্বরী দেবী।
কারো কারো মতে কাদম্বরীই রবীন্দ্রনাথের প্রথম ও শেষ নারী যার মায়াবী আচ্ছন্নতা থেকে সারাজীবনই বেরিয়ে আসতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ ।
কবি লিখছেন..
‘দোসর আমার দোসর ওগো, কোথা থেকে
কোন শিশুকাল হতে আমায় গেলে ডেকে।
তাই তো আমি চিরজীবন একলা থাকি-
সকল বাধন টুটলো আমার একটি কেবল রইলো বাকি-
সেই তো তোমার ডাকার বাধন অলস ডোরে
দিনে দিনে বাধল মোরে ।…
বিলেত থেকে যখন ফেরে রবী তখন একুশ আর কাদম্বরী তেইশ।
রবী বুঝতে পারলেন তার বৌঠান এখন আরো বেশি নি:সঙ্গ। সেই নি:সঙ্গ মনের গভীরে প্রবেশের অধিকার যেন স্বামী জোতিরিন্দ্রনাথেরও নাই। কাদম্বরীর মনে সন্দেহ রইলো না রবিই তার মনের মানুষ।
রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্ট নীড়’ ছোট গল্পের চারুলতা যেন কাদম্বরী’র-ই প্রতিচ্ছবি।
রবী সবচেয়ে বেশি বই উৎসর্গ করেছিলেন কাদম্বরীকেই।
ভগ্নহৃদয় কবিতায় তিনি লিখছেন …
‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা
এ সমুদ্রে আর কভু হবো নাকো পথ হারা’
তাদের এই সম্পর্ক স্বামী জোতিন্দ্রনাথ কিভাবে দেখতেন? এর উত্তর রবীন্দ্রনাথ নিজেই দিয়েছেন।
‘আমি যে তোমায় জানি সে তো কেউ জানেনা
তুমি মোর পানে চাও সে তো কেউ মানে না
মোর মুখে পেলে তোমার আভাস
কতজনে করে পরিহাস
পাছে সে না পারে সহিতে
নানা ছলে তাই ডাকি যে তোমায়
কেহ কিছু নারে কহিতে।
১৮৮৩ সালে ৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয় বাংলাদেশের মেয়ে মৃনালীনি দেবীর সাথে।
রবীর বিবাহের পরই যেন খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল দুজনের সম্পর্ক। কাদম্বরী শুনতে পাচ্ছিলেন ‘হেতা হতে যাও পুরাতন হেথা নতুনের খেলা শুরু হইয়াছে…” এমন বানীর প্রতিধ্বনি ।
বিয়ের সাড়ে চার মাস পর একদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে আফিম খেয়ে আত্নহত্যা করেন কাদম্বরি দেবী।
রবীকে হারানো অভিমান থেকে এই আত্নহত্যা বলেই ধরে নেন অনেকে।
রবীর জীবনে নতুন কারো আগমনকে হয়ত সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি বৌঠান। তাই একা একা প্রস্থান করেছেন চিরজীবনের জন্য। তখন তার বয়স মাত্র ছাব্বিশ ।
ঠাকুর পরিবারের মান সম্মান যাতে কোনভাবেই নষ্ট না হয় সেজন্য কোন পুলিশ কেস পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি কাদম্বরীর মৃত্যুর পর।
অকাতরে চলে যায় একটি জীবন, যখন রবীর জীবনে আসে নতুন নারী। একমাত্র বউ। মৃনালিনী দেবী।
চলে গেছে ‘পুরাতন’ কাদম্বরী, এসেছে ‘নতুন’ মৃনালিনী।
৪. মৃণালিনী দেবী: একমাত্র বউ
রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করেন ২২ বছর বয়সে। সময় ১৮৮৩। বাংলাদেশের খুলনার মেয়ে মৃণালিনী দেবীকে যখন বিয়ে করেন তখন তার বয়স দশ। তিনিই রবীন্দ্রনাথের একমাত্র স্ত্রী।
ঠাকুর বাড়ির কর্মচারি বেণীমাধবের কন্যা ছিলেন মৃনালিনী। পড়াশুনা গ্রামের স্কুলে। ডাক নাম ছিল ভবতারিনী।
মাত্র উনত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। তাদের উনিশ বছরের সংসারে দুই পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। এঁদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে
সংসারধর্ম পালণ করলেও রবীন্দ্রনাথের মনের নাগাল পাওয়া হয়ত সম্ভব হয়নি গ্রামের এক মেয়েটির। অন্তত কবির চিঠিপত্রে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
১৮৯০ সালে জানুয়ারির এক চিঠিতে স্ত্রীকে তিনি লিখছেন ‘একেই তো বলে বাঙ্গাল, ছি ছি ছেলেটাকে পর্যন্ত বাঙ্গাল করে তুললে গো’। কি অসহিষ্ণু, অমার্জিত ভাষা রবীন্দ্রনাথের, ভাবা যায়!
ঠিক একই সময়ে ভাতিজি ইন্দিরা দেবীকে তিনি লিখছেন ‘মানুষ কি লোহার কল যে নিয়ম অনুসারে চলবে?’
রবীর জীবনে একটি বিশেষ চরিত্র মৃনালিনী দেবি। সংসার জীবনটা তার সাথে কাটালেন। এই সম্পর্কটি ছিল যেন শুধু প্রয়োজনের। সন্তান আর সংসারের। কবির অনুভূতি সৃষ্টির যে জ্বালানী তা স্বামী-স্ত্রীর এই প্রয়োজনের সম্পর্ক দিয়ে মেটেনি এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
কবি বুঝতে পেরেছিলেন মৃনালিনীর পক্ষে তার মনের নাগাল পাওয়া হয়ত অসম্ভব। তাই লিখেছেন
‘ তুমি মোরে পারো না বুঝিতে?
…
কিছু আমি করিনি গোপণ
যা আছে, সব আছে
তোমার আখির কাছে
প্রসারিত অবারিত মন
দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা
তাই মোরে বুঝিতে পারোনা?….
স্ত্রীকে চিঠিতে তিনি ‘ভাই ছুটি’ সম্মোধন করতেন। বাড়ির ছোট বউ তাই ছুটি। নামের আগে ভাই, বোঝাই যায় রোমান্সকে কিভাবে বিদায় দিয়েছিলেন তাদের স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্ক হতে।
মৃণালিনী দেবীকে তিনি সম্মান করতেন, শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু কতটুকু ভালোবাসতেন তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
বিশাল একজন কবির মানসে কতুটুক আলোড়ন তুলতে পেরেছিলেন ছোট্ট গ্রাম থেকে উঠে আসা এক সাধারণ মেয়ে, রবীর সৃষ্টির দিকে তাকালে অবশ্য তা বোঝা যায়। তবে তার মৃত্যুর পর আর দ্বিতীয় কোন বিয়ে করেননি রবীন্দ্রনাথ।
৫. ইন্দিরা দেবী: ভাতিজির সাথে প্রেম
১৮৮৭ সালে ছাব্বিশ বছরের রবীন্দ্রনাথ প্রথম চিঠি লেখেন ১৪ বছর বয়সী ইন্দিরাকে। ইন্দিরা মাত্র কিছুদিন আগেই বিলেত থেকে ফিরেছেন।
ইন্দিরা দেবী ছিলেন ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে। সম্পর্কে ভাতিজি। কাদম্বরী মারা যাবার পর রবীন্দ্রনাথের প্রাণের খবর সবচেয়ে বেশি পেয়েছিলেন এই কিশোরি।
বরীন্দ্রনাথ বিয়ে করেছেন বছর চারেক হলো। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই আত্নহত্যা করেন রবীর প্রিয় মানুষ বৌঠান কাদম্বরী দেবী।
স্ত্রী মৃনালিনী দেবী গ্রামের মেয়ে। ঠাকুর পরিবারের সবকিছুুকে খাপ খাইয়ে নিতে যেন সময় লাগছিল। রবীন্দ্রনাথও হয়ত বুঝে গিয়েছিলেন তার গভীর সুক্ষ মনের খবরে নেবার মত আগ্রহ কিংবা আনন্দ কোনটাই মৃনালিনীর ছিল না। দুজনের সম্পর্ক যেন সংসার আর প্রয়োজনে প্রয়োজনে কেটে যাচ্ছিল। কবির এমন এক বিষন্ন সময়ে ইন্দিরা ফিরে আসেন বিলেত থেকে ।
৫ বছরের সম্পর্কে ইন্দিরাকে ২৫২ টি চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর এ সসময় স্ত্রী মৃনালিনী দেবীকে দিয়েছিলেন মাত্র ১৫ টি চিঠি আর ৫ টি সন্তান। চিঠির সংখ্যায় সম্পর্কের আচ পাওয়া যায়।
কাদম্বরীর পরে রবীন্দ্রনাথের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন নারী এই অল্প বয়সী ইন্দিরা দেবী।
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ইন্দিরাকে
‘একবার যদি এই রুদ্ধ জীবনকে খুব উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খলভাবে ছাড়া দিতে পারতুম, একেবারে দিগবিদিক ঢেউ খেলিয়ে ঝড় বইয়ে দিতুম, কিন্তু আমি বেদুইন নই, বাঙালী।……যাকগে যখন রীতিমত অসভ্য হওয়া অসাধ্য তখন রীতিমত সভ্য হওয়ার চেষ্টা করাই সংগত।’
সভ্য অসভ্যের মানদন্ডে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ও ইন্দিরার মানসিক সম্পর্ক।
ইন্দিরা ছিলেন একেবারে স্ত্রী মৃনালিনী সমবয়সী। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা। ঠাকুর পরিবারের বি এ পাশ করা প্রথম নারী।
১৮৯৯ সালে নিজের পছন্দে সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীকে বিয়ে করেন ইন্দিরা। সাতাশি বছরের দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী (১৮৭৩-১৯৬০) ।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর উনিশ বছর পর ১৯৬০ সালে ১২ আগষ্ট মত্যুবরণ করেন এই বিদুষী নারী।
৬. তোমিকো ওয়াদা কোরা: জাপানী প্রেম
১৯১৬ সালে জাপান গেলেন রবীন্দ্রনাথ। তখন তার বয়স ৫৫। কলেজ ছাত্রী তোমির বয়স তখন মাত্র ২০।
তোমির কলেজেই অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন কবি। প্রথম দেখাতেই যেন প্রেম। দেশ কাল পাত্র সব ভুলে আজীবনের এক অদৃশ্য বন্ধনে যেন বাধা পড়লেন তোমি।
সেবারই কলেজ ছাত্রছাত্রীদের সাথে একটা ট্যুর হয় কবির। সেই সফরের আরো ঘনিষ্ট ও আন্তরিক হন তোমি ও রবীন্দ্রনাথ।
তোমি ইংরেজি জানতেন। কবির ভাষণের অনুবাদের কাজটা করতেন তিনি।
সাথে কবিকে দেখাশোনা, ঘর গোছানো সহ সকল কাজের দায়িত্ব ছিল তার উপর। কবির প্রেমে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি যে বালিশে লেগে থাকা কবির চুল সংগ্রহ করে রাখতেন গোপনে।
জাপানের তোমি রবীর প্রথম প্রেম পর্ব এভাবেই যেন নিমেষেই কেটে যায় দুজনের।
জাপান থেকে ফেরার তিন বছর পরে ১৯১৯ সাল কবি এবার আমেরিকায় যায়। কবির বয়স তখন ৫৮ আর তোমি ২৩। তোমি তখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কবি আমেরিকায় এসেছেন শুনে তার সাথে দেখা করতে এবার নিউইয়র্ক গেলেন তোমি।
জাপান থাকতে বালিশে লেগে থাকা মাথার যে চুল সযন্তে রেখে দিতেন তোমি, সেই চুল এবার সাথে করে নিয়ে গেছেন আমেরিকায়।
নিউইয়র্ক দুজনের বন্ধুত্ব যেন আরো গাঢ় হয়। আবারো জাপানে যাবার আমন্ত্রণ জানায় তোমি। তোমির হাত ধরে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন কবিগুরু।
পাঁচ বছর পর ১৯২৪ সালে আবার জাপান গিয়েছিলেন কবি, তখন তার বয়স ৬৩ বছর। উঠেছিলেন নাগাসাকিতে তোমির বাড়িতে। সে সময়ের প্রেম উঠেছিল এক চরম সীমায়।
১৯৩৪ সালে বিয়ে করেন তোমি। বিয়ের পরও রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে থাকতে পারেননি তিনি।
১৯৩৬ সালে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন কবিকে দেখতে। তখন ভগ্ন শরীরে চিত্রাঙ্গদার মহড়া দিচ্ছিলেন ৭৫ বছরের রবী। দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তোমি।
কথা শেষে আবারো জাপানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কবিকে।
কিন্তু সেই আমন্ত্রন আর রক্ষা করা হয়নি কবির।
তার আগেই ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাটম বোমা ফেলা হয় নাগাসাকিতে। কি নির্মম বিধ্বংসী সেই যুদ্ধ। তবু ভালো কবিকে দেখতে হয়নি তার প্রিয় বান্ধবীর শহর ধ্বংসের লীলাযজ্ঞ। তার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বিশ্বকবি।
৭. রানু মুখার্জি: রবীন্দ্রনাথ তখন ৫৭ রানুর বয়স ১২
সাল ১৯১৭।
রানু বারাণসীর মেয়ে। বাবা ফণিভূষণ অধিকারি বেনারসীর হিন্দু ইউনিভার্সিটির দর্শণের অধ্যাপক ছিলেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রানু তৃতীয়। রবীন্দ্রনাথের সাথে রানুর বয়সের তফাত পয়তাল্লিশ বছরের। রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ৫৭ বছর তখন রানুর বয়স মাত্র ১২ বছর!
রানুর জন্মই হয়েছিল ১৯০৬ সালে। তার ভাল নাম প্রীতি অধিকারী ।
ছোটবেলায় মায়ের মুখে রবীঠাকুরের গান শুনে শুনেই বড় হয়েছে রানু। বড় হবার পর গভীরভাবে পরিচিত হতে থাকে রবীর লেখার সাথে ।
১২ বছর বয়সে রানু প্রথম চিঠি লেখেন রবী বাবুকে। বয়সে ছোট হলেও বেশ বড় বড় কথা লিখতে লাগলেন চিঠিতে। মনে হত যেন রবীর প্রায় সব লিখায় তার পড়া শেষ। চিঠিতে অভিযোগ করছেন তিনি এত কম লিখেন কেন?
রানু প্রথম চিঠি লেখেন ১৩২৪ সালের শ্রাবণ মাসে। কবি উত্তর দেন ভাদ্র মাসে।
এর নয় মাস পর ১৯১৮ সালের ১৫ মে প্রানু আর ভানুর প্রথম দেখা হয়।
রানু তার বাবার চিকিৎসার জন্য কাশি থেকে কলকাতা এসেছিলেন। উঠেছিলেন ল্যান্সডাউন রোড়ের ভাড়া করা বাড়িতে।
কলকাতা পৌঁছে তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলেন। গিয়ে হাতের উপর হাত রেখে মন ভরে দেখেছিলেন তার এত দিনের প্রিয় মানুষটাকে।
রবীর বড় মেয়ে মাধুরীলতা মারা গিয়েছিলেন যক্ষায়। মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে দেখতে গিয়ে যখন জানতে পারেন সে আর দুনিয়াতে নাই তখন সিঁড়ি থেকেই ফিরে এসেছিলেন কবি।
বাড়ি ফিরে বিকেলে সোজা চলে গিয়েছিলেন ল্যান্সডাউন রোডে রানুর সাথে দেখা করতে।
দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধনগ্ন রানুকে দেখতে পান রবী। রবী বাবু এসেছেন শুনে স্নানঘর থেকে সোজা চলে এসেছিলেন দরজায়। খেয়ালই ছিল না তার শরীর অনাবৃত।
পয়তাল্লিশ বছরের ছোট একটি মেয়ের সাথে সম্পর্কের শুরু এভাবেই। চিঠিতে রবী লিখেছেন ‘আমার খুব দুঃখের সময় তুমি আমার কাছে এসেছিলে’।
কাদম্বরীর ছায়া হয়ত দেখেছিলেন রানুর মাঝে। কবি লিখলেন…
‘এই বুঝি মোর ভোরের তারা এল সাঁঝের তারা বেশে
অবাক চোখে ওই চেয়ে রয় চিরদিনের হাসি হেসে
সকাল বেলা পাইনি দেখা পাড়ি দিল কখন একা
নামল আলোক সাগর-পারে অন্ধকারের ঘাটে এসে’।
রানু শান্তিনিকেতনেও এসে রবী বাবুর সাথে ছিলেন কিছু দিন।
আর চিঠি লেখা যেন দুজনের নতুন আনন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ধীরে ধীরে রানুর বয়স বাড়ে ১৮ হয় । হৃদয়ের ঘনিষ্টতা আরো বাড়ে। কিন্তু রানু তো আর তার আজীবনের জন্য নয়।
রানুর বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে রানুর মা সরয় দেবীকে চিঠি লিখেছিলেন উদ্বিগ্ন রবীন্দনাথ।
‘…রানুর জন্য আমার মনে একটা উৎকন্ঠা আছে। সেজন্যে একটি যথার্থ ভদ্রলোকের হাতে ওকে দিতে পারলে আমি খুশি হই।….যে আমার সম্বন্ধে রানুকে বোধ করি বেদনা দেবে না।’
বিয়ে হয়ে যায় রানুর। ১৯২৫ সালের ২৮ জুন স্যার রাজেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায়ের ছেলে স্যার বীরেনের সাথে।
এই খবরে ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে পড়েন প্রায় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ।
‘আমার ভুবন তো আজ হলো কাঙাল কিছু তো নাই বাকি
ওগো নিঠুর দেখতে পেলে তা কি’।….
১৯১৭ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৪০ সাল অবধি রবীন্দ্রনাথের লেখা মোট চিঠি ২০৮টি। আর রাণুর লেখা মোট চিঠির সংখ্যা ৬৮। এই চিঠিগুলি প্রথমে ধারাবাহিক ভাবে ‘বিচিত্র’ পত্রিকায় ও পরবর্তী কালে বই হয়ে প্রকাশিত হয় ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ নামে।
রানু-ভানুর সম্পর্ক কত গভীরে পৌঁছেছিল তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় রানুর লেখা চিঠিতে।
‘আমার আপনার জন্য মন কেমন করে, আমি আপনাকে চুমু দিচ্ছি..’।
‘ভানুদা আমি এত দোষ করেছি যে আপনাকে আমি আর ভালোবাসতে পাব না? ভানুদা আপনিই ত কতবার বলেছেন যে আমাদের সত্যিকার বিয়ে হয়ে গেছে।’
‘আপনি আমাকে নাই চিঠি দিলেন কিন্তু আমি তো মনে মনে জানব যে একদিন আমি ভানুদার সমস্ত আদর পেয়েছি। আমার সমস্ত শরীর ছেয়ে সে-আদর আমার মনকে ভরে দিয়েছিল। সে ভাবনাটুকু কেড়ে নেবার সাধ্য এ পৃথিবীতে কারুর নেই, ভানুদাদা আপনারও নেই।’
‘নাই বা আপনি চিঠি দিলেন, আমি ত জানব মনে মনে যে একটা Secret আছে যা আমি আর ভানুদাদা ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কেউ জানে না। সেইটুকুতে ত কারুর অধিকার নেই।’
এসবই পাওয়া যায় রাণুর লেখা চিঠিতে।
পরবর্তীতে রানু হয়ে উঠেছিল লেডি রানু মুখোপাধ্যায় । অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস, কলকাতায় একটি পুর্নাঙ্গ শিল্পকলার প্রতিষ্টান গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তার নিজস্ব উদ্দ্যোগ এবং তার স্বামীর অর্থ সহায়তায়। তাদের দুটি মেয়ে এবং একটি পুত্র সন্তান ছিল। পরবর্তীতে স্বামীর সাথে তিনিও নাইট উপাধী পেয়েছিলেন।
২০০০ সালের ১৫ মার্চ ৯৪ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন রবী ঠাকুরের এই মানস সুন্দরী।
৮. ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো: ওগো বিদেশিনী
সাল ১৯২৪
বিয়ের পর রানুর সাথে কবির সম্পর্কের ছেদ পড়েছে।
রবী বাবু এবার যাচ্ছিলেন দক্ষিন আমেরিকার দেশ পেরুতে। জাহাজে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
যাত্রা বিরতি দিয়ে বিশ্রাম নিতে তাকে যেতে হয় আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে।
এই খবর যখন ভিক্তরিয়া ওকাম্পের কাছে পৌঁছালো তখন তিনি বিচলিত হয়ে পড়লেন।
১৮৯৯ সালের ৭ এপ্রিল আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে জন্ম ওকাম্পোর।
রবীর সাথে দেখা হবার ১২ বছর আগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন বার্নাডো এস্ত্রাদাকে। সালটা ১৯১২।
সেসময় স্প্যানিশ ভাষার লেখালেখিতে বেশ নাম ডাক হয়েছে তার। পরে ফরাসী ও ইংরেজিতেও সাহিত্য চর্চা করতে শুরু করেন ভিক্তোরিয়া।
স্বামীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে ১৯২১ সালে প্রেমিক মার্তিনেথের সাথে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু সে সসম্পর্কও তাকে শান্তি দিতে পারেনি। প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন।
বিশ্বসাহিত্য তার ছিল বেশ জানা শোনা। জীবনের এমন কঠিন সময়ে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি তাকে জীবন যন্ত্রণায় কিছুটা শান্তি দিয়েছিল।
পৃথিবীর অন্য প্রান্তের বৃদ্ধ কবি রবীন্দ্রনাথকে বসিয়েছিলেন মনের কোঠায়।
তাই কবির আর্জেন্টিনা আসার খবরে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন এই লেখিকা।
এতদিন রবীন্দ্রনাথকে তিনি প্রাণ দিয়ে চিনতেন এবার সরাসরি সেবা করার সুযোগ পাবেন।
১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর থেকে ১৯২৪ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত ভিক্তোরিয়া কাটালেন রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য।
নিজের গহনা বিক্রি করে রবীর জন্য বাড়ি ভাড়া করে রেখেছিলেন কাছে।
এর আগে স্প্যানিশ কবি হিমেনেথ ১৯১৫-১৯২২ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ২২ টি বই এর অনুবাদ করে ফেলেছেন। যার মধ্যে দিয়েই রবী এক পরিচিতি মুখ স্প্যানিশ সাহিত্যে।
চৌত্রিশ বছরের ওকাম্পের আবির্ভাব হলো তেষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথের জীবনে।
তার নাম তিনি দিয়েছিলেন বিজয়া। পূরবী কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গও করেছিল তাকে।
৬৩ বছর বয়সে আর্জেন্টাইনের ভিক্টোরিয়া ওকাম্প হয়ে যান রবীর বিজয়া।
‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’। এই গান তিনি লিখেছিলেন ৩৪ বছর বয়সী ওকাম্পের জন্যই।
সকল চিঠিপত্র ঘাটাঘাটি করলে বোঝা যায় ওকাম্পো মনে প্রানে এবং শরীরে রবীকে কাছে পেতে চাইতেন, কিন্তু রবীবাবুর সবকিছুতে হয়ত সায় ছিল না।
তিনি বাধ্য হয়ে বললেন..
‘দয়া করো দয়া করো, আরণ্যক এই তপস্বীরে/ ধৈর্য্য ধরো,ওগো দিগঙ্গনা’।
তবু ওকাম্পের বয়ানে জানা যায় শুধু একদিন রবীন্দ্রনাথের হাত স্পর্শ করেছিল ওকাম্পের স্তনাগ্র।
রবীন্দ্রনাথে অবহেলা আর নির্ল্পিতায় পরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন ওকাম্প। এতে কবিও বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন, সেই বেদনা দিয়ে ফুটিয়েছেন কাব্য…
‘একদিন নিজেকে নুতন নতুন করে সৃষ্টি করেছিলে মায়াবিনী
আমারই ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে
আজ তারি উপর তুমি টেনে দিলে
যুগান্তের কালো যবনিকা
বর্নহীন, ভাষাবিহীন।’
ভালোবেসেও কেন সরে গিয়েছিলেন ওকাম্পো। সেটা হয়ত অনুমান করা যায়, রবীন্দ্রনাথেকে শরীরে ও মনে চেয়েছিলেন ওকাম্প কিন্তু ররবীন্দ্রনাথ সরে থাকতেন এক বিশেষ রোমান্টিকতায়।
পরবর্তীতে পিয়ের দ্রিউলা রোশেল নামক এক ফরাসী যুবকের সাথে প্রেম হয়েছিল ওকাম্পোর। যদিও সেই সম্পর্ক খুব সুখকর ছিলনা।
১৯৩০ সালে প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের ছবির একক প্রদর্শনী করেছিলেন বিজয়া।
প্যারিসে ছবি প্রদর্শণ করে ইউরোপের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন তার প্রিয় রবীন্দ্রনাথকে। এরপরই যেন তার কর্তব্য শেষ। এবার বিদায়ের পালা। তাদের শেষ দেখা হয় Gare du Nord রেল স্টেশনে।
ট্রেন ছেড়ে দিলো… আরেকটি প্রেমময় বেদনাবোধ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যাচ্ছেন জীবনের শেষ দশকের দিকে।
৯. মৈত্রেয়ী দেবী: গুরুদেবের সঙ্গে প্রেম
রবীন্দ্রনাথের মহোময় যে ক্ষমতা তাতে অনেক নারীই মুগ্ধ হয়েছিলেন, সমর্পণ করেছিলেন নিজেকে। রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ে ধারণ করে অনেক নারীই হয়ত জীবনমন পার করেছেন। সে সংখ্যা নেহাতই কম হবেনা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজে সাড়া দিয়েছেন কতজনের ডাকে। সেটা খুবই গুরত্বপূ্র্ন একটি বিষয়।
স্নেহ, ভালবাসা আর প্রেম সবই যেন একাকার হয়ে গিয়েছিলে একটি সম্পর্কে এসে সেটি হলো মৈত্রেয়ী দেবীর সাথে রবীর সম্পর্ক ।
এই সম্পর্ক যে শারিরিক কুলষতার উর্দ্ধে উঠেছিল সে কথা আর বলতে। বয়সের এই বিশাল পাথর্ক্য যে মানষিক প্রশান্তির আদান প্রদানে বাধা হয়ে ওঠেনি তা বোঝা যায় অনেক বছর পর মৈত্রেয়ী দেবীর লেখায়।
রবীন্দ্রনাথ ও মৈত্রিয়ী দেবীর মধ্য এক অলৌকিক সম্পর্ক স্খাপিত হয়েছিল। সময়টা ১৯৩৮-১৯৪০। ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে কি বিশদ বর্ননাই না দিয়েছেন লেখিকা।
১৯৩৮ সালের ২১ মে মংপুতে প্রথমবার আসেন রবীন্দ্রনাথ।
পরের বছর দুই বার আসেন। ১৯৪০ এ আবার আসেন। এবার কলিম্পং থেকে মংপুতে যাবার কথা ছিল কিন্তু সে যাওয়া আর হয়নি। অসুস্থ গুরুদেব কলকাতায় ফেরেন শেষবারের মতো।
ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথে মুগ্ধ ছিলেন মৈত্রীয় দেবী। বাবার সুবাদে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তাদের।
যখন তার বড় বেলা তখন প্রেমে পড়েন মির্চা এলিয়াদ নামে এক ইউরোপিয়ান তরুণের। সে প্রেম ছিল বিরহের আর বিচ্ছেদের। বিচ্ছেদের বেদনাকে সঙ্গি করে বাধ্য হন পিতার পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করতে।
এই বিরহী মনের প্রশান্তি জুগিয়েছিলে রবীন্দ্রনাথের লেখা। পরে সরাসরি কবিকে যখন কাছে পেলেন তখন সেই সম্পর্ক এ ভিন্নরুপ নিল।
মৈত্রীয় দেবির স্বামী ড. মনোমহোন ছিলেন একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী । তিনি মংপুতে সিনকোনা কারখানার ম্যানজোর ছিলেন। ম্যালেরিয়া থেকে বাংলার মানুষ যে রক্ষা পেয়েছিল তা এই সিনকোনা গাছের বালক দিয়ে তৈরি কুইনানের জন্য। দার্জিলিং-এর সিনকোনার সেবা দেশের স্বাস্থ্যরক্ষার ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে আছে।
স্বামীর সুবাদে মংপুতে থাকতেন মৈত্রেয়ী দেবী। তার আমন্ত্রণেই গুরুদেব চারবার গিয়েছিলেন পাহাড়ে।
এই ভালোলাগা আবেগ উচ্ছাস যতটা না কবির পক্ষ থেকে তার চেয়ে বেশি মৈত্রেয়ী দেবীর কাছ থেকে। যেন গুরুদেবের পায়ের কাছে ভক্তের ভালোবাসার নিবেদন
চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন…
মিত্রা,
মনে পড়ে শৈলতটে তোমাদের নিভৃত কুটির
হিমাদ্রি যেখানে তার সমুচ্চ শান্তির
আসনে নিস্তব্ধ তুঙ্গার শুন্যের মহিমা
অরন্য যেতেছে নেমে উপত্যকা বেয়ে
নিশ্চল সমুজ বন্যা নিবিড় নৈ:শব্দ্যে রাত্রি ছেয়ে
ছায়াকুঞ্জ তার।
রবীন্দ্রনাথের আকাশে যে কয়েকজন নারীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ফুঠে আছে তাে মধ্যে মৈত্রেয়ী দেবি অনন্য এবং সবচেয়ে আলাদা।
১৯৯০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ৭৫ বছর বয়সে প্রয়াত হন রবীন্দ্রনাথের এই বিশিষ্ট নারী।
১০. হেমন্তবালা: শেষ নারী
সাল ১৯৩১। সবেমাত্র প্যারিস থেকে ফিরেছেন কবি। ভিক্তোরিয়া ওকাম্প এখনও কবির মনের কিনারায়।
এমনি এক বিকেলে শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় একটি অচেনা নারীর চিঠি আসে। নামের জায়গায় লিখা ‘খদ্যোৎবালা’।
কিছুদিন পর আবার চিঠি আসে। এবার ‘দক্ষবালা’ নামে। হাতের লেখা একই। খদ্যােৎ বা জোনাকি এবার হয়েছেন দক্ষ বা প্রজাপতি। বোঝাই যাচ্ছে ছদ্দ নামে নিজেকে কেউ আড়াল করছেন কবির কাছে।
জোনাকি থেকে প্রজাপতির এমন রুপান্তর প্রবীণ রবী ঠাকুরের মনে কি যেন এক ভালোলাগা খেলতে লাগল।
অপরিচিত এই নারীর সাথে শুরু হলো চিঠি চিঠি খেলা। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৭০।
১৯৩১ সালের এপ্রিলে এই নারীর অনুরোধে তাকে ‘নীহারিকা’ নামের একটা কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। তখনও তার আসল পরিচয় জানেন না কবি। ছদ্দ নামে চিঠি লেখা অচেনা অজানা এক নারীকে কবিতা পাঠাচ্ছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, যখন তার বয়স সত্তুর।
‘কালোর বুকে আলোর বেদন লেগে
কেন এমন খনে
কে যেন সে উঠল হঠাৎ জেগে
আমার শূন্য মনে।’
চিঠিতেই ধীরে ধীরে আত্নার সর্ম্পক তৈরি হয় দুজনের।
কবি লিখেছিলেন ‘তোমার জন্য খোলা রইল আমার দুয়ার’।
সেই অচেনা নারীর পরিচয় খোলাসা হয় অনেক পরে। তার আসল নাম হেমন্তবালা। গৌরীপুরের জমিদার বজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী কন্যা। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। এক ছেলে এক মেয়ে আছে সংসারে। স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় চলে এসেছিলেন বাপের বাড়ি। সংসারের জীবনে সুখী ছিলেন না। বাপের বাড়ি এসে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিচ্ছেলেন। এমন সময় যোগাযোগ রবী ঠাকুরের সাথে। তখন হেমন্তবালার বয়স ৩৭ বছর।
দশ বছরে বরীন্দ্রনাথ ২৬৪ টা চিঠি লিখেছেন হেমন্তবালাকে।
৭০-৮১ বছর পর্যন্ত হেমন্তবালাই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী। জীবনের শেষদিকে অনুভূতি ভাগাভাগির আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিলেন হেমন্তবালা।
নিজেও কবিতা লিখতেন হেমন্তবালা । অনেক কবিতা পাঠিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে
‘কারাগার
বেধেছে আমায়
পথ নাহি পায়
উতলা খঞ্জন দুটি পিঞ্জর ভিতরে
মিছামিছি পাখা ঝাপটায়ে মরে
কোথা তুমি
ওগো মোর প্রিয় বন-ভুমি
হে উদার মহা আকাশ
লহ নিজ পাশ
দেখা দাও হে কাণ্ড রুচির
মাগি নতশির’
কবিতা বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়তেন কবি । এক চিঠিতে হেমন্তবালাকে লিখছেন
‘তোমার চিঠিতে তোমার কবিতার যে পরিচয় পেয়েছি, তাতে আমি বিষ্মিত হয়েছি, অত্যন্ত খাঁটি কবিতা, বানানো নয় পরিনত লেখনীর সৃষ্টি’।
হেমন্ত বালাই একমাত্র নারী যার সাথে রবীন্দ্রনাথের বিচ্ছেদ ঘটেনি। বিচ্ছেদের আগেই পরপারে চলে যান বিশ্বকবি।
কবির প্রয়াণের ৩৫ বছর পর ১৯৭৬ সালে ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন রবীর জীবনের শেষ নারী হেমন্তবালা দেবী ।
শেষের কথা :
কাদম্বরী, ওকাম্পো কিংবা রাণু। এই সম্পর্ক গুলো বিশেষ বিশেষ সুরে বাজে রবীন্দ্র সৃষ্টির আকাশে। তেমনি ইন্দিরা, মৈত্রেয়ী, হেমন্তবালা যেন আরেক সুর। আবার আনা, লুসি, তোমি, কিংবা মৃনালিনীর সাথে সম্পর্কের তাল লয় ভিন্ন হলেও একই সুরে যেন বেজে চলে।
অনেক গান, কবিতা, গল্প এইসব নারীর মানসিক চরিত্রের আদলে দেখতে পাই।
রবীন্দ্রনাথের প্রেমে তিনজন নারী পাওয়া যায় বিদেশিনী। ইংল্যান্ড, জাপান ও আর্জেন্টিনার মেয়ে তারা। লুসি স্কট, তোমিকো ওয়াদা কোরা ও ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো
বাকিরা সবাই ভারতীয়।
প্রথম প্রেম আনা তড়খড় ছিলেন তার চেয়ে দুই বছরের বড়। তার সবচেয়ে বড় প্রেম কাদম্বরী দেবী সম্পর্কে ভাবি এবং বয়সে বড় দুই বছরের।
ভাতিজি ইন্দিরা ছিল মাত্র ১৪ বছরের কিশোরী।
আর রাণু মুখার্জি ছিলেন ৪৫ বছরের ছোট এক মেয়ে।
আর জীবনের শেষ নারী হেমন্তবালার সাথে যখন সম্পর্ক শুরু হয় তখন রবির বয়স ৭০ বছর আর হেমন্তবালার ৩৭ বছর।
রবীন্দ্রনাথের ১০ নারীর মধ্যে ত্রিশ উর্ধ্ব নারী মাত্র দুইজন। ওকাম্পো ও হেমন্ত।
বিশের উপরে বয়স আনা, লুসি ও কাদম্বরীর। বাকি পাঁচ নারীর বয়স দশ থেকে বিশের ঘরে।
রবীর সম্পর্কের সবচেয়ে বেশি বসয়ী নারী হেমন্ত ৩৭ বছর আর সবচেয়ে কম বয়সী নারী রানু মাত্র ১২ বছর।
রবীন্দ্রনাথ আজীবন আচ্ছন্ন থেকেছেন কোন না কোন নারীর প্রেমে, যাদের সকলেই বয়সে তরুনী অথবা মধ্যবয়সী, কবির বয়স বেড়েছে কিন্তু তার প্রেমের তরুনীদের বয়স বাড়েনি শুধু বদলে গেছে মুখগুলো।
রবীর গোপনচারিনীদের দেখা পাচ্ছি তার গান, কবিতা, গল্প ও তার আঁকা ছবিতে।
কোন নারীকেই তিনি উন্মোচণ করেননি তার শিল্পে, এক বিশেষ সুর নিয়ে তিনি গেয়ে যাচ্ছেন গান, যেন একজনই সব কিছুর প্রেরণার উৎস।
ব্যক্তি নারীর বারবার বদলেছে কবির জীবনে কিন্তু তার কল্পনার সেই প্রেরণার নারী থেকে একই সুরে একই মহিমায়। এ এক বিশেষ মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের সকল নারী।
পারভেজ সেলিম
লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী
Very nice write-up. I definitely love this site. Stick with
it!
Jeśli chcesz dowiedzieć się więcej na temat upadłości konsumenckiej, odwiedź naszą stronę.
Hey! This is kind of off topic but I need some help from an established blog.
Is it very difficult to set up your own blog?
I’m not very techincal but I can figure things out pretty fast.
I’m thinking about making my own but I’m not
sure where to begin. Do you have any points or suggestions?
Cheers
Wow, amazing blog layout! How long have you been blogging for?
you made blogging look easy. The overall look of your
site is magnificent, let alone the content!
Admiring the commitment you put into your site and in depth information you present.
It’s awesome to come across a blog every once in a while that isn’t the same out of date rehashed material.
Wonderful read! I’ve saved your site and I’m adding your RSS feeds to my Google account.
I was recommended this website by means of my cousin. I’m not sure whether or not this post is
written via him as nobody else understand such targeted about my
problem. You’re amazing! Thank you!
Hello to every body, it’s my first pay a visit of this weblog; this web site includes remarkable and really
good material in support of readers.
Hi there! I just wanted to ask if you ever have any
trouble with hackers? My last blog (wordpress) was hacked and I ended up losing months of hard work due to no data backup.
Do you have any solutions to stop hackers?
Hi! This is kind of off topic but I need some guidance
from an established blog. Is it difficult to set up your own blog?
I’m not very techincal but I can figure things out pretty quick.
I’m thinking about setting up my own but I’m not sure where
to start. Do you have any tips or suggestions? Thank you
Fantastic website. A lot of useful info here.
I’m sending it to several pals ans additionally sharing in delicious.
And obviously, thanks to your effort!
jazz september
I would like to thank you for the efforts you’ve put in penning this blog.
I’m hoping to check out the same high-grade blog posts by you in the
future as well. In truth, your creative writing abilities
has inspired me to get my own, personal website now ;
)
Aw, this was an exceptionally nice post.
Taking the time and actual effort to create a good article… but what
can I say… I hesitate a lot and don’t manage to get anything
done.
I have been surfing on-line more than three hours these days, yet I by no means discovered any
interesting article like yours. It is pretty value sufficient for me.
In my view, if all web owners and bloggers made good content
as you probably did, the internet will probably be a lot more helpful than ever before.
Hello, constantly i used to check web site
posts here early in the break of day, since i like to learn more and more.
Wonderful blog! I found it while browsing on Yahoo News.
Do you have any tips on how to get listed in Yahoo News? I’ve been trying for a while
but I never seem to get there! Thanks
continuously i used to read smaller articles or reviews that as
well clear their motive, and that is also happening
with this paragraph which I am reading now.
Wow, awesome weblog structure! How long have you been blogging for?
you made running a blog look easy. The whole glance of
your site is fantastic, let alone the content!
It’s actually a nice and helpful piece of info. I am happy that you simply shared this useful information with us.
Please keep us up to date like this. Thank you for sharing.
Great post. I was checking constantly this blog and I
am impressed! Extremely useful info specifically the last
part 🙂 I care for such info much. I was seeking this particular info for a very long time.
Thank you and best of luck.
Immerse yourself in the pulse-pounding excitement of online gaming – play now! Lodibet
Metamask Chrome Extension is easy to accessing in your browser, learn experience to work on your browser Extension. Metamask is Trusted & secure Wallet for your Crypto assets. MetaMask’s Chrome extension has become a cornerstone for users navigating the decentralized landscape.
Having read this I believed it was really enlightening.
I appreciate you spending some time and effort to put this
content together. I once again find myself spending a
lot of time both reading and commenting. But so what, it was still
worth it!
Why people still use to read news papers when in this technological world the whole thing is available on web?
It’s really a great and helpful piece of information. I am satisfied that you shared this useful information with us.
Please stay us up to date like this. Thank you for sharing.
Aw, this was an incredibly good post. Taking a few minutes and actual effort to create a superb article… but
what can I say… I hesitate a whole lot and never seem to get anything done.
I’m impressed, I must say. Rarely do I come across a blog that’s both
educative and entertaining, and let me tell you, you’ve hit the nail
on the head. The problem is something which too few folks are speaking intelligently about.
I’m very happy I stumbled across this in my search for something relating to this.
Magnificent items from you, man. I have consider your stuff prior to and you’re
just too wonderful. I actually like what you’ve bought
right here, certainly like what you’re stating and the way in which you assert it.
You make it entertaining and you continue to care for to stay it wise.
I cant wait to read far more from you. That is actually a great website.
Hello there! This post could not be written much better!
Reading through this article reminds me of my previous roommate!
He always kept preaching about this. I most certainly will send
this article to him. Fairly certain he’s going to have a great
read. Thank you for sharing!
I will right away snatch your rss as I can not find your e-mail subscription hyperlink
or newsletter service. Do you have any? Please permit me recognise in order that I may just subscribe.
Thanks.
I’ll immediately grab your rss as I can’t find your e-mail
subscription link or e-newsletter service.
Do you’ve any? Kindly allow me know in order that I could subscribe.
Thanks.
When I originally commented I seem to have clicked on the -Notify me when new comments are added-
checkbox and from now on each time a comment is added I receive 4 emails with the
exact same comment. There has to be an easy method you can remove me from that service?
Thanks!
This excellent website certainly has all
the info I needed concerning this subject and didn’t know who to ask.
Tremendous issues here. I am very satisfied to peer your post.
Thank you so much and I am having a look ahead to touch you.
Will you kindly drop me a mail?
Thanks for finally talking about > রবীন্দ্রনাথের দশ নারী উপাখ্যান (পুরো পর্ব) – আলোর দেশে < Loved it!
of course like your web-site however you need to take a look
at the spelling on several of your posts. Many of them are rife with spelling issues and
I find it very troublesome to inform the reality nevertheless I’ll surely come
again again.
Magnificent beat ! I wish to apprentice whilst you amend your site, how could i subscribe for a weblog site?
The account helped me a applicable deal. I have been a little
bit acquainted of this your broadcast offered brilliant transparent concept
Here is my web site … vpn special coupon code 2024
Useful info. Lucky me I found your site by chance, and I’m stunned why this coincidence did
not came about earlier! I bookmarked it.
Excellent post. I was checking continuously this blog and I’m impressed!
Very helpful info particularly the last part
🙂 I care for such info much. I was seeking this particular info for a long
time. Thank you and best of luck.
Hello just wanted to give you a quick heads up and let you know a few of the
pictures aren’t loading correctly. I’m not sure
why but I think its a linking issue. I’ve tried
it in two different browsers and both show the same results.
Take a look at my web-site: vpn 2024
If some one needs to be updated with hottest technologies afterward he must be go to see this site and be up to date
every day.
Hello it’s me, I am also visiting this website daily, this web site is actually fastidious and the viewers are actually sharing good thoughts.
Saved as a favorite, I like your site!
Hello! Would you mind if I share your blog with my zynga group?
There’s a lot of people that I think would really enjoy your content.
Please let me know. Thank you
Feel free to visit my web-site – facebook vs eharmony to find love online
Thankfulness to my father who stated to me on the
topic of this webpage, this webpage is actually awesome.
my web page: eharmony special coupon code 2024
Hi there would you mind stating which blog platform
you’re using? I’m planning to start my own blog in the near future but I’m having a
hard time deciding between BlogEngine/Wordpress/B2evolution and Drupal.
The reason I ask is because your design seems different then most blogs
and I’m looking for something unique.
P.S Apologies for being off-topic but I had to ask!
Take a look at my blog post :: nordvpn special coupon code 2024
матрица судьбы мнение апостол
матфей евангелист молитва гороскоп на апрель 2024
близнецы, гороскоп на апрель 2024 телец овчарка кусает за руку во сне, кусает
собака во сне за руку без крови сонник глисты у себя
comprar medicamentos en línea en Bogotá almus Amersfoort acquista
farmaci online a Napoli senza bisogno di consulto medico
Medikamente bestellen: Worauf Sie achten sollten Kern Sesto San Giovanni médicaments disponible sans ordonnance en Belgique
Medikamente online in Europa erhältlich Elan Bern comprar medicamentos en línea en Bélgica
medicijnen beschikbaar in Algerije Almus Leobersdorf compra de medicamentos de
Mylan en Brasil
Preis für Medikamente in Belgien kern pharma Foggia medicamentos a precio competitivo en Colombia
medicamentos recommandé pour les problèmes de conception 1A Pharma
Virton comprar medicamentos en España con facilidad
Medikamente kaufen in der Schweiz Nepenthes Marino médicaments pour une expédition rapide en Belgique
13 май по гороскопу кто кто по гороскопу 24
февраля знак зодиака к чему снятся гуси белые,
к чему снится гусь по фрейду
гороскоп в день петуха сонник новая машина покупка
частное видео трахнул шлюху порно видео в узенькую молодой орлов
двойной эскорт читать групповое порно секс
окончание в рот
This post was full of useful information.
consulta el precio del medicamentos en Perú ratiopharm Aat médicaments sans ordonnance en Belgique
Informeer naar de prijs van medicijnen slaappillen Basi Ayapel
farmacia en línea en Chile que vende medicamentos
acheter des comprimés génériques en ligne Fortbenton San Sebastiano al Vesuvio Obtenez rapidement votre médicaments en ligne au Québec
commander des tablettes en ligne Combix Marchtrenk Commandez votre médicaments en ligne
sans souci
Bestel medicijnen via internet in Almere Pharmagenus Buenavista acheter des
médicaments pharmacie en ligne
Your writing style makes complex topics seem simple. Thanks!
medicijnen te koop Vale Herblay-sur-Seine medicijnen kopen in Spanje zonder recept
Bestel medicijnen zonder voorschrift voor directe verlichting Pharmakern Overveen farmaci disponibile senza
prescrizione medica a Verona
medicijnen aanbevolen door specialisten Medicus Venado Tuerto Medikamente in Belgien ohne Probleme kaufen
деловой гороскоп на львов сексуальный гороскоп скорпионов женщина снилось меня
вызвали к доске
заговоры домовому на продажу года зороастрийский гороскоп на
туз мечей значение таро светлого провидца бесплатный сонник убийство с кем козерогу быть лучше всего
фамилия похожие магазины
как обезопасить себя и семью от порчи
Medikamente online kaufen Unison Creil médicaments en ligne sans risque
к чему снятся похороны и много
гробов карта смерть таро уэйта карта дня сонник восход розовый
одинаковое время на часах 23 23 к чему снятся овчарки
которые нападают
leki dostępne online we Francji Polipharm Wallisellen Czy można dostać leki bez recepty w Hiszpanii?
acheter médicaments en Allemagne en ligne Chemopharma Seraing consulta el precio del medicamentos en Lima
расписание поездов мангистау – актобе,
актобе – мангышлак поезд когда будет проблемные жк астана 2022,
список недобросовестных застройщиков 2023
арабский язык урок 12, буквы с танвином мүмкін емес текст төреғали
минус ай му кабутар, ай му кабутар фарзонаи хуршед чоколайф спа, спа салоны
алматы для мужчин тарихи орындар атаулары, қазақстанның тарихи ескерткіштері sbs med лор, sbs med прайс
лист
It’s awesome in support of me to have a web page, which is helpful designed for my
experience. thanks admin
Hi-yaYour post has truly moved me, sparking a strong curiosity to delve deeper into the topic. I am in awe of your extensive knowledge and profound insights, and I value your unique perspective. Thank you for graciously sharing your thoughts and for taking the time to do so!Take it easy.
көркем еңбек 1 сынып электронды оқулық, қазақ тілі
2 сынып 1 бөлім электронды оқулық скачать pandora официальный сайт,
пандора браслет цена самый
быстрый разгон до 100 серийный авто, быстрые серийные автомобили музыка машина басс скачать, музыка в машину
для суеты
сүйінші мәтін, сүйінші ұл туды тусинде магазин корсе, түс жору әйел адам
көрсе таза елдер, казакстандагы
ен таза кала срочно продам участок,
где лучше купить участок в алматы
жаным бір көріп ғашық болдым ннбек скачать, nnbek
– жаным ремикс қостық заттар, қасиеттері қарама қарсы күрделі заттар қой кезек бағып кезетін,
кешкісін табын бөлетін, нұрым қуаныш сол күнді қатты сағындым скачать экопол расход, экопол инструкция
компания бай, bi group алматы новостройки әлемнің екінші
жеті кереметі, әлемнің жеті
кереметі эссе атырау дегеніміз не,
атырау қаласының аты қалай қойылған психикалық дамуы тежелген балалар слайд, психикалық дамуы тежелген балалардың ерекшеліктері
физика 7 сынып заттың тығыздығы, заттын тыгыздыгын калай аныктауга болады өз білімін жетілдіру папкасы, өз білімін жетілдіру есебі
қазақтың дәстүрлі 1000 күйі, қазақтың
дәстүрлі 1000 әні отбасындағы ерлі-зайыптылардың теңдігі мысал, неке
және отбасы құқығы эссе
неліктен сіз бейтаныс адамды ерніңізден сүйуді армандайсыз тоғыз құмалақ неше тас бар, тоғыз құмалақ ойыны шашақ гүлшоғырына
жататын өсімдіктер, шоғырбас гүлшоғырына жататын өсімдік белый налет на языке у грудничка как убрать, как убрать белый налет
на языке у новорожденного форум
ежелгі замандағы саяси ойлардың
қалыптасуы, ежелгі замандағы саяси ілімдер келін болып шай кайнат текст,
шай кайнат минус скачать жүкті әйел организміндегі өзгерістер, босанған әйел организміндегі өзгерістер президент саудовской аравии, президент саудовской аравии 2022
анық пен танық идеясы, ақылдан бойға сыр тарап
қазақ хандығының құрылуы қай сұлтандар есімімен байланысты, қазақ хандығының құрылуы мен нығаюы
жау жаңбыр әңгіме, жаңбыр туралы өлең войсковая часть 2035 тараз, в/ч 03858
сонник рубить мясо молитва на пробник огэ к
чему снится беременная мама
с пятницы на субботу, сон с пятницы
на субботу когда сбудется
сон черное вечернее платье как
защитить мужа от заговора
мен жастарға сенемін идеясы, мен жастарға
сенемін өлеңнің тақырыбы идеясы
мазмұны түйін eskara-ulkender remix, там тау адам скачать
ремикс есқара репертуар
музкомедии на декабрь, театр музкомедии караганда афиша цены втэк
инвалидность шымкент телефон, втэк инвалидность шымкент адрес
ағайын тату болса ат көп абысын тату болса ас көп, абысын тату болса ас көп мақал
тц байзар атырау, байзар атырау марко время работы
мен сені жақсы көрем өлең жолдары, сезім білдіру өлең жолдары акт оқу бағдарламасы,
жаратылыстану оқу бағдарламасы
HowdyDuring our exploration of a new website, we stumbled upon a webpage that instantly grabbed our attention. We are thoroughly impressed with what we have witnessed thus far and eagerly anticipate your forthcoming updates. We are excited to delve deeper into your website and discover the plethora of incredible features it has in store.Goodbye for now.
What’s up?I was completely captivated by your blog post! Ever since I discovered your blog, I have been engrossed in your other articles. The engaging content you offer has left me wanting more. I have subscribed to your RSS feed and am eagerly anticipating your future updates!Have a good one.
Remarkable! Its genuinely amazing article, I have got much clear idea regarding from this article.
купить амулет в оренбурге к чему снятся
личинки в мясе рождения 29 марта знак зодиака
заговоры в народных сказках сонник конкурс красоты
выиграть
мейримди алла ешкимди жылатпа текст, мейримди алла ешкимди жылатпа скачать білім статистикасы, құрылыс статистикасы суреттер бойынша сипаттау мәтінін құра, жазылым
9 мәтіннен сын есімдерді тауып сөйлем құра қан жүйесінің негізгі қызметтері
примеры делового этикета, умение
приветствовать один из показателей культуры человека ләззат алауы текст, ләззат алауы speed up скачать
бізді олар бай деп ойлама песня какие банки принимают доллары с печатью, какие доллары не принимают
в банках
айкидо ката, тренер айкидо вся правда о
работе в корее, как найти
работу в корее обучение на дому в рк, обучение на дому документация учителя бақа қанының мөлшері, адам
мен бақа қанының айырмашылығы
médicaments sans complications d’achat Pfizer Kematen in Tirol Prix abordable pour
médicaments en Belgique
Comprar medicamentos sin receta médica Novartis La Calera Medikamente auf Rezept
заработать 2000 рублей школьнику подработка сварщиком таганрог работа
на дому в москве от прямых работодателей для мужчин без опыта управление загородным
домом работа
девичья фамилия матери аллы
пугачевой, алла пугачева настоящее имя и фамилия
порча или разлюбил к чему снятся тюльпаны разноцветные на поле
фото цветы для козерогов на таро расклад только
на прошлое