
পারভেজ সেলিম ।।
কবি জীবনানন্দের প্রথম কবিতার বই প্রকাশ পায় ১৯২৭ সালে। নাম ‘ঝরা পালক’। নিজ খরচে কবি প্রকাশ করেছিলেন তার প্রথম বই।
কেমন লিখলেন তিনি তা জানতে চেয়ে এক কপি বই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়ে সাহিত্যজগতের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। বইটি পড়ে উত্তরও পাঠান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। মাত্র কয়েক লাইনের এর উত্তর। চিঠিটি বেশ;
কল্যাণীয়েষু,
তোমার কবিত্ব শক্তি আছে তাতে সন্দেহ মাত্র নাই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে এত জবর দস্তি কেন করো বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহাসিত করে।
বড় জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উলটো ।
ইতি
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এমন একটি রুঢ় চিঠি পেয়ে হয়ত কষ্ট পেয়েছিলেন নতুন কবি। সে কষ্ট সামলে নিজেকে প্রস্তুত করেন তিনি।

চিঠির উত্তরে বিশাল এক কৈফিয়ত হাজির করেন জীবনানন্দ। সেখানে জীবনানন্দ বরীন্দ্রনাথের মুল্যায়নকে শ্রদ্ধার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। কেন প্রত্যাখ্যান করলেন তা যুক্তি দিয়ে উদাহরণ সহ বুঝিয়ে দেন।
একটি মাত্র বই প্রকাশ হয়েছে জীবনানন্দের তাতেই তিনি যেভাবে সাহিত্যজগতে প্রকান্ড সূর্যের মত এক কবির সাথে দ্বিমত পোষন করেছিলেন এবং নিজের সাহিত্যবোধের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন তাতেই বোঝা যায়, ব্যক্তিজীবনে যেমন দূর্বল চরিত্রের অধিকারিই হন না কেন সাহিত্যজগতে তিনি এক বিশাল শক্তি নিয়ে জন্মেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে উত্তর দিলেন এইভাবে।
শ্রীচরণেষু
আপনার স্নেহাশীষ লাভ করে অন্তর পরিপূর্ন হয়ে উঠেছে। আজকালকার বাংলাদেশের নবীণ লেখকদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য এই যে তাদের মাথার উপরে স্পষ্ট সূর্যালোকের মত আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীকে তারা পেয়েছে। এত বড় দানের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে হলে যতখানি গভীর নিষ্ঠার দরকার দেবতা পূজারীকে কখনও তার থেকে বঞ্চিত করেন না। কিন্তু দানকে ধারণ করতে হলে যে শক্তির প্রযোজন তার অভাব অনুভব করছি। অক্ষম হলেও শক্তির পূজা করা এবং শক্তির আশীর্বাদ ভিক্ষা করা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাধনা। আর আমার জীবনের আকিঞ্চন সেই আরাধ্য শক্তি সেই কল্যাণময় শক্তির উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। আশা করি এর থেকে আমি বঞ্চিত হব না।
পত্রে আপনি যে কয়েকটি কথা উল্লেখ করেছেন সেই সম্পর্কে দু-একটা প্রশ্ন আসছে। অনেক উঁচু জাতের রচনার ভেতর দু:খ বা আনন্দের একটা তুমুল তাড়না দেখতে পাই। কবি কখনো আকাশের সপ্তর্ষিকে আলিঙ্গন করার জন্য উৎসাহে উন্মুখ হয়ে ওঠেন- পাতালের অন্ধকারে বিষর্জর হয়ে কখনো তিনি ঘুরতে থাকেন। কিন্তু এই বিষ বা অন্ধকারের মধ্যে কিংবা এই জ্যোতির্লোকের ভিতরেও প্রশান্তি যে খুব পরিস্ফুট হয়ে উঠছে না তা তো মনে হয় না। প্রাচীন গ্রীকরা ‘সিনিরিটি’ জিনিষটার খুব পক্ষপাতী ছিলেন। তার কাব্যের ভিতর এই সুর অনেকভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু যে জায়গায় অন্য ধরনের সুর আছে, সে কাব্য ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে হয় না। দান্তের ডিভাইন কমেডির ভিতর কিংবা শেলীর ভিতর সিনিরিটি বিশেষ নেই। কিন্তু স্থায়ী কাব্যে অভাব এদের রচনার ভিতর আছে বলে মনে হয় না। আমার মনে হয় বিভিন্ন রকম বেষ্টনীর মধ্যে এসে মানুষের মনে নানা সময়ে নানা রকম ‘মুডস’ খেলা করে। সে ‘মুড’গুলোর প্রভাবে মানুষ কখনো মৃত্যুকেই বঁধু বলে সম্বোধন করে, অন্ধকারের ভেতরই মায়ের চোখের ভালোবাসা খুঁজে পায়, অপচয়ের হতাশার ভিতরে বীনার তার বাধবার ভরসা রাখে। যে জিনিষ তাকে প্রাণবন্ত করে তোলে অপরের চোখে হয়ত তা নিতান্তই নগন্য। তবু তাতেই তার প্রাণে সুরের আগুন লাগে ,- সে আগুন সবখানে ছেয়ে যায়। ‘মুড’-এর প্রক্রিয়ায় রচনার ভেতর এই যে সুরের আগুন জ্বেলে ওঠে, তাতে ‘সিনিরিটি’ অনেক সময়েই থাকে না_ কিন্তু তাই বলে তা সুন্দর ও স্থায়ী হয়ে উঠতে পারবে না কেন বুঝতে পারছিনা ।
সকল বৈচিত্র্যের মতো সুর বৈচিত্র্যও আছে সৃষ্টির ভিতর। কোন একটা বিশেষ ছন্দ বা সুর অন্য সমস্ত সুর বা ছন্দের চেয়ে বেশি করে স্থায়ী স্থান কি করে দাবি করতে পারে? আকাশের নীল রং, পৃথিবীর সবুজ রং, আলোর শ্বেত রং, কিম্বা অন্ধকারের কালো রং-সমস্ত রংগুলোরই একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ আছে। একটাকে অন্যটার চেয়ে বেশি সুন্দর ও সুচির বলা চলে বলে মনে হচ্ছে না। এই অন্ধকার, এই আলো, আকাশের নীল, পৃথিবীর শ্যামলিমা-এসবই তো সুচির-সুন্দর। সৌন্দর্য ও চিরত্বের বিচার তাই অন্য ধরনের বলে মনে হয়। ঘুড়ির কাগজের সবুজ, নীল, শাদা বা কালো রং যখন পৃথিবী, আকাশ, প্রভাত বা রাত্রির বর্ণের সৌন্দর্য ও স্থায়িত্বের দাবি করে বসে, তখন আর কোন প্রসঙ্গের প্রযোজন থাকে না। আমার তাই মনে হয়, রচনার ভিতর যদি সত্যিকার সৃষ্টির প্রেরণার অভাব থাকলে হয়ত তাও নিস্ফল হয়ে যায় । বিটোফেনের কোন কোন সিম্ফনী বা সোনাটার ভেতর অশান্তি আছে, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু আজো তা টিকে আছে-চিরকালই থাকবে টিকে, তাতে সত্যিকারের সৃষ্টির প্রেরণা ও মর্যাদা ছিলো বলে।
আমার যা মনে হয়েছে তাই আপনাকে জানিয়েছি। আপনার অন্তরলোকের আলোপাতে আমার ত্রুটি অক্ষমতা মার্জিত করে নেবেন আশা করি। আপনার কুশল প্রার্থনীয়। আপনি আমার ভক্তিপূর্ন প্রণাম গ্রহণ করুন।
প্রণীত
শ্রীজীবনানন্দ

এরপর ১৯৩৬ সালে কবির দ্বিতীয় কবিতার বই ’ধুসর পান্ডুলিপি’ প্রকাশ পায় । এই কবিতার বই প্রকাশের পর তিনি আবারও চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথকে ।
….
এবারও উত্তর দেন বিশ্বকবি। তবে রবীন্দ্রনাথের মুল্যায়ন এবার অসাধারণ।

তিনি বলেন,
‘তোমার কবিতাগুলি পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে , স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে’।
ইতি ১২/০৩/৩৭ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জীবনানন্দের কবিতার এ এক গভীর মুল্যায়ন। এক বাক্য আর কেউ মনে হয় এত স্পষ্ট করে জীবনানন্দকে মুল্যায়ন করতে পারেননি ।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বড় কবি। জীবনদশায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে আলোচিত,সফল এবং ব্যস্ততম মানুষ।
আর উল্টোদিকে জীবনানন্দ ছিলেন স্বল্পভাষী,কম জনপ্রিয়, অর্থকষ্টে জর্জরিত মানুষ। জীবনের সবকিছুর বিপরীতে তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন তার কবিতা এবং তার লেখাকে। এই দুই বিশাল বড় দুই কবির কখন দেখা হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের তেমন কোন প্রশংসা না পেলেও জীবনানন্দ সবসময় রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছেন সবচেয়ে বড় সম্মান এবং শ্রদ্ধা। তার চিঠিগুলো পড়লেই তা বোঝা যায়।
জীবনদশায় দুই ব্যক্তিকে তুলনা করা যেখানে হাস্যকর ছিল, আজ ৭০ বছরের মধ্যেই সেই রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি আরেকটি নাম উচ্চারিত হচ্ছে, আর সেটি হলো, জীবনানন্দ দাশ।
পারভেজ সেলিম ।।
লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী