বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’র তৃতীয় খন্ড

তৃতীয় খন্ড :

১.

৭৬ সাল শেষ হইল। দুই বছরে বাংলার ছয় আনা পরিমান মানুষ মারা গেল। তিন ভাগের একভাগ। 

৭৭ সালে সুবৃষ্টি হলো। যারা বেঁচে ছিল তারা পেট পুরো খেল। পৃথিবী শস্যশালিনী কিন্তু জনশূন্যা। দেশ জঙ্গলে পূর্ন হইলো।

বসুসতি বহু প্রসবিনী হইলেন, তবু আর ধান জন্মে না। কাহারও ঘরে ধান নাই। যে যাহার পায় কাড়িয়া খায়।

চর গ্রামে গিয়া যেখানে হিন্দু দেখে বলে ভাই বিষ্ণু পুঁজা করবি? এই বলিয়া ২০/২৫ জন জড়ো করিয়া মুসলমানের গ্রামে আয়া ুসলমানদের রে আগুন দেন। মুসলমানেরা প্রাণরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়, সন্তানেরা তাহাদের সর্বস্ব লুট করিয়া নূতন বিষ্ণুভক্তদিগকে বিতরণ করে।

মুসলমানরাজ্যের অরাজকতায় ও অশাসনে সকলে মুসলমানের উপর বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। হিন্দুধর্মের বিলোপে অনেক হিন্দুই হিন্দুত্ব স্থাপনের জন্য আগ্রহ চিত্ত ছিল। অতএব দিনে দিনে সন্তান সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে থাকলো।

ওয়ারেণ হেস্টিংস ভারতের গভর্নর জেনারেল তখন।

সন্তানদের এমন বিদ্রোহ দমনের জন্য কাপ্তেন টমাসকে অধিনায়ক করে একদল সৈন্যসহ প্রেরণ করিলেন।

রাজার সৈন্য, জমিদারদের সৈন্য ও কোম্পানীর সৈন্য মিলায়ে দলে দলে ভাগ করে বিভিন্ন দেশে পাঠায় দিলো বিদ্রোহ দমনের জন্য। 

২.

তখন কোম্পানীর অনেক রেশমের কুটির ছিল। শিবগ্রামে যে কুটির তার অধ্যক্ষ ছিলেন ডনিওয়ার্থ।

সেখানে যাবার সময় টমাসের গাড়ি বোঝাই রসদ আক্রমণ করেছিল সন্তানেরা। টমাস কলকাতায় রিপোর্ট  পাঠায় ১৫৭ জন সিপাহী নিয়ে ১৪৭০০ বিদ্রোহী পরাজয় করা গিয়াছে। বিদ্রোহীগনের মধ্যে ২১৫৩ জন মরিয়াছে, আর ১২৩৩ জন আহত হইযাছে। ৭ জন বন্দি হইয়াছে। কেবল শেষ কথাটি সত্য।

টমাস বিদ্রোহ দমন করিয়া আনন্দে বেড়াইতে লাগিলো। 

একদিক শিকার করতে বনের গভীরে যেতেই দেখা মিলল শান্তির সাথে। 

বন্দুকে সানে শন্তির য়হীন কথাবার্তা টমাসের পছন্দ হয়। তাকে উপপত্নী করে ঘরে নিয়ে যেতে চায়।

শান্তি উল্টো টমাসকে তার কোটরে বাদর সাজিয়ে রেখে কলা খাওয়াতে চায়।

শর্ত দেয় যদি ইংরেজরা যুদ্ধে জিতে তবে সে উপপত্নী হইবে আর যদি হারে তবে টমাসকে বাদর সাজাইবে।

৩.

শান্তি সাহেবকে ত্যাগ করে দ্রুত বনের মধ্যে প্রবেশ করে গান গাইতে থাকিলো।

‘এই যৌবন-জলতরঙ্গে রোধিবে কে? 

হরে মুরারে! হরে মুরারে! 

দুরে সারঙ্গ বাজাতে লাগলো কেউ। শান্তি গিয়া দেখলো জীবানন্দ।

দুজনে নানা কথা হইলো।

ইহকালের জন্য যে বিবাহ, মনে করো, তাহা আমাদের হয় নাই। আমাদের বিবাহ কেবল পরকালের জন্য।

তুমি আমায় ভালোবাসো, আমি তোমায় ভালোবাসি, ইহা অপেক্ষা ইহকালে আর কী গুরতর ফল আছে?  বলো ‘বন্দে মাতরম’। দুজনে গাইতে থাকলো।

৪.

ভবানন্দ একদা নগরে গিয়ে উপস্থিত হইলো।

বড় রাজপথ থেকে ভিতরে এক গলির ভিতর দুতলা বাড়ি। সেখানে ঢুকে এক অর্ধবযস্ক নারীর সাথে কথোপোকথন হলো। নাম গৌরি। বিধবা। ভবানন্দ ডাকে ঠাকুরণ দিদি নামে।

পরে দেখা হয় কল্যানীর সাথে। দীর্ঘ কথোপোকথন হয় সেখানে। 

কল্যাণীকে বিবাহ করিতে চায় ভবানন্দ। সন্তানধর্ম ত্যাগ করতেও ইচ্ছুক।

সন্তানধর্ম আমার প্রাণ, কিন্তু আজ প্রথম বলি, তুি আমার প্রাণাধ প্রাণ। যেদি তোমার প্রাণদান করিয়াছিলাম সেদিন হইতে আমি তোমার পদমুলে বিক্রীত। 

আমি জানিতাম না যে সংসারে এ রুপরাশি আছে। এমন রুপ রাশি কখনো চক্ষে দেখিবো জানিলে, কখনো সন্তান ধর্ম গ্রহন করিতাম না। এই ধর্ম আগুনে পুড়িয়া ছাই হয়। ধর্ম পুড়িয়া গিয়াছে, প্রাণ আছে। আজি চারি বৎসর প্রাণও পুড়িতেছে, আর থাকে না! দাহ! কল্যানী দাহ! জ্বালা! কিন্তু জলিবে যে ইন্ধন,তাহা আর নাই। প্রাণ যায়। চারি বৎসর সহ্য করিয়াছি, আর পারিলাম না। তুমি আমার হইবে? 

কল্যানী রাজি নয়। সে কন্যাকে ফেরত চায়। ভবানন্দ সাশ্রুলোচনে বলে ‘দিবো, আমি মরিয়া গেলে আমায় মনে রাখিবে কি? 

কল্যানী বলে ‘রাখিব। ব্রতচ্যুত অধর্মী বলিয়া মনে রাখিব’

ভবানন্দ বিদায় হইল, কল্যানী পুঁথি পড়িতে বসিলো।

৫.

ভবানন্দ ভাবিতে ভাবিতে মঠে চলিল। যেতে যেতে রাত হলো। বনের মধ্যে একাকী প্রবেশ করিলো। পরে দেখল তার সঙ্গে আরেকজনও যাচ্ছে। ধীরানন্দ।

দুজনে কথা চলে অনেকক্ষন। কল্যানীর বিষয়টা ধীরানন্দ ত জানে, তাকে বিবাহ করতে বলে।

এই নিয়ে তর্ক হয়। 

ভবানন্দ বলে, আইস এই নির্জন স্থানে দুজনে যুদ্ধ করি। হয় তোমাকে বধ করিয়া আমি নিষ্কন্টক হই, নয় তুমি আমাকে বধ করিয়া আমার সকল জ্বালা নির্বাণ কর। অস্ত্র আছে? 

পরে ধীরানন্দ একটা প্রস্তাব করে, এই সন্তানসেনা তোমার আজ্ঞাধীন- সত্যানন্দ এখন এখানে া, তুমি ইার নায়ক। তুমি এই সেনা লইয়া যুদ্ধ কর, োমার জয় হইবে,ইহা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যুদ্ধে জয় হইলে তুমি কেন স্বনামে রাজ্য স্থাপন করো না।

তুমি রাজানহও কল্যানী তোমার মন্দোদরী হউক, আমি তোমার অনুচর হইয়া স্ত্রী-পুত্রের মুখাবলোকন করিয়া দিনপাত করি, আর আশীর্বাদ করি। সন্তানধর্ম অতল ডুবাইয়া দাও।

ভবানন্দ উত্তর দিলো, তুমি আমাকে বিশ্বাসঘাতক হইতে পরামর্শ দিয়াছ। নিজেও বিশ্বাসঘাতক,তোমাকে মারিলে ব্রক্ষ্মহত্যা হয় না, তোমাকে মারিব।’

ধীরানন্দ কথা শেষ হইতে না হইতে ঊর্ধ্বশ্বাস পলায়ণ করিলো।

৬.

মঠে না গিয়ে ভবানন্দ গভীর বনমধ্যে প্রবেশ করিলো।

নিজের কৃতকর্মে অনুশুচনা হইলো। বলিল ‘আমায় ধর্মে মতি দাও, আমায় পাপ হইতে নিরত করো।

কে যেন বলিল ‘ধর্মে তোমার মতি থাকিবে- আর্শিবাদ করিলাম।

ভবা চিনিলেন প্রভু সত্যানন্দ প্রত্যাগমন করিয়াছেন।

৭.

জীবনান্দ কুটির হতে বাহির হয়ে গেলে পরে শান্তি দেবি মৃদু মৃদু গীত করিতে লাগিলো।

‘প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম

বিহিতবহিত্রচরিত্রমখেদম

কেশব ধৃতমীন শরীর

জয় জগদীশ হরে’।

সত্যান্দের সাথে শান্তির বিস্তর কথা হলো। শেষে বলিল, 

‘আমি কেবল দেশকে মা বলিয়াছি,আর কাহাকেও মা বলি নাই; কেননা, সেই সুজলা সুফলা ধরণী ভিন্ন আমরা অনন্াৃক। আর তোমাকে মা বলিলাম, তুমি মা হইয়া সন্তানের কা কর, যাহাতে কার্যোদ্ধার হয়, তাহা করিও, জীবানন্দের প্রাণরক্ষা করিও, তোমার প্রাণ রক্ষা করিও।’

৮.

সন্তানদের মধ্যে সংবাদ প্রচার হইল সত্যানন্দ ফিরিয়া আসিয়াছেন।

একে একে দশ হাজার সন্তান জড়ো হলো।

সত্য জানাইলো,টমাসনামে এক বিধর্মী দুরাত্মা বহুতর সন্তান নষ্ট করিয়াছে। আজ রাতে তাহাকে সসৈন্যে বধ করিব।

তবে সেজন্য একটু ধৈয্য ধরিতে হইবে। পদচিহ্ন দূর্গ হতে ১৭ টি কামান আসিতেছে। কামান পৌঁছাইলে যুদ্ধ যাত্রা করিব।

ভোর চারটা দিকে হঠাৎ চারিদিকে কামান তোপের আওয়াজ হইতে লাগিল। ইংরেজদের তোপ।

৯.

ইংরেজরা মঠ আক্রমণ করিয়াছে। জীবানন্দকে সেনাপতি বানাইয়া যুদ্ধ  শুরু করিতে বলিলো সত্যানন্দ।

যুদ্ধ শুরু হইলো। 

ইংরেজদের তোপের আঘাতে সন্তানদের প্রাণ যেতে লাগিলো।

ভবানন্দ, জীবনান্দ, শান্তি প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে লাগিলো।

১০.

এভাবে চলতে থাকিলে সকলে মারা পড়িবে। তাই সন্তানেরা দুই ভাগ হইলো।  জীবানন্দের নেতৃত্বে একদিল পুল পার হইয়া চলিয়া যেত চাইল।

আরেকদল ভবানন্দের নেতৃত্ব যুদ্ধ করিতে লাগিলো।

১১.

ধীরে ধীরে সকলে ইংরেজ সেনাদের দিকে মুখে রেখে পুলের দিকে যাবার নির্দেশ দিলো।

পরে জীবনান্দ, ভবানন্দ, ধীরানন্দ একসাথে হইয়ে ইংরেজদের তোপ দখল করিলো।

ইংরেজরা সেই তোপের আঘাতে  মরে লাগিলো।

েষ পর্যন্ত কাপ্তেন হে ও ওয়াটস ভবানন্দের নিকট বলিয়া পাঠাইল আমরা সকলে তোমাদিগের নিকট বন্দি হইতেছি, আর প্রাণীহত্যা করিও না।

যুদ্ধ করতে করতে ধীরানন্দ কালকের গোপন কথাটা ফাঁস করিয়া দিলো।

যে কল্যানীর সাথে তোমার যে সকল কথা হইয়াছিল, তাহা সত্যানন্দ স্বকর্নে শুনিয়াছিলেন।

তখন তিনি স্বয়ং সেখানে ছিলেন, তিনি কল্যানীকে গীতা পড়াইতেছিলেন।

যুদ্ধে তখন ভবানন্দের প্রথমে ডান হাত কাটা পড়ে পরে বাম হাত।

ভবানন্দ মুখে ‘বন্দে মাতরম’ গায়িতে গায়িতে, মনে বিষ্ণুপদ ধ্যান করিতে করিতে প্রাণ ত্যাগ করিলেন। 

১২.

রণজয়ের পর সকলে আনন্দ করিতে লাগিলো, সত্যানন্দ তখন বিমর্ষ ভবানন্দের জন্য।

সকলে গিয়া ভবানন্দের সৎকার করিলেন।

সত্যানন্দ, জীবনান্দ, মহেন্দ্র, নবীনান্দ, ও ধীরানন্দ পাঁচজনে পরামর্শ করছেন।

হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা হইলো।

মহেন্দ্রকে সংসারি হইতে বলিলো।

স্ত্রী সন্তানের সাথে দেখা করার জন্য শান্তির সাথে চলিয়া গেল।

এরপর রাত শেষে ভোরে নতুন কে একজন আসিলো। সত্যানন্দ বললেন, হে প্রভু! আজ ক্ষমা করুন! আগামী পূর্নিমায় আমি আপনার আজ্ঞা পালন করিবো।’

তৃতীয় খন্ড শেষ হলো।

( চলবে…)


 ‘আনন্দমঠ’ পুোটা পড়ুন :

আনন্দমঠ: মুসলিম বিদ্বেষ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্ম

আনন্দমঠ: কেন এত বিতর্কিত?

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’র প্রথম খন্ড

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’র দ্বিতীয় খন্ড

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’র তৃতীয় খন্ড

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’র চতুর্থ খন্ড

৭৩ thoughts on “বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’র তৃতীয় খন্ড

  1. First of all I would like to say awesome blog!
    I had a quick question that I’d like to ask if you don’t
    mind. I was interested to know how you center yourself and clear
    your head before writing. I’ve had a tough time clearing my
    mind in getting my ideas out. I do enjoy writing but it just seems like the first 10 to 15 minutes tend
    to be lost simply just trying to figure out how to begin. Any suggestions or hints?
    Kudos!

    my web site :: vpn special coupon

  2. เพราะโดนเฟสบุคปิดกั้นบ่อยๆ ทำให้คนกดไลค์กดแชร์น้อย บทความนี้จึงอยากจะมาแนะนำ บริการปั้มไลค์ทำอย่างไร มาบอกเหตุผลว่าทำไมการปั๊ม ผู้ ติดตาม facebook ถึงมีความสำคัญ หรือใครที่อยาก ปั้มไลค์เฟส ให้ได้สักหลักพันหลักหมื่นให้ไว บริการปั้มไลค์สามารถทำได้ไหม ปั้มไลค์แล้วยอดผู้ติดตามไม่มีลด อยากเป็นที่รู้จักแพร่หลายไว อยากให้ร้านดังสินค้าขายดี บริการปั้มไลค์สามารถช่วยให้ร้านของคุณมีความเคลื่อนไหวมากขึ้นฟีดอัพเดทบ่อย เมื่อโปรไฟล์ของคุณอัพเดทอยู่เรื่อยๆอัลกอริทึมก็จะประมวลผลเห็นผู้คนพบเจอ facebook ของคุณได้มากขึ้น เป็นอีกหนึ่งช่องทางในการขาย https://thip-like.com/

  3. Ankara’daki avukatlar, çeşitli hukuk dallarında uzmanlaşarak hizmet verirler. Ceza hukuku, ticaret hukuku, aile hukuku, iş hukuku ve idare hukuku gibi alanlarda uzmanlaşan avukatlar, müvekkillerine en doğru ve etkili çözümleri sunarlar. Hukukun her dalında güncel bilgilere hakim olan bu avukatlar, müvekkillerinin haklarını en iyi şekilde savunmak için titizlikle çalışırlar.

  4. أنابيب الألمنيوم في العراق يتفوق مصنع إيليت بايب في توفير أنابيب الألمنيوم عالية الجودة في العراق. معروفة بخفتها وخصائصها المقاومة للتآكل، تعد أنابيب الألمنيوم لدينا مثالية لمجموعة من التطبيقات، من البناء إلى النقل. تضمن طرق الإنتاج المتقدمة المستخدمة في مصنع إيليت بايب أن تكون أنابيب الألمنيوم لدينا قوية وموثوقة، تلبي متطلبات مختلف الصناعات. كاسم رائد في القطاع، تظل مصنع إيليت بايب مكرسة لتقديم منتجات متفوقة وخدمة استثنائية. لمزيد من التفاصيل حول أنابيب الألمنيوم لدينا، يرجى زيارة موقعنا الإلكتروني على ElitePipe Iraq.

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x