পঞ্চম ফিতনা: সামাররায় নৈরাজ্য


পারভেজ সেলিম


আব্বাসীয় খিলাফতের একশ দশ বছরের শাসনকাল পার হয়েছে। ততদিনে মুসলমানদের রাজধানী বাগদাদ থেকে সরে সামাররায় চলে গেছে। খলিফাদের উপর তুর্কী সেনাদের কতৃত্ব প্রচন্ড রকম বেড়েছে। এমন সময় ৮৬১ সালে আব্বাসীয়দের দশম খলিফা আল মুতাওয়াক্কিল নিহত হন তারই তুর্কী সেনাদের হাতে। এরপর শুরু হয় ভয়াবহ এক গৃহযুদ্ধ।

৮৬১ থেকে ৮৭০ এই নয় বছরে মোট পাঁচজন খলিফা হত্যার শিকার হন। ক্ষমতার কেন্দ্র তখন চরকির মতো ঘুরছে। খলিফাদের অনুগত সৈন্য আর অনুসারিরা নিজেদের মধ্যে মারামারি আর হত্যাকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে। রাজধানী সামাররা তখন এক নৈরাজ্য আর নৃশংসতার শহর। ইতিহাসের এই নয় বছর ‘সামাররার নৈরাজ্য’ নামে পরিচিত ।

সামাররার নৈরাজ্য চলাকালিন মাঝামাঝি সময় ৮৬৫ থেকে ৮৬৬ এই এক বছর খলিফা মুসতাইন ও মুতাজের সমর্থকদের মধ্যে  ব্যাপক আকারে যুদ্ধ, অবরোধ ও হত্যাকান্ড ঘটতে থাকে। ক্ষমতার জন্য আব্বাসীয় দুই চাচাতো ভাই এর এই রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ ’আব্বাসীয়দের গৃহযুদ্ধ’ বা ‘পঞ্চম ফিতনা’ নামে পরিচিত।

এই ফিতনা শেষে আল মুতাজ সামারা ও বাগদাদে মুসলমানদের একক খলিফা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ।

পটভুমি :

৮৩৩ সালে মৃত্যু বরণ করেন আব্বাসীয় খিলাফতের শেষ প্রভাবশালী খলিফা আল মামুন। তার মৃত্যুর পর অষ্টম খলিফা হিসবে ক্ষমতায় বসেন তার পুত্র আল মুতাসিম (৮৩৩-৮৪২) । মাত্র নয় বছরের ক্ষমতায় তিনি যে কয়েকটি কাজ করেন তা ইসলামের গতিপথ বদলে দেয়।

মুতাসিম ক্ষমতায় বসে সেনাবাহিনীতে  তুর্কি সেনার আধিক্য বাড়িয়ে ফেলেন। পরবর্তীতে ক্ষমতার কেন্দ্রে তুর্কীদের প্রভাব এতটাই বেড়ে যায় যে ৮৩৬ সালে রাজধানী বাগদাদ থেকে সরিয়ে সামারায় করতে বাধ্য হন তিনি । শুরু হয় আব্বাসীয় খিলাফতে তুর্কী যুগ।

৮৩৬ -৮৯২ আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী ছিল সামাররা। খলিফারা তখন বিভিন্ন বিদ্রোহী সামরিক গোষ্ঠীর হাতের পুতুলে পরিণত হতে শুরু করেছেন।

খলীফা আল-মুতাসিমের পর, আল ওয়াসিক (৮৪২-৮৪৭), ও আল মুতাওয়াক্কিল (৮৪৭-৮৬১) সিংহাসনে আরোহণ করেন।

এই খলিফাদের মধ্যে মুতাসিমের রাজত্বকাল ছিল অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধশালী। আল-ওয়াসিক ছিলেন শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক এবং আল-মুতাওয়াক্কিল ছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামীতে আচ্ছন্ন এক শাসক। যদিও তিনি ইসলামের মুতাজিলা নামে এক বিতর্কিত ধর্মীয় ধারার উৎখাত করেছিলেন। তিনি আরবদের নীরো বলে খ্যাত ছিলেন ।

৮৬১ সালে মুতাওয়াক্কিলের হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতায় বসেন তার পুত্র আল মুনতাসির ( ৮৬১-৮৬২) । তাকেও ছয় মাসের মাথায় বিষ প্রযোগে হত্যা করা হয়।

তুর্কী সেনারা এরপর ক্ষমতায় বসান তার চাচাতো ভাই মুসতাইনকে (৮৬২-৮৬৬)।

 এসময় তুর্কি সেনাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। কেউ সমর্থন করেন মুসতাইনকে আর কেউ কেউ চান নতুন খলিফা । সংকট এমন ঘনিভূত হয় খলিফা মুসতাইন সামাররায় অবস্থান করাই বিপদজনক হয়ে উঠেছিল ।

এসময় তিনি কিছু তুর্কি সেনাপ্রধান ও বাগদাদের গভর্নর তাহিরির সাহায্যের আশ্বাসে তিনি ৮৬৫ সালে বাগদাদে চলে যেতে সক্ষম হন।

এবার সামারায় তুর্কি সেনাদের বাকি অংশ আল মুতাজকে নতুন খলিফা নির্বাচন করেন। তখনও খলিফা থেকে পদত্যাগ করেননি মুসতাইন।

এক সঙ্গে তখন মুসলিম বিশ্বে দুই খলিফা। বাগদাদে মুসতাইন আর সামাররায় মুতাজ। এক কঠিন সংকটের মুখে পড়ে মুসলিম শাসন কেন্দ্র ।

একক খলিফা নির্ধারণের জন্য যুদ্ধ তখন অবসম্ভাবী হয়ে পড়ে।

মুতাজ সমর্থিত তুর্কী সৈন্যরা এবার বাগদাদ অবরোধ করে। অনেক আলাপ আলোচনায় শেষ পর্যন্ত ফলাফল না হওয়ায় তাহিরি সমর্থিত মুসতাইন ও তুর্কী সেনা সমর্থিত মুতাজের অনুসারিরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

এক বছর ব্যাপি চলা এসব যুদ্ধে বেশিভাগই হয়েছে বাগদাদে। কয়েক হাজার মুসলমান নিহত হয় দু পক্ষের । ইসলামে যা ‘পঞ্চম ফিতনা’ নামে পরিচিত হয়ে আছে ।

 শেষ পর্যন্ত মুসতাইন পরাজিত হয় এবং তাকে হত্যা করা হয় ।

আল মুতাজ এককভাবে ১৩ তম আব্বাসীয় খলিফা হন। এর ফলে ক্ষমতা আবারো ফিরে আসে মুতাওক্কিলের সন্তানদের কাছে। তিনি সক্ষম ও শক্তিশালী ছিলেন। মাত্র তিন বছরের মাথায় ৮৬৯ সালের জুলাই মাসে তাকেও ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করা হয়।

কিন্তু তাতেও সামাররায় নৈরাজ্য থামেনা।

এবার ক্ষমতায় বসানো হয় মুতাজের আরেক চাচাতো ভাই মুহতাদিকে (৮৬৯-৮৭০)। তিনিও খলিফার কর্তৃত্ব শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন কিন্তু ৮৭০ সালের জুন মাসে তাকেও হত্যা করা হয়।

এরপর ক্ষমতায় বসেন মুতাওয়াক্কিলের তৃতীয় সন্তান আল মুতামিদ (৮৭০-৮৯২)। তার  ক্ষমতা লাভের পর মুসা ইবনে বুগা কেন্দ্রীক তুর্কি অংশ খলিফার দরবারের প্রধান অংশ হয়ে উঠেন। এর মাধ্যমে নৈরাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে। শেষ হয় ৯ বছরের সামাররার নৈরাজ্য।

শেষ কথা :

ইসলামে ৫ টি ফিতনা গুরুত্বপুর্ন বিবেচনা করা হয়। তার তিনটিতে যুক্ত ছিলেন আব্বাসীয়রা। এজন্য প্রথম তিনটি ফিতনাকে ‘মুসলমানদের গৃহযুদ্ধ’ বলা হলেও শেষের দুটি ফিতনাকে বলা হয় ‘আব্বাসীয়দের গৃহযুদ্ধ’।

৩৭ জন খলিফা পাঁচশো ৮ বছর ধরে মুসলমানদের শাসন করেন। ৭৫০ সালে শুরু হওয়া আব্বাসীয় খিলাফত  নৃশংস মঙ্গোলিয় নেতা হালাকু খানের হাতে শেষ হয় ১২৫৮ সালে। এরপর খিলাফতের ধারণা দুর্বল হতে থাকে। ইসলামে খিলাফত  শাসন ব্যবস্থা  নামে মাত্র টিকে থাকে  বিশ  শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত।


পারভেজ সেলিম

লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী


আরো দেখুন :

One thought on “পঞ্চম ফিতনা: সামাররায় নৈরাজ্য

  1. Thank you so much for providing individuals with an extraordinarily breathtaking possiblity to read articles and blog posts from here. It is often so kind and full of fun for me personally and my office co-workers to visit the blog at the very least 3 times per week to see the fresh things you have. And lastly, we are actually astounded with your wonderful creative ideas you give. Selected 2 tips in this article are certainly the simplest I have had.

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x