
পারভেজ সেলিম ।।
সাল ১৮৯৯। নতুন এক শতাব্দীর শুরুর সন্ধিক্ষণ। বরিশালের বামনকাঠি নামের নির্জন এক গ্রামে জন্ম নিল এক শিশু। পরের মাত্র ৫৬ বছরে যিনি হয়ে উঠবেন বাংলা কবিতার এক আসামান্য স্রষ্টা। নিজের জীবনদশায় যিনি অবেহেলা, বঞ্চণা আর অর্থকষ্টে কাটিয়ে দিবেন আর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে থাকবেন বাংলার এক প্রধান বিশুদ্ধতম কবি। তার নাম জীবনানন্দ দাশ।
বাবা সত্যানন্দ ঢাকা বিক্রমপুরের লোক ছিলেন। দাদা সর্বানন্দ দাশ বরিশালে গিয়ে স্থায়ী হয়েছিলেন, পরে যিনি সেখানকার ব্রাক্ষ্ম সমাজের পুরোধা ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন।

মা কুসুমকুমারি দাস নিজেও ছিলেন একজন কবি। সেই সময় বরিশাল থেকে কলকাতায় গিয়ে বেথুন স্কুলে পড়াশুনাও করেছিলেন। ছেলের কবিতার হাতেখড়ি মায়ের কাছেই। যিনি লিখেছিলেন ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে হবে কবে কথা না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ’। যেন কবিতার মতো তার সন্তান কথায় না কাজেই বড় হয়ে উঠেছিলেন।
ছোটবেলা জীবনানন্দ দাশের ডাক নাম ছিল মিলু। জন্মের পরেই ভয়াবহ জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হন মিলু। হাওয়া বদল ছিল তার একমাত্র চিকিৎসা। জন্মের বছরেই মা তাকে নিয়ে ট্রেনে চেপে বের হয়েছিলেন লৌখনো, দিল্লি, আগ্রা ঘুরতে। মায়ের চেষ্টায় শেষে সুস্থ হয়ে বরিশালে ফিরেছিলেন ছিলেন কবি।
অসুস্থতার কারণেই হয়ত স্কুল দেরিতে শুরু করেন মিলু। পড়াশুনা শুরু করেন মায়ের কাছেই, পঞ্চম শ্রেনীতে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হন বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে। সময়টা ১৯০৮ সাল।

১৯১৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন প্রথম বিভাগে। সে বছরই ছোট ভাই অশোকানন্দের জন্ম হয়। পরে ব্রজমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রথমবারের মতো বরিশাল ছেড়ে চলে যান তিনি।
১৯১৯ সালে ইংরেজীতে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। সে বছরে ব্রক্ষ্মবাদী পত্রিকায় ‘বর্ষা-আবাহন’ নামে প্রথম কবিতা প্রকাশ পায় বৈশাখী সংখ্যায়। তখন বয়স ২০। কবিতাটি নিজ নামে নয়, ছাপা হয় শুধু ‘শ্রী’ নামে। এটিই কবি জীবনানন্দ দাসের প্রকাশিত প্রথম কবিতা।
…এস এস ওগো নবীন,
চলে গেছে জীর্ণ মলিন
আজকে তুমি মৃত্যু-বিহীন
মুক্ত-সীমা-রেখা।
(বর্ষা-আবাহন)

বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পথ চলা শুরু। পরের ৩৫ বছর চলবে জীবনের গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা, আর বিপন্ন বিষ্ময়ের কাছে নিজেকে সমর্পন এবং তা প্রকাশের মধ্য দিয়ে অনন্তের দিকে যাত্রা করবেন এক নির্জন বিশুদ্ধতম কবি।
১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করে আইন বিভাগে পড়াশুনা শুরু করেন কবি কিন্তু সেটি আর শেষ করা হয় না।
দু’বছর পর ১৯২২ সালে চাকরি পান সিটি কলেজে। কলেজ টিউটর হিসেবে। জীবনের প্রথম চাকরি। কিন্ত সেটি বেশিদিন করা হয়না।
এরপর তিনি আরো ৬ টি কলেজে চাকরি করবেন। কোনটি তিনি নিজে ছাড়বেন, কোনটি থেকে তাকে ছাঁটাই করা হবে। কখনো কখনো তিনি বেকার থাকবেন। তবে তার জীবনের শেষ হবে কলেজের অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে।
প্রথম কবিতা লেখার পাঁচ বছর পর তিনি লিখবেন তার ২য় কবিতা। ১৯২৫ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুতে তাকে নিয়ে লেখা কবিতা প্রকাশ পায়। কল্লোল পত্রিকায় ‘নীলিমা’ নামে। কবিতাটি প্রকাশের পর চারিদিকে নাম ফুটতে শুরু করেন কবির। কয়েকটি পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে।
মা কুসুমকুমারি দাস চাইতেন ব্রাহ্ম সমাজের পুরোধা ব্যক্তিদের নিয়ে ছেলে কবিতা লিখুক। কিন্তু যিনি এসেছেন নতুন কিছু জন্ম দিতে তিনি কি অন্যের বেধে দেয়া পথে হাঁটবেন! হাটেনি। তিনি সৃষ্টি করছেন কবিতার নতুন এক মায়াবি রাজ্য।
১৯২৭ সালে কবিতার প্রথম বই ‘ঝরা পালক’ প্রকাশ পায়। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এটি প্রকাশ করেছিলেন। ভেবে দেখুন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ট কবিকে তার প্রথম বই বের করতে হয়েছে নিজের টাকায়। ভাবা যায় !
যাই হোক, বইটি প্রকাশের পর তিনি একটি কপি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তার মতামত জানতে। বিশ্বকবি উত্তরও দিয়েছিলেন, তবে তা ইতিবাচক নয় নেতিবাচকভাবে। এতে কবি কিছুটা বিমর্ষ হয় পড়েছিলেন। তবে পাল্টা চিঠিতে কবির জাত চিনিয়ে লেখা চিঠিতে বিশ্বকবির শিল্পভাবনাকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
প্রথম বই প্রকাশের পরপরেই তিনি কলেজের চাকরি হারান। শুরু হয় জীবনের এক নতুন বিপর্যয়।
এরপর কবি কলকাতা ছেড়ে চলে যান বাগেরহাটে চাকরির আশায়। প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে প্রভাষক হিসেবে যুক্ত হন। কিন্তু মাত্র দুই মাস বিশ দিন পরে চাকরি ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। প্রেসিডেন্সি বোর্ডে থাকতে শুরু করেন।
চাকরি নাই গৃহশিক্ষকতা করে সংসার চালাতে শুরু করেন সাথে চলে নতুন চাকরির চেষ্টা।
১৯২৯ সালে দিল্লীর রাজযশ কলেজে একটা চাকরি জুটে যায়। কবি কলকাতা ত্যাগ করেন আবার। এবার চলে যান সুদূর দিল্লিতে।
দিল্লীতে থাকতেই কবির বিয়ে ঠিক হয়। ঢাকায় ফিরে আসেন কবি এবং ইডেন কলেজের ছাত্রী লাবন্য দেবীকে বিয়ে করেন। সাল ১৯৩০।
বিয়ের পর চাকরিতে ছুটি বাড়িয়ে চাওয়াতেই দিল্লীর কলেজ তাকে বরখাস্ত করে। চারমাস পর আবার বেকার হয়ে পড়েন কবি। নতুন বিয়ে করেই বেকার। ভীষণ এক অন্ধকারে পড়ে যায় কবির ব্যক্তিজীবন।

এরপর পাঁচ বছর কবি আর কোন চাকরি জোগাড় করতে পারেন না। পুরো জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে এসে পড়েন কবি। চারিদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার।
এই বেকার দুর্বিসহ জীবনে কবি পরিত্রান খোঁজেন লেখাখেলিতে। তবে তা কবিতা নয়, লেখেন ছোট গল্প আর উপন্যাস। এ সময়টাতে কবি ২০ টি মতো উপন্যাস আর অসংখ্য ছোট গল্প লেখেন। যদিও তার একটিও তিনি প্রকাশ করেননি।
তার মৃত্যুর পর ট্রাঙ্ক ভর্তি এসব লেখা খুঁজে পাওয়া যায়। গুপ্তধনের মতো কবি বরিশাল থেকে কলকাতায় ঘুরে বেড়িয়েছেন এসব অপ্রকাশিত লেখা নিয়ে। পাঁচ বছরের কঠিন এক দূর্বিসহ জীবন শেষে কবি আবার ফিরে আসেন বরিশালে।
১৯৩৫ সালে ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই কলেজে ছিলেন। বরিশালে এই সময়টুকুই ছিল কবির পুরো জীবনের সবচেয়ে স্বস্থির সময়।
বরিশালে ফেরার পর কবির জীবন কিছুটা স্থির হয়। কবিতা লিখতে শুরু করেন এবার পুরোদম।
কলকাতা থেকে তখন একটি পত্রিকা বের হতে শুরু করে ‘কবিতা’ নামে। বুদ্ধদেব দাসের সম্পাদনায়। জাত চিনিয়ে দেয়া কবিতা ‘মৃত্যুর আগে’ প্রকাশ পায় এই পত্রিকায়।
…আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কি বুঝিতে চাই আর? . . . রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক
শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!
(মৃত্যুর আগে..)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোচরে আসে এই বিশেষ কবিতাটি। কবিতা পড়ে বেশ প্রশংসা করেন তিনি। তার কবিতাকে ‘চিত্ররুপময়’ বলেন বিশ্বকবি। এটি ছিল জীবনানন্দের কবিতাকে এককথায় প্রকাশ করা সবচেয়ে নিখুত উপমা।
’কবিতা’র দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘বনলতা সেন’ প্রকাশ পায়। এই কবিতা প্রকাশের পর হই হই পড়ে যায় চারদিকে। বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন জীবনানন্দ। তিনি লিখেন,
’সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।….
(বনলতা সেন)
১৯৩৬ সালে পুত্র সমারনন্দ জন্ম গ্রহণ করেন। একই বছর কবির ২য় কবিতার বই ‘ধুসর পান্ডুলিপি’ প্রকাশ পায়। এই বইটি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিয়ে বিশাল এক চিঠি লেখেন আগের চিঠির উত্তরও দেন। বিশাল চিঠির উত্তের রবীন্দ্রনাথ ছোট একটি উত্তর দেন। তাতে তিনি জানান ‘তোমার কবিতায় তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে’। জীবনানন্দকে আবারো যথার্থ যোগ্য উপমায় প্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতা সংকলন করেন সেখানে ‘মুত্যুর আগে’ কবিতাটি অনর্ভুক্ত করেন।

এরপর কবিতা, বরিশাল, ব্রজমমোহন কলেজ ও সংসার নিয়ে সুখের এক জীবন কাটাচ্ছিলেন কবি। এটাই ছিল কবির পুরো জীবনের সবচেয়ে ছন্দময় সুখের জীবন।
১৯৪২ সালে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’ প্রকাশ পায়। আর সেই বছরে কবির পুত্রবিয়োগ ঘটে। আবারও তার জীবনে শংকা নেমে আসে।

১৯৪৪ সালে চতুর্থ কবিতার বই প্রকাশ পায় ‘মহাপৃথিবী’। আগের বই তিনটি নিজের টাকায় প্রকাশ পেলেও এবার তিনি প্রকাশক পান তা বই প্রকাশের জন্য। এই কাব্যগ্রন্থে এক অসামান্য কবিতা প্রকাশ পায় ‘আট বছর আগে একদিন’। এমন কবিতা বাংলা ভাষায় প্রথম। এক ব্যক্তি আত্নহত্যা করেছে। কিন্তু কেন ?
শোনা গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ;….
…জানি— তবু জানি
নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ– নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।
(আট বছর আগে একদিন…)
বাংলা কবিতার এক নতুন দ্বান্দিক চিত্ররুপময়তায় মুগ্ধ হয় পাঠক।

এরপরই আসে বাঙ্গালীর আজন্ম বেদনা এক অধ্যায় দেশভাগ। চারিদিকে উত্তেজনা দেখা দেয়। হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গায় প্রতিদিন মরতে থাকে মানুষ। শুরু হয় এক বিভীষিকাময় সময় ।
কলেজে ছুটি নিয়ে তিনি কলকাতা চলে যান। ’১৯৪৬-৪৭’ কবিতাটি লেখেন। কলকাতায় ভয়াবহ এক দাঙ্গা শুরু হয়। প্রায় পাঁচ হাজার মুসলমান নিহত হয় সেই দাঙ্গায়। বদলা নিতে নোয়াখালির দাঙ্গায় প্রায় একই সংখ্যক হিন্দু নিহত হয় ।
দাঙ্গার সময়টা ভীষণ বিষন্ন করে তোলে কবিকে। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কলকাতার দাঙ্গার দিন পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে যায় কবিকে । ভাগ্য সহায় থানার ওসি ছিলেন বিএম কলেজের এক মুসলমান ছাত্র । শেষ পর্যন্ত তার সহযোগিতায় থানা থেকে ছাড়া পান কবি । বরিশাল ফিরে ভয়াবহ দাঙ্গার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা লিখেন কবি
‘মানুষ মেরেছি আমি-তার রক্তে আমার শরীর
ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢকে
ব’দ করে ঘুমাইতেছি –
(১৯৪৬-১৯৪৭)
ভয়াবহ এক দূর্যোগ নেমে আসে আবারও কবির জীবনে। দেশ ভাগ হয়ে যায়। কবি পুরো পরিবার নিয়ে নিজ দেশ ছেড়ে চিরদিনের জন্য থেকে যান ওপার বাংলা কলকাতায়।

দেশভাগের পর তিনি আর ফিরে আসেননি ব্রজমোহন কলেজে। জীবনের সবচেয়ে বেশি সময়, দীর্ঘ বারো বছর চাকরি করেন এই কলেজে। এত বেশী সময় আর কোথাও চাকরি করেননি কবি।
দেশভাগের পর কবি আবারো বেকার হয়ে পড়েন। বিএম কলেজ তাকে ছাড়তে চায়নি কিন্তু কবি অনেক দ্বিধা দ্বন্দের পর কলকাতাতেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এটা ছিল তার জীবনের একটি বিরাট বড় সিদ্ধান্ত।
কবির মনে কি ছিল তা জানা মুশকিল। তবে নিশ্চিত হওয়া যায় তিনি তার প্রাণের বরিশালে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু পরিবার আর দেশের সেসময়ের পরিস্থিতে তিনি তা আর পেরে ওঠেননি। বাকি জীবনে আর কোনদিন একবারের জন্যও স্বশরীরে বরিশালে ফেরেননি কবি। কি এক অবাক করা অভিমান কবির হৃদয় জুড়ে খেলা করে গেছে আমৃত্যু।
কলকাতায় এখন তার পুরো পরিবার উদ্বাস্তু। মা কুসুমকুমারি দাশ। ভাই অশোকানন্দ। বোন সুচিরিতা দাশ। বউ আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বিশাল সংসার। কিন্তু পরিবারের বড় ছেলে একজন কবি এবং বেকার।
১৯৪৭ সালে কবি লেখক ও রাজনীতিবদি হুমায়ুন কবির কলকাতা থেকে ‘স্বরাজ’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেখানে সাহিত্য পাতার দেখার চাকরি পান তিনি। একটু স্বস্থি আসে জীবনে। মাত্র সাত মাসের মাথায় আবারো চাকরি চলে যায়। ধারণা করা হয় কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে এক লেখার বিরোধেই তাকে চাকুরিচুত্য করা হয়েছিল।
১৯৪৮ সালে পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির’ প্রকাশ পায়। এই বই এর প্রচ্ছদ করেন বাংলার আরেক কিংবদন্তি সিনেমা পরিচালক সত্যজিত রায় । এই মাসেই মারা যায় মা কুসুম কুমারী দাশ। কবি পুরোপুরি এতিম হয় পড়েন।
এবার ‘দ্বন্দ’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক হন তিনি।
এরপর খড়গপুর কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন। সেটিও বেশিদিন বহাল থাকে না।

১৯৫২ সালে ‘বনলতা সেন’ বড় আকারে প্রকাশ পায় এবং পাঠকপ্রিয় হয়। পরে হাওড়া গার্লস কলেজে অধ্যাপনার চাকরি জুটে। সংসার অভাব অনাটনের একটা বন্দোবস্ত হয়। এই কলেজেই ছিল তার শেষ কর্মস্থল।
মোট সাড়ে আটশর মতো কবিতা লিখেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। যার মধ্যে মাত্র ২৫০টি কবিতা, সাতটি কাব্যগ্রন্থে তার জীবনদশায় প্রকাশ পায়। মৃত্যুর পর প্রকাশ পায় ২ টি কাব্য গ্রন্থ। যার একটি ’রুপসী বাংলা’।
‘তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও- আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে-একবার-দুইবার-তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে;
(তোমরা যেখানে সাধ)
কি অদ্ভুত যে কবিতাগুলো মানুষ তার শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে করে , যিনি এখন পরিচিত ‘রুপসী বাংলার’ কবি বলে সেই কবি তার জীবনদশায় এই অসামান্য সুন্দর কবিতাগুলি প্রকাশ করেননি আড়ালেই রেখে দিয়েছিলেন।
মৃত্যুর পর আরো ২০ টি উপন্যাস, ১০০ ছোটগল্প এবং ২০০ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৫ সালে ‘ জীবনান্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ‘লিটারেরি নোটস’ নামে প্রায় চার হাজার পৃষ্ঠার ডায়রী পাওয়া যায় কবির। মোটা দাগে এই হচ্ছে জীবনানন্দ দাশ, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি।

১৯৫৪ সালের অক্টোবরের ১৪ তারিখ। বালিগঞ্জে এক ট্রাম দূর্ঘটনা ঘটে। ট্রামের ক্যাচারে আটকে গিয়ে ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে যায় একজন পথচারির পাঁজর। কেউ বলে আত্নহত্যা আর কেউ বলে দূর্ঘটনা করতে চেয়েছিল লোকটি। পরে জানা যায় সেই অচেনা আনমনে ট্রাম লাইনে উঠে যাওয়া লোকটিই বাঙলার শ্রেষ্ঠ কবি জীবননান্দ।
কলকাতার শুম্ভনাথ পন্ডিত হাসপাতালে সাতদিন চিকিৎসাধী থাকার পর ২২ শে অক্টোবর রাত ১১টার পর বাংলা কবিতার বিশাল এক সূর্য অস্তমিত হয়।
রুপসী বাংলার রুপ বুকে নিয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শুদ্ধতম কবি, জীবনানন্দ দাশ।
পারভেজ সেলিম
লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্ী
আরো পড়ুন :
Hi there, just became alert to your blog through Google, and
found that it is truly informative. I’m gonna watch out
for brussels. I’ll appreciate if you continue this in future.
A lot of people will be benefited from your writing. Cheers!