বয়স কত হলো !

বলা হয়ে থাকে মেয়েদের বয়স জানতে চাওয়া আর ছেলেদের বেতন জানতে চাওয়া দুটোই অসামাজিক জিজ্ঞাসা !! যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেউ কেউ পুরুষতান্তিক চিন্তার বহি:প্রকাশও বলে মনে করেন।

কারণ এমন প্রশ্নে বয়স সৌন্দর্য্যদের সাথে আর অর্থ ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত বলে প্রতিয়মান হয়। অবশ্য সৌন্দর্য ও ক্ষমতা ‍বিচারের এমন মানদন্ড নিয়েও রয়েছে বিস্তর বির্তক।

পৃথিবীর যতটুকু ইতিহাস প্রকাশিত তাতে দেখা যায় পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়েছে তাদের ক্ষমতা দ্বারা। অন্যদিকে নারীর শ্রেষ্ঠত্বের ইতিহাসে তাদের দৈহিক সৌন্দর্য্যকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে খুবই স্বযন্তে। কারণ এই ইতিহাসগুলি পুরুষের লেখা। থাক, এসব অন্য বির্তক।

কিন্তু কত বছর বয়সে মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন! কত বছর লাগে একজন মানুষের নিজেকে প্রকাশের চরম সীমায় পৌঁছাতে?

সেটা হয়ত কঠিন প্রশ্ন ! যে প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া যায় না তাকে আমরা কঠিন প্রশ্ন বলেই মনে করি। সহজে এর উত্তর জানার জন্য সফল হয়েছেন যারা তাদের তথ্য যাচাই বাছাই করা যেতে পারে।

যারা স্মরনীয় তব :

সভ্য পৃৃথিবীতে যে মানুষগুলো দেশ জাতি কিংবা পুরো পৃথিবীকে প্রভাবিত করেছেন, তাদের আসলে কত বছর লেগেছে নিজেকে প্রমাণ করতে?  ধর্ম দিয়েই শুরু করা যাক।

ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে নবুয্যূত লাভ করেন। তিনি বেঁচে ছিলেন ৬২ বছর। নবুয়ূত লাভকে যদি তার সৃষ্টিশীলতার চরম প্রকাশ ধরি তাহলে বলা যায় ৪০ বছর সময় লেগেছে তার নিজেকে প্রকাশের চরম সীমায় পৌঁছাতে।

কিন্তু প্রদীপ জ্বালানোর আগে যে সলতে পাকাতে হয় সেটা কবে শুরু হয়েছিল সেটার সঠিক সময় বাস্তবিকই কেউ জানেন না। এমন কি তিনি নিজেও জানতেন কিনা তা আমরা জানিনা। কখন থেকে আসলে শুরু হয়েছিল?

ধর্ম এখনও বেশীরভাগ মানুষকে বিমোহিত করে রেখেছে সবচেয়ে বেশী দিন ধরে। যা টিকে থাকে তার তো একটা গুণ আছে।

শিল্পীরা অবশ্য ভিন্ন কথা বলেন, টিকিয়ে থাকা নিয়ে তাদের মতামত নেতিবাচক । বলেন ‘অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া রয়েছ’, মানে শুধু টিকিয়া থাকাই বড় কথা নয়, কিভাবে টিকিয়া আছে সেটাই বড় কথা!

অনেক যুদ্ধ, জীবন এবং কর্মের মধ্য দিয়ে মহানবীর দুনিয়ার জীবন সমাপ্ত হয়েছে ৬২ বছর বয়সে। তার চল্লিশ বছরের প্রস্তুতি আর পরবর্তী  ২২ বছরের কর্ম তাকে গত ১৪০০ বছর পৃথীবিতে বাঁচিয়ে রেখেছে। আরও অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখবে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন মহানবী বেঁচে থাকবেন মানুষের মনে।

আর সেখানে যীশু বেঁচেছিলেন মাত্র ৩২ বছর। মুহাম্মাদ (সা:) এর ৫৭০ বছর আগে জন্মেছিলেন এই মহান ব্যক্তি। মাত্র ৩২ বছরের কর্মময় জীবন তাকে অমরত্ব দিয়ে গেছে। তার অনুসারীরা, তার কাজের মূল্যায়ণ করছেন গত দুই হাজার বছর ধরে, আরো করবেন হয়ত !!

আর বুদ্ধ ৮০ বছর ধরে তার ধর্মবোধ প্রচার করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তার কাজের চূঁড়ায় ওঠেন কত বছর বয়সে?

বুদ্ধ ঘর ছেড়ে সন্নাস জীবন বেছে নিয়েছিলেন ১৬ বছর বয়সে । ছয়বছর না খেয়ে ছিলেন বোধিপ্রাপ্তের আশায়। পরে খাদ্য গ্রহণ করেন। ৪৯ দিনে এক বিশাল তপস্যার পর নির্বাণ লাভ করেন তিনি। বুঝে জান মানুষের সুখ দু:খের পিছনে কোন এক কারণ আছে। তখন তিনি মাঝ বয়সি।

মানে নির্বাণ লাভ করতে তার অর্ধেক জীবন কেটে যায়। যীশুর জন্মের ৬০০ বছর আগে জন্ম নেয়া এই মানুষটি টিকে আছে ২৬০০ বছর ধরে। সগৌরবে। এটাকেই হয়ত বলে বাঘের মত টিকে থাকা, তেলাপোকার নয়!!

কার্ল মার্কস ৫০ বছর বয়সে তার বিখ্যাত বইটি লেখেন যার নাম ‘ ডাস ক্যাপিটাল’ বা ‘পুঁজি’। অনেকে এই বইকে মানুষের লেখা শ্রেষ্ঠ ‘বুদ্ধিবৃত্তিক বই’ বলে মনে করেন। মানুষের মুক্তির একটি শ্রেষ্ঠ পথ বাতলে দেয়া এবং মানব সভ্যতার সবচেয়ে অগ্রবতী ভাবনা বলে মনে করেন এই বইকে। ধর্মকে তিনি ‘আফিমের’ সাথে তুলনা করেছিলেন। তিনি বেঁচে ছিলেন ৬৫ বছর।

রবীন্দ্রনাথ ৮০ বছরের বৃদ্ধ হয়ে মারা যান।  কিন্তু তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন ১৬ বা ১৪ বছর বয়সে। পুরো জীবন ধরে তিনি শিল্প চর্চা করেছেন। তার সৃষ্টির পরিমান অনেক। শিল্পের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তিনি হাত দেননি।  তিনি কখন আসলে তার সৃষ্টি মধ্যগগনে ছিলেন? এর উত্তর খুব সহজ নয় এবং তা  ভিন্ন ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি যখন প্রথম ভারতীয় হিসেবে নোবেল পুরষ্কার পান তখন তার বয়স ৫২ বছর।

নজরুল ৭৭ বছর বেঁচে ছিলেন। জীবনের ৪৩ বছরের পর তিনি আর কোন কিছুই সৃষ্টি করতে পারেননি অসুস্থতার কারণে। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্য জীবন পান বাংলা সাহিত্যের আরেক প্রধাণ পুরুষ।

শেক্সপিয়ার তার লিখনি চালিয়েছেন মাত্র ৫২ বছর, আনেস্ট হেমিংওয়ে ৬২ বছর, মাক্সিম গোর্কি ৬৮ বছর আর গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস পেয়েছিলেন জীবনের লম্বা সময় ৮৭ বছর।

অন্যদিকে সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র ২১ বছর বয়সে  পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। এগারো বছর বয়সে তার  প্রথম লেখা কাগজে প্রকাশ পায়। মাত্র কয়েক বছরের লিখালিখিতে তিনি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। ২১ বছর বয়সে তিনি ….‘ছেড়ে দিতে হবে স্থান’ বলেছিলেন , তবে যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে প্রাণ পণে পৃথিবীর জঞ্জাল সরাতে চেয়েছিলেন।

ক্ষুদিরাম বসু দেশবোধের ধারণা নিয়ে যখন ফাঁসির কাস্টে যায় তখন তিনি ১৮ বছরের তরুণ। অহিংসা অসিংহা করে যিনি পুরো জীবন কাটান সেই মহাত্মা গান্ধী  হিংসার ‍গুলিতে যখন নিহত হন তখন তার বয়স ৭৮ বছর।

আলবার্ট আইনস্টাইন তো বিরল এক প্রতিভা পৃথিবীতে। কেউ কেউ বলে তিনি একশ বছর আগিয়ে নিয়ে গেছেন পৃথিবীকে। ৭৬ বছরের জীবন পেয়েছিলেন এই জিনিয়াস। কিন্তু জীবনের মাত্র একটি বছরে যা দেবার তার সকল কিছুই দিয়ে দেন পৃথিবীকে।

সেই বছরটি হলো ১৯০৫। সবাই এই বছরটিকে বলে ‘মীরাকেল ইয়ার’।

আইনস্টাইনকে মানুষ যে সকল তত্ত্বের জন্য আজ চেনে তার সেই বিখ্যাত পাঁচটি থিওরিই তিনি দিয়েছিলেন মাত্র এক বছরে। তখন তার বয়স মাত্র ২৬ বছর। এই বয়সেই তার সবকিছু দেয়া শেষ।

পরের ৫০ বছর তিনি আর নিজেকে পেরিয়ে যেতে পারেননি। ২৬ বছরেই তিনি জীবনের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেছিলেন।

আইজাক নিউটন ৮৪ বছর বেঁচে ছিলেন। আর স্টিফেন হকিংস ৭৬ বছর। বেশ লম্বা জীবন পেলেও ২১ বছর বয়স থেকে তার শরীর অবশ হতে শুরু করেছিল। জীবনের শেষদিকে একটি মাত্র আঙ্গুল আর ব্রেনের এক অংশ দিয়ে পৃথিবীর গূঢ় রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করে গেছেন এই অনন্য জিনিয়াস বিজ্ঞানী।

আজকের জনপ্রিয় ফেসবুক যখন বানান মার্ক জুকারবার্গ তখন ১৭ বছর বয়সের তরুণ আর বিল গেটস মাইক্রোসফট অফিসে বসেন ২৩ বছর বয়সে। ইলন মাক্স যখন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হন তখন তার বয়স ৫০ বছর।

আলেকজ্যান্ডারের মাত্র ৩২ বছর বয়সের জীবন। মৃত্যুের আগেই তিনি অনেকের কাছে গ্রেট হয়ে গিয়েছিলেন। মাত্র ৩২ বছরে প্রায় সারা পৃথিবী দখল করে ফেলেছিলেন এই গ্রিক বীর ।

আর দার্শনিক সক্রেটিস যখন হেমলক পান করেন তখন তার বয়স ৭১ বছর। তার ছাত্র প্লেটো বেঁচে ছিলেন ৮০ বছর আর তার ছাত্র অ্যারিস্টেটল বেঁচেছিলেন ৬২ বছর। ২৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে টিকে আছে এই তিন মনীষী।

বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান যখন ৫১ বছর বয়স তখন তিনি নতুন একটি দেশ সৃষ্টির নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীন দেশে তাকে হত্যা করা হয় ৫৫ বছর বয়সে।

মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে তিনি যা করতে পেরেছেন এবং জীবনে যা পেয়েছেন তা বাংলাদেশের দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি লাভ করতে পারেননি এবং ভবিষ্যতে পারবেন কিনা সন্দেহ।

সত্যজিৎ রায় পথের পাচালী বানান ৩৫ বছর বয়সে। মারা যান ৭১ বছর বয়সে। পুরো জীবন জুড়ে সিনেমা বানালেন ৩৬ টি। ধরে নেয়া যায় তিনি ৩৫ বছর বয়েই তার সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেছিলেন।

মাদার তেরাসা ৮৭ বছরের পুরো জীবনকে মানব সেবায় লাগিয়েছেন আর আমাদের বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন মাত্র ২১ বছর বয়সে। আর বেগম রোকেয়া ৫২ বছরের জীবন পেয়েছিলেন নারীর শিক্ষা বিস্তারের আমৃত্যু কাজ করার জন্য।

লালনের জীবনকালের সঠিক হিসেব বের করা কঠিন। তবে জানা যায় দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন তিনি। আনুমানিক ১১৬ বছর। বাল্যকালেই তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন ছিলেন শ্রষ্টার সন্ধানে। গানে গানে জীবনভর তিনি সেই অনুসন্ধানের কথাই জানিয়েছেন মানুষকে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে স্বগর্বে টিকে আছেন বাংলা মাটির অকৃত্রিম এই মানুষটি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কত বছর প্রয়োজন আপনার একটি সমৃদ্ধ জীবন লাভ করতে? ১৭,২৬ ,৩২,৪০,৫০ নাকি ৭১/৮০ বছর? উত্তর কি পাওয়া গেল!!

সত্যজিৎ রায় বলতেন, ‘যারা ফাটায় তারা প্রথমে ফাটায়’। তার মানে শুরুতেই আচ পাওয়া যায়, ধারণা পাওয়া যায় কে ফাটাবে। তবে ফাটানোর আগে সলতে পাকাতে কে কত সময় নেন সেটাই গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন!

কার্ল মার্কস সলতে পাকিয়েছেন ৫০ বছর আর আইনস্টাইন মাত্র ২৬ বছর। যীশু ৩২ বছর আর মহানবী ৪০ বছরে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। যদি ভাবতে চান তাহলে ভেবে দেখতে পারেন আপনার বয়স কত ?

২ thoughts on “বয়স কত হলো !

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x