‘আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কি বুঝিতে চাই আর? . . . রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক
শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!
(মৃত্যুর আগে)
জীবনানন্দ দাশ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হয়ে উঠছেন। হ্যাঁ রবীন্দ্রনাথকে মাথায় রেখেই একথা এখন বলা যায়। যতদিন যাচ্ছে ততই জীবনানন্দের মৌলিকত্ব আর কবিতার সৌন্দর্য্য যেন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অথচ পুরো জীবন জুড়ে কি অপমান আর অবহেলাই না পেয়েছেন বাংলার এই নির্জন বিশুদ্ধতম কবি!
জীবনের বিষয়গুলোত তিনি অন্য সবার থেকে আলাদা ছিলেন। কবিতায় স্বীকারও করেছেন ‘নিজের মুদ্রাদোষে’ তিনি আলাদা হতেছেন সবার থেকে। জীবনের প্রয়োজনে তাকেও সংসার করতে হয়েছে, হয়েছে চাকরি বাকরি করে টাকা উপার্জন করতে। কবিতায় তিনি যেমন ছিলেন এক বিশাল সম্রাট, তেমনি চাকরি আর জীবন সংসারে তিনি যেন এক নি:সহায় দূর্বল প্রজা।
টাকা উপার্জনের জন্য ইন্সুরেন্স কোম্পানীতেও চাকরি করেছিলেন কবি। সবচেয়ে বেশি করেছেন কলেজের অধ্যাপনা। সাতটি কলেজে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। জীবনের শেষ চাকরিটিও ছিল একটি কলেজের অধ্যাপনা।
পত্রিকা অফিসেও কাজ করেছেন কিন্তু কোনটিতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনননি। হয়েছেন বিধ্বস্ত, সর্বশান্ত চুড়ান্ত পরাজিত। কিন্তু জীবনের সেই ঘাত প্রতিঘাতের কোন আঁচড় তিনি লাগতে দেননি তার কবিতার রাজ্যে। সেখানে তিনি মহিমান্নিত এক সম্রাট। যিনি এক বিপন্ন বিস্ময় নিয়ে গোটা পৃথিবীকে দেখছেন। বলেছেন তার বিশেষ ‘বোধের’ কথা।
…
আলো অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়,-কোন এক বোধ কাজ করে
স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়,-পন্ড মনে হয়
সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময়
শুন্য মনে হয়
শূন্য মনে হয়!
(……বোধ)
জীবনের তাগিদে কবিকে যুক্ত হতে হয়েছে নানান পেশায়, করতে হয়েছে চাকরির মতো বিরক্তিকর কাজ।
কবি জীবনের প্রথম চাকরি শুরু করেন সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে। ১৯২২ সালে। তখন তিনি ২৩ বছরের তরুণ। তিন বছর চাকরির পর সেখান থেকে চাকরিচুত্য হন তিনি। কারণ ?
সিটি কলেজ ছিল ব্রাক্ষ্ম সমাজ কতৃক প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজ। কলেজের চত্ত্বরে ভিতরে হিন্দু ছাত্ররা সরস্বতি পূঁজা করতে চাইলে কলেজ কতৃপক্ষ তাতে বাধা দেয়। এর আগে কলেজ চত্ত্বরের বাইরে এই পূঁজা হয়। ছাত্ররা এবার ভিতরে করতে চায়, কতৃপক্ষ রাজি নয়।
এই নিয়ে সেসময় বেশ গরম হয়ে ওঠে পেপার পত্রিকা। এই গন্ডগোলের রেশ ধরে পরে বছর অর্ধেক হিন্দু ছাত্র ঐ কলেজে আর ভর্তি হয়না। ফলে আয় কমে যায় কলেজের। আর্থিক সংকট কাটাতে ১১ জন শিক্ষকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তার মধ্য জীবনানন্দ দাসও ছিলেন। কারণ জীবনানন্দ ছাত্রদের দাবির প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন। প্রথম চাকরিতেই বরখাস্ত হন কবি।
এরপর বাংলাদেশের বাগেরহাট কলেজে চাকরি নেন তিনি। প্রভাষক পদে। তার কলেজে শিক্ষকতা জীবন শুরু এখানেই। মাত্র ২ মাস ২০ দিনের চাকরি জীবন ছিল এই কলেজে।
এরপর দিল্লীর রামযশ নামে একটি কলেজে চাকরি পান কবি। তখনও তিনি বিয়ে করেননি। কলকাতা থেকে সূদুর দিল্লিতে চলে যান টাকার আশায়। সেই কলেজের ছাত্ররা কেউই বাংলা ভাষাভাষী ছিলেন না। একলা এক বিরাণভূমিতে শিক্ষকতা করতে যে খুব ভালো লাগত তা নয়। তবু করে যাচ্ছিলেন তিনি।
মা কুসুমকুমারী দাসের জোরাজুরিতে এসময় বিয়েতে রাজি হন কবি। মেয়ে ঢাকার ইডেনের ছাত্রী নাম লাবনী। বিয়ের জন্য যখন দিল্লি থেকে ঢাকায় আসেন তখন তার মন আর সায় দেয় না দিল্লীতে ফিরে যেতে। তিনি ছুটির জন্য দরখাস্ত করেন। ছুটির বদলে তাকে বরখাস্ত করে কলেজ কতৃপক্ষ। বিয়ের সাথে সাথেই বেকার হয়ে পড়েন কবি। মাত্র চার মাস টিকে ছিল তার দিল্লির চাকরি।
এরপর পাঁচবছর কবির জীবনে চলে ঘোরতর অন্ধকার আর হতাশারকাল। চাকরি নেই বেকার জীবন সাথে নতুন সংসার। এযেন এক অমোঘ নিয়তি স্রষ্টার।
অন্ধকার কাটিয়ে নিজের শহর বরিশালে ব্রজমোহন কলেজে আবার জোটে চাকরি। ১৯৩৫ সালে। ইংরেজীর অধ্যাপনা শুরু করেন কবি। এই কলেজেই পুরো জীবনের সবচেয়ে স্বস্থির চাকরিটি করেছেন তিনি। আর লি্খে চলেছেন বাংলার রুপ অববদ্য সব উপমার সাহয্যে। কবিতার উপমার এমন ব্যাবহার এর আগে আর কেউ করেনি বাংলা কবিতায়।
….
চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল!
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইদুরের ঘ্রানে ভরা আমাদের ভাড়ারের দেশে!
..( অবসরের গান/ধুসর পান্ডুলিপি)
বেশ ভালোই কাটছিল কবির জীবন। সবচেয়ে বেশি সময় প্রায় ১২ বছর এই চাকরি করেন নিজ শহরে। লেখালিখি ও চাকরি সমান তালে চলছিল এসময়।
এসময় প্রকাশ পায় চুতৃর্থ কবিতার বই ‘মহাপৃথিবী’। সাল ১৯৪৪ । ৪১ টি কবিতা নিয়ে বের হয় কাব্যগ্রন্থটি। ‘আট বছর আগে একদিন’ নামে এক অসামাণ্য কবিতায় জীবনানন্দের নতুন এক কাব্যজগতের সাথে পরিচয় হয় পাঠকের।
.
জানি – তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি
অর্থ নয়, কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিষ্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;…..
(আট বছর আগে একদিন/ শ্রেষ্ঠ কবিতা)
বরিশাল সাহিত্য চর্চা ভালো হলেও কলকাতা শিল্প সাহিত্যের জগত তাকে টানছিল। তিনি কলকাতায় চলে যান। এরপর রাজনীতির পট পরিবর্তন হতে শুরু করে। কলকাতায় শুরু হয় দাঙ্গা। পরে সেই দাঙ্গা রুপ নেয় দেশভাগে। মুসলমান আর হিন্দুদের আলাদা দুটি দেশ হয়।
ইতিহাস বদলে যাওয়া সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকেন কবি। জীবনের মোড় হঠা জোরে বাঁক নেয়। কোন দিকে যাবেন কবি?
সিদ্ধান্তে অথবা অসিদ্ধান্তে কবি থেকে যান কলকাতায়। নিজ দেশে আর ফেরা হয়না। যদিও বরিশালের কলেজে তার চাকরিটা তখনও ছিল। কবি ছিলেন দ্বিধায়। মা কুসুমকুমারি দাশ চাইতেন না ছেলে কলকাতায় থাকুক । তারপরও শেষ পর্যন্ত তিনি ও তার পরিবার বেছে নিয়েছিলেন কলকাতার উদ্বাস্তুর জীবন।
দাঙ্গার সময়টা ভীষণ বিষন্ন করে তোলে কবিকে। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কলকাতার দাঙ্গার দিন পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে যায় কবিকে । গিয়েছিল ওসি ছিলেন বিএম কলেজের এক মুসলমান ছাত্র । শেষ পর্যন্ত তার সহযোগিতায় থানা থেকে ছাড়া পান কবি। বরিশাল ফিরে তিনি লেখেন..
‘মানুষ মেরেছি আমি-তার রক্তে আমার শরীর
ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢকে
ব’দ করে ঘুমাইতেছি –
(১৯৪৬-১৯৪৭)
দেশভাগের পর এক কঠিন সময়ের মুখোমুেখি হয় কবি ও তার পরিবার। এসময় কলকাতায় চাকরি সন্ধানে অনেক চেষ্টা করেও ফল হয় না। ১৯৪৭ সালে স্বরাজ পত্রিকায় সাহিত্যপাতা দেখার একটা চাকরি জুটে যায়। কবি হুমায়ুন কবিরের পত্রিকায় কাজ শুরু করেন তিনি।
সেটাও বেশিদিন করতে পারেন না একসময় ছেড়ে দেন। মাত্র চার মাসের মধ্যেই তিনি বুঝে যান তার দ্বারা এই কেরানীর কাজ করা সম্ভব না। কারো কারো মতে চার মাস পরই তাকে চাকরিচুত্য করা হয়েছিল। কাজী নজরুলকে নিয়ে এক বিতর্কের জেরে রাজনীতির শিকার হলে, চাকরিটি খোয়াতে হয় তাকে।
১৯৫০ এর শেষের দিকে তিনি যুক্ত হন খড়গপুর কলেজ। ১৯৫১ সালের জানুয়ারিতে স্বেচ্ছায় অবসর নেন তিনি।
বড়িশা কলেজেও যোগ দিয়েছিলেন কবি। যা আধুনা বিবেকানন্দ কলেজ নামে পরিিচত। সেখান থেকেও চাকরিচুত্য করা হয়েছিল কবিকে।
কবির জীবনের শেষ চাকরি ছিল হাওড়া গার্লস কলেজের অধ্যাপনা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই কলেজের শিক্ষকতা করেছেন।
এছাড়া গৃহ শিক্ষকতা ও ইন্সুরেন্স কোম্পানীর চাকরিও করেছেন তিনি। কয়েকবার ব্যবসা করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। লেখালেখি করেও কিছু টাকা আয় করেছিলেন তখন। একসময় গান লিখে সংসারের অভাব দূর করার চিন্তাও করেছিলেন কবি।
জীবনানন্দ ছিলেন আপাদমস্তক একজন কবি। তাকে দিয়ে জগতের অন্যকাজ হবার কথাও নয়। তিনি পুরোজীবন জুড়ে শুধু লিখে যেতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু বাস্তবতা হল তার রবীন্দ্রনাথের মতো জমিদারি ছিল না, উপার্জন করতে গিয়ে তাকে নাজেহাল হতে হয়েছে। চাকরি আর অর্থ উপার্জনে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হয়েছেন । হয়ত সফল হতেও চাননি !
এমন জীবনেও কি এক অপরিমীয় মমতায় আমৃত্যু আকড়ে ধরে ছিলেন কবিতা। ফুটিয়েছেন নিজ সম্রাজ্যে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। উপিলব্ধির প্রকাশ তাই করে গেছে তার লেখা আর কবিতায় ।
‘যুগে-যুগে মানুষের অধ্যবসায়
অপরের সুযোগের মতো মনে হয়।
কুইসলিং বানালো কি নিজ নাম— হিটলার সাত কানাকড়ি
দিয়ে তাহা কিনে নিয়ে হ’য়ে গেল লাল:
মানুষেরই হাতে তবু মানুষ হতেছে নাজেহাল;
পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।
এ কেমন পরিবেশ রয়ে গেছে সবে
বাকপতি জন্ম নিয়েছিলো যেই কালে.’.
পরিশিষ্ট :
সংক্ষেপে কবির চাকরি জীবন : ৭ টি কলেজে শিক্ষকতা
১. সিটি কলেজ, কলকাতা। টিউটর। ১৯২২-১৯২৭। চাকরিচুত্য। প্রথম চাকরি।
২. প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ,বাগেরহাট। প্রভাষক। ২ মাস ২০ দিন।
৩. রামযশ কলেজ, দিল্লী। ১৯২৯ । অধ্যাপক। চার মাস। চাকরিচুত্য।
৪. ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল। প্রভাষক। ১৯৩৫-১৯৪৬। দেশত্যাগ। দীর্ঘ সময় ধরে চাকরি। প্রায় ১২ বছর ।
৫. খড়গপুর কলেজ। ১৯৫০ শেষের দিকে -১৯৫১ জানুয়ারি। স্বেচ্ছায় অবসর।
৬. বড়িশা কলেজ। ১৯৫২ নভেম্বর-১৯৫৩ ফেব্রুয়ারি । চাকরিচুত্য
৭. হাওড়া গালর্স কলেজ। ১৯৫৩ জুলাই থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। শেষ চাকরি।
পত্রিকার সম্পাদনা :
১. স্বরাজ। ১৯৪৭। চার মাস পর চাকুরিচুত্য ।
২. দ্বন্দ। সম্পাদক।
অন্যান্য পেশা
১. টিউশনি
২.ইন্সুরেন্স কোম্পানী
পারভেজ সেলিম
লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী
আরো পড়ুন :
Hello ! I am the one who writes posts on these topics totosite I would like to write an article based on your article. When can I ask for a review?