‘আত্নজা ও একটি করবী গাছ’


হাসান আজিজুল হক


আত্নজা ও একটি করবী গাছ


এখন নির্দয় শীতকাল, ঠাণ্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। ওদিকে বড় গঞ্জের রাস্তার মোড়ে রাহাত খানের বাড়ির টিনের চাল হিম ঝক ঝক করে। একসময় কানুর মায়ের কুঁড়েঘরের পৈঠায় সামনের পা তুলে দিয়ে শিয়াল ডেকে ওঠে। হঠাৎ তখন স্কুলের খোয়ার রাস্তার দুপাশের বনবাদাড় আর ভাঙা বাড়ির ইটের স্তূপ থেকে হু-উ-উ চিৎকার ওঠে। ঈশেন কোণ থেকে ধর ধর লে লে শব্দ আসে, অন্ধকারে—ভূত অন্ধকার কেঁপে কেঁপে ওঠে, চাঁদের আলো আবার ঝিলিক দেয় টিনের চালে। গঞ্জের রাস্তার ওপর উঠে আসে ডাকু শিয়ালটা মুখে মুরগি নিয়ে। ডানা ঝামরে মুমূর্ষু মুরগি ছায়া ফেলে পথে, নেকড়ের মতো ছায়া পড়ে শিয়ালটারও, চাঁদের দিকে মুখ তুলে চায় সে, রাস্তা পেরোয় ভেবেচিন্তে, তারপর স্কুলের রাস্তার বাদাড়ে ঢোকে। হাতে লাঠি চাঁদমণির বাড়ির লোক ঠ্যাঙাড়ের দলের মতো হল্লা করে রাস্তায় পড়ে, কোনদিকি গেল শালার শিয়েল, কোনদিকি ক দিনি।

আরো হিম নামে।

বড় পুলের ওপর থেকে নিচের পানিতে আপন ছায়া দেখতে চায় সরদারদের ছোট তরফের বড় ছেলে ইনাম। পানির রুপোলি মেঝেয় হাতড়ে বেড়ায় নাক-মুখ। হিম নামে যেন শব্দ করে, বাতাস আসে শিরশির, খড়মড় উড়ে যায় বাদাম খোলা। খাদের আসশ্যাওড়ার পাতা থেকে আলো চলকে ওঠে, কাঁঠাল গাছের পুবদিকের ডাল হাত নাড়িয়ে ডাকতেই থাকে বিচ্ছিরি। অজস্র খঞ্জনি বেজে ওঠে ঝনঝন।

ইনাম পুল ছেড়ে ধুলো ভেঙে শুকনো বিলের কিনারায় দাঁড়ায়। সেখানে শঙ্খচূড়ের মত দেখায় যে ধবল পথ, এখন তা ত্রস্ত হয়ে এলো, ফেকুর বাঘের মত শরীরটা দেখা গেল, তার পেছনে সুহাস। ওরা খুব গল্প করছে। যে জন্যে এখানে এখন এত রাতে সে সম্বন্ধে কোন কথা নেই। কখন সুহাস ছোট মামার বিয়ের বরযাত্রী গিয়েছিল, অমৃতের মত পুরী খেয়েছিল আর অঢেল মিষ্টি সেই গল্প। ট্রানজিষ্টারটা বেজেই যাচ্ছিল ফেকুর বগলে, ওরা কেউ শুনছিল না, কণিকা বিলের কিনারায় দারুণ ঠাণ্ডায় বৃথাই গাইছিলেন অন্ধকারে একা থাকার যন্ত্রণা। বিনিয়ে বিনিয়ে। আর আশ্চর্য, একটা পাখিও ডাকছিল না। রেডিওডা বন্দ করে দে—ওদের দেখে ইনাম বলল। অসহ্য লাগছিল তার। আইছিস—দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা দুজনে। সুহাস হাসল, বিড়ির ধোঁয়ার কালো দাঁতগুলো প্রায় মুখের বাইরে চলে এলো। ইনামের আবার অসহ্য লাগল। রেডিওডা বন্দ করে দে—বলল সে। কেউ শোনপে না, শোনলেও এদিকি আসবেনানে কেউ, ফেকু বলল। সেজন্যি বলতেছি না, খারাপ লাগতিছে গানডা। কণিকার গলা টিপে দিল ফেকু। এখন চল, দেরি করলি ঘুমোয় পড়বেনে আবার, ফেকু বলল আর ট্রানজিস্টারটা সুহাসের হাতে দিল। সেটা নিতে নিতে সুহাস প্রশ্ন করে, কেডা? বুড়োটা, আবার কেডা! সন্ধে হলি ঘুমিয়ে পড়বে বুড়ো—থু করে থুথু ফেলে বলে ফেকু।

যেতে যেতে বাতাস বেড়ে গেল একটু—ফাঁকা বিল থেকেই আসছিল বাতাসটা। শুকনো পাতার শব্দ হচ্ছিল। ঝপ করে মাছ লাফিয়ে উঠল কাজীদের পুকুরে আর বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল খাঁদের বাড়িতে ধান সেদ্ধ হচ্ছে উঠোনে। উনুনের আগুন দপ করে জ্বলে উঠলে খাঁদের সুন্দর সুন্দর মেয়েদের মুখ একবারের জন্যে ঝলসে উঠল। ইস্কুলি যাতিছিস না আজ কাল? সুহাস জিগগেস করে। না—ইনাম জবাব দেয়। পড়বি না আর? না, পড়লি আমারে কেউ সিন্নি দেবে ক! চাকরি করবি। হয়, চাকরি গাছে ফলতিছে! সুহাস আর কিছু বলে না। ট্রানজিস্টারটা নিয়ে খুচরো শব্দ করে শুধু আর বেঢপ বুটজুতো দিয়ে ধুলো ছড়ায়। নাকে ধুলো এসে লাগতেই রুখু গন্ধ পাওয়া যায়। ইনামের বিকেলের কথা মনে পড়ে, হাটবারের কথা, মাছের কথা। মাছ থেকে নদী। নদী এখন প্রায় শুকনো, চড়া পড়ে গেছে। গরুর গাড়িতে লোকে বালি আনছে নদী থেকে। বাঁকের কাছে কাশ হয়েছে। এ পাড়ে স্কুলবাড়ি, বড় সজনে গাছে ফিঙে, তার লম্বা রেজের দুলুনি। স্কুলের পেটা ঘড়ি ভেঙে গেলে এক টুকরো রেল ঝুলিয়ে লোহার ডাণ্ডায় ঘনাৎ ঘনাৎ আওয়াজ—হুড়মুড় করে হেড মাস্টার…শালার জোকার একডা, বই বগলে মাস্টার তারাপদ, তার পাকানো চাদর, আধভাঙা দাঁত, আর মুখে কথার ফেনা। এই সব মনে পড়ল। ঝর ঝর করে ছবিগুলো এলো; যেন দক্ষিণ বাতাসে নিমের হলুদ শুকনো পাতা ঝরে পড়েছে, আর ছবিগুলো চলে গেল যেন ট্রেনটা যাচ্ছে পুল পেরিয়ে, মাঠের বুক চিরে আর ন্যাংটো ছেলেটা দাঁড়িয়ে দেখল। ছবিগুলো পেরিয়ে যেতেই খেয়াল হয় সুহাস সেই গল্পটা আরও তোড়জোড় করে বলছে, ছোট মামার বিয়ের বরযাত্রী যাবার গল্প। ওর একটা কথাও শুনছে না ফেকু, সে দাঁড়িয়ে পড়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। চাঁদের আলোর মধ্যে দেশলাই-এর আগুনটা দেখালো ম্যাড়মেড়ে আর ফেকুর বিতিকিচ্ছি মুখটা দেখা গেল, কপালের কাটা দাগটা, মুরগির মত চোখ, নিচে ঝোলানো ঘোড়ার মত কালো ঠোঁট। খাবি নাহি? ফেকু জিগগেস করে। সুহাস গল্প থামিয়ে সিগারেট নেয়, দেশলাই-এর কাঠিটা নিভে যাওয়ায় আর একটা জ্বালায় তারপর আবার গল্প শুরু করে, লঞ্চে যাতি হয় তো, মধুমতী নদী দিয়ে—অন্ধকারের মধ্যি গেলাম—দুপাশে গেরাম না কি কিডা জানে—মনে হচ্ছিল সোন্দরবন। এমন অন্ধকার আর এমন জোঙগল বুজিচো? ইনামের মনে হলো সুহাস গতকাল থেকে গল্পটা বলছে আর আগামীকাল পর্যন্ত বলবে। নাপিত বিটা কমিয়ে কতি পারে না? একেবারে অসহ্য লাগলে এই কথা ভাবল ইনাম।

সুহাসের গল্পে একশোটা পল্লব—ছোট মামার চেহারার বর্ণনা, বিয়ের সম্বন্ধ, পাত্রীর খোঁজ, পাত্রীর কাকার সঙ্গে ছোট মামার বাবার ঝগড়া, বিয়ের দিন ধোপাবাড়ি থেকে সিল্কের পাঞ্জাবি ভাড়া নিয়ে আসার ঝকমারি—কিচ্ছু বাদ দিচ্ছিল না সে—তাই ইনাম খেপে গিয়ে বলল, তোর ছোট মামা বিয়ে করতি গিলো ক্যানো ক তো? সুহাস কান দিল না : সকালে সূর্য উঠতি মধুমতী ঝকঝক করিতেছি, জ্যাঠামশাই ধপ করে কাদায় পড়িলো লঞ্চ থেকে নামতি গিয়ে আর মামীর বোনেরা যা সোন্দর সে আর কলাম না। তোর মামার বাড়িটা কোয়ানে, মামার শালীরা বেড়াতি আসলি কস আমাকে—ফেকু কথা না বললেই নয়, তাই বলে। সেটি হচ্ছে না, বুজিচো—চোখ বন্ধ করে মনের আরামে বলল সুহাস। ও, তাই তুমি মাসে পাঁচবার করে ছোট মামার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতি যাচ্ছো? বুজিচি, ওখেনে তো পয়সাকড়ি লাগে না; আরামেই আছো দেহা যায়—ফেকু চোখ মটকে বলে।

রাহাত খানের টিনের চাল দেখা যাচ্ছে না আর, পুল কোথায়, বিল সরে গেছে কখন। চাঁদমণির বাড়ির লোকজন চুপ করে গেছে। একটা মুরগির শোক আর কতক্ষণ থাকে! কাল হয়ত বসু বাবুদের ইটখোলায়, না হয় সরকারদের পড়ো বাড়ির ভেঙে-পড়া সিঁড়ি ঘরের মধ্যে বেচারির চকচকে পালক, হরদে ঠ্যাং কিংবা ঠোঁটের টুকরো পাওয়া যাবে। চাঁদমণির বাড়ির লোকজন কাজেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু বুড়িটা বসে আছে, ফাটা পায়ে তেল ঢালছে আর পিদিমটা কেন নিভছে না তা পিদিমটা ছাড়া আর কেউ জানে না। কি ঠাণ্ডারে বাবা—বউ অ বউ, আর একটা খ্যাঁতা দে, মরে গেলাম, হেই বউ। বউটা কুম্ভকর্ণের ঘুম ঘুমাচ্ছে, ছেলেটা বকছে বিড়বিড় করে, মরে যাচ্ছে না ক্যানে কেডা জানে! বুড়ি আর একবার চেঁচায়, কিন্তু হঠাৎ হাওয়াটা ওঠে, সুমসাম শব্দ জাগে, বুড়ির কাঁপা গলা কেউ শুনতে পায় না। এই রকম জীবন চলতে থাকে। ফেকু ঠোঁটে কুলুপ দেয়, সুহাস হঠাৎ ট্রানজিস্টারের চাবিটা ঘট করে খুলেই বন্ধ করে, ইনাম মাথা নিচু করে ভাবতে থাকে।

রাস্তা ছেড়ে ঘাসের ওপর পা ঠুকে ধুলো ঝাড়ে ওরা। পাশের গলি-পথটার ঢোকার সাথে সাথে জাপটে ধরে অন্ধকার আর সপাং করে চাবুক চালিয়ে দেয় কি একটা লতা। ফেকুর ঠোঁট খোলে, জঘন্য একটি গাল দিয়ে ওঠে লতাটিকে। তারপর শান্ত হয়ে গল্প শুরু করে, শালা, আজকাল এত বেশি ধরা পড়তিছি ক্যানে কতি পারিস? এই কথায় সুহাসের চোখ দুটি চকচক করছে কৌতূহলে, একটা কথা কই, কিছু কবি না ক? ফেকুর সম্মতির অপেক্ষা না রেখেই সে বলে, অত মার খাস কি করে, আমাকে বলতি পারিস? শালার দাদা এক চড় মারলি চোহে অন্ধকার দেহি। মার খাওয়াডা শিখতি অয় বুঝিচো বাপধনু—ওস্তাদের কাছে শিখতি অয়। লেহাপড়ার জন্যি ইস্কুলি যাতি অয় যেমন, তেমনি—ফেকু বলে। ইনামের আবার অসহ্য লাগে, ইস্কুলি লেহাপড়া বিয়োচ্ছে, বিটার শালারা মাস্টাররা—ইনাম এমন কথা বলে যা মুদ্রণযোগ্য নয়। ফেকু তখন বলছে, ইষ্টুপিট হলি আর মার খাতি না জানলি মান্‌ষের পহেটের কাছে যাতি নেই পহেটথে—ট্যাহা বারোয়ে থাকলিও না। টাকার কথা শুনে ইনাম অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়ল। টেন্ডু ড্রাইভারের কথা শুনে একবার ভিড়ে হাত দিয়েছিল বঁটিমুখো এক ভদ্রলোকের পকেটে। কাগজ খড়মড় করে উঠল আর এমন শব্দ উঠল যে মনে হলো কানে তালা লেগে যাচ্ছে। অ্যাও বলে গড়র গড়র গর্জন করে উঠল লোকটা। কিন্তু আসলে ভদ্রলোক গলা ঝাড়ছিল। কাজেই ইনামের কাছে পয়সা নেই। নারকেল চুরি করে বিক্রি করলে হয়; কিন্তু ভাতের চালের অভাবে উপোস করে থাকতে বড়ো কষ্ট।

পথটায় অন্ধকার থকথক করছে। মাথার ওপর বাঁদিকের লতা ডানদিকে চলে গেছে জাল বুনতে বুনতে। গল্পের ঝোঁকে ফেকু সুহাসের ওপর এসে পড়ে আর সুহাস চিৎকার করে, উরে, মরিছিরে বাপ। ফেকু বলে, দেহিস রেডিওডা ফালাস না।… সেদিন কি হলো ক দিনি, এক বাস লোক—বাস যাচ্ছে চল্লিশ মাইল পঞ্চাশ মাইল স্পীডি, সামনের লোকটার পাঞ্জাবি পহেটথে নোটগুলো বারোয়ে আছে—হাত দিতি খপ্‌ করে ধরে ফেলল। তারপর উরে মারে, ভাগাড়ে যেন গরু পড়িছে। কপালের ঘা শুকোয় নি এহনও। এইবার গুণ্ডোটা শুরু করিছে—ইনাম ভাবল। গল্প শুনতে শুনতে সুহাস ট্রানজিস্টারটা চালিয়ে দেয়, গর্জন করে ওঠে সেটা। আওয়াজটা কিম্ভূত শোনা যায় ঠাণ্ডা আর স্তব্ধ অন্ধকারে। সুহাস থু-থু ফেলে বলে, শালা খ্যাল গাতিছে—বলেই চাবি বন্ধ করে এবং ‘তুমি যে আমার জীবনে এসেছ’ ধরে দেয়। ভিটে থেকে একটা কুকুর উঠে এসেছে—ক্ষীণ চিৎকার করার চেষ্টা করছে। গলা যখন ফুটল না, ইনামের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে সমস্ত পাছাটা দোলাতে শুরু করে। নড়েচড়ে গরম হতিছ শালা—ফেকু মন্তব্য করল এবং কেন তার জীবন নষ্ট হলো, কে কে নষ্ট করল আর পকেট মারার কৌশল, তার নিজস্ব নৈপুণ্য, সাফল্য আর পিটুনি খাওয়ার অভিজ্ঞতা বলেই যেতে লাগল। করবটা কি কতি পারিস? লেহাপড়া শিখলি না হয়—। লেহাপড়ার মুহি পেচ্ছাপ—ইনাম বলল। আবার অসহ্য লাগল ওর। তাহলি—ফেকু ভেবেচিন্তে বলল, উঁচো জায়গায় দাঁড়োয়ে সবির ওপর পেচ্ছাব। কাজ কোয়ানে? জমি নেই খাঁটি, ট্যাহা নেই ব্যবসা করি—কি কলাডা করবানে?

পাখিদের কোন গান নেই এখন। শব্দ যা শোনা যাচ্ছে চাপা। কুয়াশা আর হিম জড়িয়ে আছে ওদের। সামনে বিড়ালটা যখন পার হয়ে গেল, শুধু দুটি জ্বলজ্বলে চোখ দেখা গেল তার। সুহাস ফেকু ইনাম কথা বন্ধ করেছে। সুহাসের বগলে ট্রানজিস্টার, ফেকু মাফলার মুখের ওপর জড়িয়ে নিল, ইনাম হাতে হাত ঘষে একটু গরম করতে চেষ্টা করল। ডাইনে পালদের বাড়ি, মাটির হাঁড়িকুড়ি তৈরি করে, পরিচয় জিগগেস করলে রাস্তা থেকে হেঁকে জবাব দেয়, পালমশাই; তাদের বাড়ির পলেস্তরা-খসা দেয়াল, কারণ বাড়িটা আসলে সেনদের। ওরা চলে গেছে পঞ্চাশে। বাতাবিলেবু গাছটার পাশ দিয়ে যেতে চড়াৎ করে একটা পাতা ছেঁড়ে ইনাম আর উঠোনটার দিকে চেয়ে তাকে। পোড়ামাটির গন্ধ নাকে লাগে, কালো জালাগুলো ছড়িয়ে আছে দেখা যায়, ভাঙা দরজার ফাঁক দিয়ে ঘুম-জড়ানো গোঙানি ভেসে আসে। সব ঘুমোয়ে পড়েছি—সুহাস বলে। ফেকু সায় দেয় ঘোঁৎ করে। আজ না আসলিই হতো—সুহাস অভিযোগ করতে থাকে, ভয় করতিছে আমার। ফেকু ভ্যাংচায়, ভয় করতিছে, কচি ছ্যামরা, দুধু খাবা! সুহাস বলেই চলে, বুড়োরে দেখলি আমার ভয় করে। একবার মনে হয় মরে যাবেনে এহুনি, একবার মনে হয় আমাদের সব কডারে খুন করবেনে। বাড়ির মধ্যি ঢোহার সময় মুখডা দেহিছিস? দেহিছি—তুই থো, তাচ্ছিল্য করে ফেকু, পয়সা পালি মুখডা কেমন হয় দেহিস একবার। ফেকু হারামজাদাটারে খুন করতি পারলি হতো—ইনাম ভাবল। তখুনি সুহাস ফেকুর দলে মিশল। সে বলছে, এট্টু এট্টু সর হইছে এমন ডাবের মত লাগে মেয়েডারে। ঠিক কইছি না, ক? তোরেও খুন করতি পারলি হতো—ইনাম আবার ভাবল।

ওরা এখন হাসাহাসি করছে, ঢলাঢলি করছে, কলবল করে আলাপ করছে। দু পা এগিয়ে বাড়ির ভেতরে ডাক্তার বাবু বসে আছেন—মোটা শাদা বিরাট শরীর, হারিকেন জ্বলছে, তাই খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেল। পুকুরের বাঁধা-ঘাটে একটি মাত্র শুকনো পাতা তখন ফর ফর পাক দিতে থাকল। বাঁদিকের খোলা জায়গাটা এসে গেছে, কুয়াশার সঙ্গে মিশে ঘোলা দুধের মত চাঁদের আলো খুদে খুদে মরা ঘাসের ওপর পড়েছে। পেছনের জামগাছটা কালো, তার পেছনে সব কালো এবং নির্জনতা। আর এই সব ছাড়িয়ে যেতে আরও নির্জনতা, পোড়োজমি, জঙ্গল, পানের বরজ, কাশ আর লম্বা ঘাস আর মজা পুকুর আর বিল। এখন ডাইনে দড়ি দিয়ে ঝোলানো বাঁশের গেট। গেট পেরিয়ে খানিকটা ফাঁকা জমি চিৎ হয়ে শুয়ে। কিছুই ফলে নি সেখানে। ইনাম পিছনে আছে, অনেকটা পিছনে, এমন কি ফিরে যেতে পারে হঠাৎ এমন মনে হচ্ছে। লাল আলো আসছে কাঠের রড লাগানো জানলা দিয়ে। মজা পুকুরে শিয়ালের চকচকে চোখে ঝিলিক। ঘোড়ার মতো চিঁহি চিঁহি করে ডেকে ঝটপট করে পুরনো ডাল ভেঙে বাজ পাখিটা নড়েচড়ে বসল। ফেকু দড়ি ঝোলানো বাঁশগুলো তুলে ধরেছে, হাত নেড়ে ডাকছে সুহাসকে, সুহাস ট্রানজিস্টারটা হাতে নিয়ে অন্য হাতে ঠোঁট চেপে আছে, কিছুতেই এগুচ্ছে না। ইনাম চট্‌ করে সামনে এসে ফেকুর কাছে টাকা চায়, দুডো ট্যাহা দে—কাল দিয়ে দেবানে। বাঁশগুলো ছেড়ে দেয় ফেকু, অ, খালি হাতে মজা মারতি আইছ? মুহূর্তে সোনালি হাত সামনের আবছায়ায় ভেসে ওঠে। সেই হাত মাথায় রাখে। চুল সামনে করে দেয়। আঙুলে তেল লাগলে আঁচলে মোছে। ইনাম নিজে কিনে দিলেও মিলের শাড়িটা খুলে নেয়া যায় না তখন। ব্যাকুল হয়ে ইনাম বলে, দুডো ট্যাহা দে, কাল দেবানে সত্যি কচ্ছি। ট্যাহা লাফাচ্ছে, মোডে দুডো ট্যাহাই আছে আমার কাছে—ফেকুর মুলোর মতো দাঁতগুলো কড়মড় করে ওঠে। তাহলি সুহাস দে—দে সুহাস কচ্ছি, কাল দিয়ে দেবানে, ঠিক কচ্ছি, দে সুহাস, তোদের মা কালীর দিব্যি, কাল দিয়ে দেবানে—ছটফট করে ইনাম। সুহাস বলে ফেকুকে, কিছু কয় নি এতক্ষণ, কেমন গুডি গুডি আসতিছিল দেহিছিস? উরে তুই কি ইস্টুপিট—সে হাসে, মাইরি কচ্ছি, পহেটে হাত দিয়ে দ্যাখ—দুডো ট্যাহা আছে মোডে, দাদার পহেটথে মারিছি, মাত্তর দুডো ট্যাহা। তখন ইনাম ক্ষান্ত হয়। গেটের কাছে ফেকু আর সুহাস গলাগলি দাঁড়িয়ে। জানলার কাঠের রডে মুখ লাগিয়ে বুড়োমানুষ চিৎকার করে, কে, কে ওখানে গো—অ্যাঁ? লাল আলোটা সরে যায় জানলা থেকে, হড়াম করে দরজা খোলে, হাতে হারিকেন নিয়ে খোলা জায়গা পেরিয়ে গেটের কাছে আসে মানুষটা। সমস্ত উঠোনটায় বিরাট ছায়া, খাটো লুঙ্গির নিচে শুকনো দুটো পা। গেটের পাশে করবী গাছটার কাছে এসে দাঁড়ায়। আলোটা মুখের কাছে তুলে ধরে লোকটা। বোশেখ মাসের তাপে মাটিতে যেন ফাটলের আঁকিবুকি এমনি ওর মুখ। ঠাণ্ডা চোখে ইনামকে দেখে, সুহাসকে দেখে, ফেকুকে দেখে, দেখতেই থাকে, বিঁধতেই থাকে, হারিকেনের বাতিটা তোলে কাঁপা হাতে, এসো। তোমরা? ভাবলাম কে আসছে এত রাতে। তা কে আর আসছে এখানে মরতে? জেগেই তো ছিলাম। ঘুম হয় না মোটেই—ইচ্ছে করলেই কি আর ঘুমানো যায়—তার একটা বয়েস আছে—অজস্র কথা বলতে থাকে সে, মানে হয় না, বাজে কথা বকবক করেই যায়। এসো, বড্ড ঠাণ্ডা হে, ভেতরে এসো। কিন্তু ভেতরে কি ঠাণ্ডা নেই। একই রকম, একই রকম। দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর বাইরে নেই। সব এক হয়ে গেছে। সবাই ভিতরে আসতে করবী গাছটার একটা ডাল ঝটকানি দেয়—পায়ের নিচে মাটি ঠাণ্ডা শক্ত আর সেজন্য ইনামের গোড়ালিতে ব্যথা করছে।

ভিতরে কালো রঙের চৌকিটা পড়ে আছে। ঘুমের মধ্যে মুরগিগুলো কঁ কঁ করে উঠলো। আবার হু-উ-উ চিৎকার এলো। বিলে বাতাস উঠছে শোনা গেল। ভাঙা চেয়ারে ভদ্রলোকটি বসে। হারিকেন মাটিতে নামানো। ওরা তিনজন চৌকিতে কাছাকাছি বসেছে। কেউ কথা বলছে না। বুড়োর অ্যাজমার কষ্টের নিশ্বাস পড়ছে। তুখোড় লোকটা এখন চুপ—ভস ভস বাতাস ছাড়ছে মুখ দিয়ে। খোঁচা খোঁচা শাদা দাড়ি দেখা যাচ্ছে। শিরাওঠা আঙুলগুলো চেয়ারের হাতলে পড়ে আছে। নোংরা নখ দীর্ঘদিন কাটা নেই। গলার কাছে শ্লেষ্মা এসে জমলে বাতাস যাওয়া আসা প্রায় বন্ধ হয়ে এলো। ইনামের ইচ্ছা হলো একটা নল দিয়ে সাফ করে দেয় ফুটোটা। তারপর কি খবর? অ্যাঁ? সব ভালো তো? ঘড় ঘড় করে একটানা কথা আরম্ভ হয়। আক্ষেপ বিলাপ, মরে গেলেই তো হয় এখন, কি বলো তোমরা? টক করে মরে গেলাম ধরো। তারপরে? আমার আর কি—ড্যাং ড্যাড্যাং ড্যাং, চলে গেলাম, বুঝে মরগে তুই বুড়ি—ছানাপোনা নিয়ে বুঝে মরগে।…এই তোমরা একটু আধটু আসো, যখন তখন এসে খোঁজখবর নাও। সময় অসময় নেই বাবা তোমাদের। তোমরাই ভরসা, আমার পরিবার তোমাদের কথা বলতে অজ্ঞান। ফেকু ভয় পেয়ে গেছে এখন। বুড়ো মুখের দিকে বার বার চেয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে আর সিঁটিয়ে যাচ্ছে। সুহাস চোখ দুটো গোল গোল করে চেয়ে আছে। বুড়ো মুখ এখন বহুরূপী। সুহাস ভাবছে, বুড়োটা খুন করবেনে মনে হতিছে আমার। আজ ক্যানো যে আলাম! না আসলিই ভালো হতো। …তোমরা না থাকলে না খেয়ে মরতে হতো এই জঙ্গুলে জায়গায়—বুড়ো বলছে, বাড়ির বাগান থেকে অন্ন জোটানো আবার আমাদের কম্ম—হ্যাঃ। ওসব তোমরা জানো। আমরা শুকনো দেশের লোক, বুইলে না? সব সেখানে অন্যরকম, ভাবধারাই আলাদা আমাদের। এখানে না খেয়ে মারা যেতাম তোমরা না থাকলে বাবারা! ছেলেমেয়েগুলো তোমাদের কি ভালোই না বাসে! এই দ্যাখো না, বড় মেয়েটা, রুকু এখন চা করতে যাচ্ছে তোমাদের জন্যে—একটা শ্লেষ্মার দলা শ্বাসনালীটাকে একবারে স্তব্ধ করে দেয়, তাতে চোখ কপালে তুলে বুড়ো কাশছে। কথার খই ফুটছিল অথচ এখন মরে যাবে নাকি? আমরা চা খাবো না, আমরা চা খাবো না—চিৎকার করে ওঠে সুহাস আর ফেকু। খাবে না? বুড়ো সামলে নিয়ে শান্তভাবে বলে অ, ঠিক আছে। তাহলে তোমরা এখন চা খাবে না—অ্যাঁ—আচ্ছা, ঠিক আছে।

বিল থেকে বাতাসটা উঠে আসছে। এখন অশথ গাছটার মাথায় ঘুরছে, পাক খাচ্ছে, এগিয়ে আসছে, খঞ্জনির বাজনাও এগিয়ে এলো সঙ্গে, খোলের চাঁটি আর কি বিশাখার কথা, কি তমালের কথা—সব এসে আবার দূরে চলে গেল। সুহাসের চাদরের মধ্যে নোট খড়মড় করে। সেগুলো নিয়ে ফেকু নিজের পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে, দলা পাকায়, ভাবে, ভয় পায়, শেষে বুড়োর দিকে ঝুঁকে পড়ে, সুহাস আর আমি দিচ্ছি।

চেয়ারের ওপর লোকটা ভয়ানক চমকে ওঠে। পড়ে যাবার মত হয়। খটাখট নড়ে পায়াগুলো, তোমরা দিচ্ছ, তুমি আর সুহাস? দাও। আর কত যে ধার নিতে হবে তোমাদের কাছে! কবেই-বা শুধতে পারব এই সব টাকা? সুহাস উঠে দাঁড়ায়। চলে যাবে এখন? এত তাড়াতাড়ি? রুকু রাগ করবে—চা করতে দিলে না ওকে। ওর সঙ্গে দেখা না করে গেলে আর কোনদিন কথা বলবে না। দাঁড়াও—হারিকেনটা রেখে বুড়ো বেরিয়ে যায়। ছায়াটা ছোট হতে হতে এখন নেই। মুরগিগুলো আবার কঁ কঁ করে ওঠে, কথা বলে ওঠে এক বৃদ্ধা স্ত্রীলোক। তীক্ষ্ণ গালাগালি অন্ধকারকে ফাড়ে, চুপ, চুপ, মাগি চুপ কর, কুত্তী—এবং সমস্ত চুপ করে যায়। বুড়ো ফিরছে এখন—মাথা নামিয়ে কাঁধ ঝুলিয়ে ঘরে ফিরে এসে ফিস ফিস করে, যাও তোমরা, কথা বলে এসো, উই পাশের ঘরে। ইনাম তুমি বসো, এখখুনি যাবে কেন? এসো গল্প করি।

বুড়ো গল্প করছে, ভীষণ শীত করছে ওর, চাদরটা আগাগোড়া জড়িয়েও লাভ নেই। শীত তবু মানে, শ্লেষ্মা কিছুতেই কথা বলতে দেবে না তাকে। আমি যখন এখানে এলাম, আমি যখন এখানে এলাম, হাঁপাতে হাঁপাতে, কাঁপতে কাঁপতে সে বলছে, বুঝলে যখন এখানে এলাম … তার এখানে আসার কথা আর কিছুতেই ফুরোচ্ছে না—সারারাত ধরে সে বলছে, এখানে যখন এলাম—আমি প্রথম একটা করবী গাছ লাগাই … তখন হু হু করে কে কেঁদে উঠল, চুড়ির শব্দ এলো, এলোমেলো শাড়ির শব্দ আর ইনামের অনুভবে ফুটে উঠল নিটোল সোনারঙের দেহ—সুহাস হাসছে হি হি হি—আমি একটা করবী গাছ লাগাই বুঝলে? বলে থামলো বুড়ো, কান্না শুনল, হাসি শুনল, ফুলের জন্যে নয়, বুড়ো বলল, বিচির জন্যে, বুঝেছ, করবী ফুলের বিচির জন্যে। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে। আবার হু হু ফোঁপানি এলো আর এই কথা বলে গল্প শেষ না করতেই পানিতে ডুবে যেতে, ভেসে যেতে থাকল বুড়োর মুখ—প্রথমে একটা করবী গাছ লাগাই বুঝেছ আর ইনাম তেতো তেতো—এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি?

১৯৬৬


হাসান আজিজুল হক বাংলা ভাষার একজন অসামান্য কথাসাহিত্যিক। গত ১৫ নভেম্বর, ২০২১ তারিখে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য। আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাংলা সাহিত্যের এই গুনী মানুষটিকে। তিনি ৮২ বছরের এক সফল জীবন পেয়েছিলেন। শুধুমাত্র গল্প লিখেই যে সাহিত্যের এত উচু আসনে নিজেকে বসানো যায় তার চমৎকার উদাহরণ হাসান আজিজুল হক। তিনি মাত্র ৩ টি উপন্যাস লিখেছিলেন সেটিও জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। ‘আগুনপাখি'(২০০৬) সাড়া ফেলে দিয়েছিল বাংলা সাহিত্য জগতে। যে কয়েকজন শিল্পী দেশভাগের বেদনা, যন্ত্রনা আর অসারতার কথা নিপুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাদের গল্প, কবিতা, সিনেমায় তাদের মধ্য হাসান আজিজুল হক অন্যতম। গল্পে তিনি সবার উপরে ।

বাংলা গল্পকে তিনি নিয়ে গেছেন এক অন্যন্য উচ্চতায় । ১৯৩৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে জন্ম , তারপর বেড়ে ওঠা সব ওপার বাংলার বর্ধমান জেলায়। দেশভাগের পর এদেশে এসে পুরো জীবন কাটিয়ে দিলেন। প্রান্তিক মানুষের জীবন সংগ্রাম, বেঁচে থাকার চেষ্টা তার গল্পে বারবার নানান ইঙ্গিতে ফিরে এসেছে।

আমরা লেখকের সবচেয়ে আলোচিত একটি গল্প ‘ আত্নজা ও একটি করবী গাছ’ আপনাদের জন্য তুলে দিলাম।

সম্পাদক, শিল্প বিভাগ


আরো পড়ুন :

শঙ্খ ঘোষের কবিতা

শামসুর রাহমানের কবিতা

৬,৫৫৭ thoughts on “‘আত্নজা ও একটি করবী গাছ’

  1. customary and thank you for visiting online casino agents for Indonesia.
    Here we are here to give entry for fans of sbobet casino who desire to link the international agent site Promosbobet.

    The products offered are agreed diverse and are completely the best choice.
    Derived from providers that have credibility and have been proven to have the best predicate in serving their customers.
    Providers past Sbobet, Maxbet and many more.

    As the best online casino and soccer gambling site in Indonesia.
    We have enough money maximum assistance later than customer sustain that works online 24 full hours all day.
    as a result members can appear in whenever and wherever without fearing to approach the possibility of difficulties or
    confusion.

  2. Wonderful goods from you, man. I have understand your stuff previous to and you’re just too magnificent.

    I really like what you have acquired here, really like what you’re stating and
    the way in which you say it. You make it entertaining and you still take
    care of to keep it sensible. I can not wait to read much more from you.
    This is actually a wonderful site.

    My blog 바둑이사이트

  3. hey there and thank you for your information – I’ve definitely picked up anything new from right here.
    I did however expertise some technical points using this
    website, since I experienced to reload the site lots of times previous
    to I could get it to load properly. I had been wondering if your web hosting is OK?
    Not that I am complaining, but sluggish loading instances times will often affect your placement in google and could damage your high-quality score if advertising and
    marketing with Adwords. Well I’m adding this RSS to my e-mail and could look out for
    much more of your respective exciting content. Make sure you update this again very soon.

  4. The Most Trusted Soccer Gambling Real estate agent in Indonesia Serving Provides of Gambling and Online casino Gambling
    Userbola is the particular Most Trusted and Official SBOBET Agent in Indonesia.
    We serve bets of which provide soccer gambling games, online gambling games, on line casino gambling agents, poker plus online lottery.

    We will wholeheartedly always be ready to help what you
    may want and help you if there are difficulties in producing SBOBET Online Betting Company accounts,
    MAXBET Agents or previously called IBCBET, Serba4d or KLIK4D lottery.

    Brand new twenty percent Member Bonus with typically the Best and a lot Dependable Soccer Gambling Real estate agent
    Userbola is usually the Best SBOBET Agency plus the Biggest Football Agency in Indonesia,
    always supplying 24-hour online service with the need
    to stop at the same time of registering, lodging, withdrawing and responding to your every complaint.

    Regarding more information, please go directly to
    livechat plus chat directly with our friendly CS

    Register with regard to Sbobet right now!

    Full Selection for Trusted Football Wagering and
    On line casino Providers
    Regarding you fans of wagering soccer matches both
    overseas and domestic, reliable soccer gambling provides
    various matches from around the globe. Not necessarily just that, basketball, rugby plus eSports tournaments will also be here.

    Especially for connoisseurs associated with Casino Agents, we have got one of
    the most complete range regarding online games which
    range from Baccarat, Poker, Keno, Slot machine game
    and many more.

    Userbola is 1 of the trusted football gambling sites that functions as a real estate agent of the particular tour’s major soccer bookies
    like SBOBET, Ibcbet in addition to Mahabet Sport. You may definitely get a
    nice experience while betting due to interesting
    features made available from this web site. Userbola has an expert service when you make downpayment transaction until pulling out
    money.
    Before you enter the sports gambling game on Userbola you
    must register very first and become a customer.

    The strategy is very effortless, all you have in order to do is click on the list and
    enter the registration form web page and you will move
    directly to our major website.

  5. First off I would like to say superb blog!
    I had a quick question which I’d like to ask if you don’t mind.
    I was curious to know how you center yourself and clear your head prior to writing.
    I’ve had difficulty clearing my mind in getting my thoughts out.

    I truly do take pleasure in writing however it just seems like the first 10 to 15
    minutes tend to be wasted just trying to figure
    out how to begin. Any recommendations or tips? Thank you!

  6. I don’t know whether it’s just me or if perhaps everybody else encountering problems with your website.
    It appears as if some of the text in your content are running off the screen.
    Can somebody else please comment and let me know if this is happening to them too?
    This may be a issue with my web browser because I’ve had this happen before.
    Thank you

    Here is my web page; 메이저사이트

  7. My developer is trying to convince me to move
    to .net from PHP. I have always disliked the idea because of the costs.

    But he’s tryiong none the less. I’ve been using WordPress
    on various websites for about a year and am nervous about switching to another platform.

    I have heard fantastic things about blogengine.net.
    Is there a way I can transfer all my wordpress content into
    it? Any help would be greatly appreciated!

  8. What i don’t understood is if truth bbe told how you are no longer really much more well-preferred than yoou may be
    right now. You’re so intelligent. You recognize therefore significantly
    in the case of this subject, made me for my part imagine it from a lot
    of numerous angles. Its like women and men don’t seem to be
    interested until it’s one thing to doo with Girl gaga!
    Your personal stuffs excellent. All the time deal with it up!

  9. First off I want to say fantastic blog! I had a quick
    question that I’d like to ask if you do not mind.
    I was interested to find out how you center yourself and clear your
    mind before writing. I’ve had trouble clearing my thoughts in getting my thoughts out.
    I do take pleasure in writing but it just seems like the first
    10 to 15 minutes are usually wasted just trying to figure out how to begin. Any ideas or tips?

    Thank you!

  10. Undeniably believe that which you stated. Your favorite reason seemed to
    be on the internet the simplest thing to be aware of.
    I say to you, I certainly get irked while people consider worries that they plainly don’t know about.
    You managed to hit the nail upon the top and also defined out the whole thing without having side-effects
    , people can take a signal. Will probably be back to get more.
    Thanks

  11. hey there and thank you for your info – I’ve definitely picked up something new from right here.

    I did however expertise a few technical issues using this web site, since I experienced to reload the web site lots
    of times previous to I could get it to load
    correctly. I had been wondering if your hosting is OK? Not that I’m complaining, but sluggish loading instances times will sometimes affect your
    placement in google and can damage your high-quality score if ads and marketing with Adwords.

    Anyway I am adding this RSS to my e-mail and can look out for much more of your respective exciting content.
    Ensure that you update this again soon.

  12. First of all I want to say excellent blog! I had a quick question which I’d like to
    ask if you don’t mind. I was interested to know how you center yourself and
    clear your head prior to writing. I’ve had a tough time clearing my thoughts in getting my thoughts out
    there. I truly do enjoy writing but it just seems
    like the first 10 to 15 minutes are usually lost just trying to figure out
    how to begin. Any recommendations or hints?
    Cheers!

  13. heyy there and tank you for your information –
    I’ve definitely picked up something new from right here.
    I did however expertise several technical points
    using this site, as I experienced to reload the web site
    a lot of times previous to I could get it to load properly.
    I had been wondering if your web hksting is OK?

    Nott that I am complaining, bbut sluggish loading instances times will
    often affect your placement in google aand could
    damage your high quality core iff ads andd marrketing
    wuth Adwords. Well I’m adding this RSS to my e-mail
    and couod look out for much more of your respective exciting content.
    Ensure that you update this again soon.

  14. TD BANK has the absolute WORST business banking I
    have ever encountered in my life. HORRIBLE
    HORRIBLE HORRIBLE.!! They considered Lyft a possible fraudulent transaction and
    denied them. Lyft kept trying over and over again with
    “zero” dollar authorizations and the attempts took
    my daily transactions over the limit resulting in a card transaction block.
    I called customer service and after waiting on hold for a ridiculous 20 minutes, they told
    me there was nothing they can do until after midnight.
    They impose these limits but when they are not justified you are stuck with being stuck.
    Since I didn’t have a backup credit card on hand, I was stranded at
    the airport. This is NOT good for any business. I suggest everyone stay away and
    use another bank! This one sucks for business
    banking. Personal accounts are ok but business banking stinks like no other!

  15. Definitely believe that which you said. Your favorite justification seemed to be on the internet the easiest thing to be aware of.

    I say to you, I definitely get annoyed while people consider worries that they
    plainly do not know about. You managed to hit the nail upon the top and
    also defined out the whole thing without having side effect , people can take a signal.

    Will likely be back to get more. Thanks

  16. My coder is trying to persuade me to move to .net from PHP.
    I have always disliked the idea because of the costs.
    But he’s tryiong none the less. I’ve been using Movable-type on several websites for about a year and am worried about switching
    to another platform. I have heard good things about blogengine.net.
    Is there a way I can import all my wordpress posts into it?
    Any help would be greatly appreciated!

  17. Hey! I know this is kinda off topic nevertheless I’d figured I’d ask.
    Would you be interested in exchanging links or maybe guest authoring a blog
    article or vice-versa? My blog covers a lot of the
    same topics as yours and I think we could greatly benefit from each other.
    If you are interested feel free to shoot me an e-mail.
    I look forward to hearing from you! Superb blog by the way!

  18. What I can share with you are the common denominators that increase conversions
    through a forceful value proposition and, more mportantly how to
    weigh the value proposition more forcefully.
    Let’s say you’re pumping $10,000 into SEO every month.
    Thinking that you will earn the oney quicky online is senseless. https://digital-marketing.3kmio.org/nghe-digital-marketing-la-gi-luong-bao-nhieu-vao-nghe-nhu-nao-mayashare/

  19. What i do not understood is in fact how you are no longer actually much more smartly-appreciated than you
    might be now. You are so intelligent. You realize therefore significantly with regards to this matter, produced me for my part believe it from
    so many various angles. Its like men and women are not fascinated unless it’s one thing to
    do with Woman gaga! Your personal stuffs great. At
    all times deal with it up!

  20. What you wrote was actually very logical. However, what about this?

    suppose you were to create a awesome headline? I ain’t saying
    your content isn’t solid., however suppose you added a headline that grabbed folk’s attention? I
    mean 'আত্নজা ও একটি করবী
    গাছ' – আলোর দেশে is kinda vanilla.

    You should look at Yahoo’s home page and note how they create news headlines
    to grab viewers to open the links. You might add
    a related video or a related picture or two to grab people interested about everything’ve got to say.
    In my opinion, it might bring your blog a little livelier.

  21. My developer is trying to persuade me to move to .net from PHP.
    I have always disliked the idea because of the expenses.
    But he’s tryiong none the less. I’ve been using WordPress on various websites for about a year and am nervous about switching to another platform.
    I have heard fantastic things about blogengine.net. Is there a way I can import all my
    wordpress content into it? Any kind of help would be really appreciated!

  22. Hi there! I know this is somewhat off-topic however I
    had to ask. Does running a well-established website such as
    yours take a large amount of work? I am brand new to running a blog but
    I do write in my journal every day. I’d like to start a blog so I will be able
    to share my experience and views online. Please let
    me know if you have any kind of recommendations or
    tips for brand new aspiring blog owners. Appreciate it!

  23. What you published was very logical. But, consider this, what
    if you added a little content? I mean, I don’t wish to tell
    you how to run your website, however what if you added
    something to possibly get a person’s attention? I mean '
    আত্নজা ও একটি করবী গাছ' – আলোর দেশে is kinda vanilla.
    You might peek at Yahoo’s front page and watch how they create article titles to grab viewers to click.
    You might add a related video or a picture or two to grab readers interested about what you’ve got
    to say. In my opinion, it could bring your blog a little bit more interesting.

  24. Wonderful items from you, man. I have take note your
    stuff prior to and you’re simply extremely fantastic.

    I really like what you’ve acquired here, certainly like
    what you’re stating and the way in which during which you assert it.
    You make it enjoyable and you continue to take care of to
    keep it smart. I can’t wait to learn much more from
    you. This is actually a terrific website.

  25. Howdy would you mind sharing which blog platform you’re working with?

    I’m planning to start my own blog in the near future but I’m having a difficult time deciding between BlogEngine/Wordpress/B2evolution and Drupal.

    The reason I ask is because your layout seems different then most blogs and I’m looking for something unique.
    P.S My apologies for getting off-topic but I had to ask!

  26. What you published made a bunch of sense. However, think about this, suppose you added a little information? I
    ain’t saying your information isn’t good., however
    suppose you added a headline that grabbed folk’s attention? I mean 'আত্নজা ও
    একটি করবী গাছ' – আলোর দেশে is kinda
    plain. You ought to peek at Yahoo’s front page and see how they write post titles to get people interested.
    You might add a related video or a picture or two
    to grab people interested about everything’ve written. Just my opinion, it would bring your posts
    a little bit more interesting.

  27. Hello! I know this is kinda off topic but I’d figured I’d
    ask. Would you be interested in exchanging links or maybe
    guest authoring a blog article or vice-versa? My site covers a lot of the same topics as yours and I feel we could greatly
    benefit from each other. If you might be interested feel free to shoot me an email.

    I look forward to hearing from you! Fantastic blog by the way!

  28. Hi I am so grateful I found your site, I really found you
    by error, while I was searching on Google for something else,
    Nonetheless I am here now and would just like to say cheers for a tremendous
    post and a all round entertaining blog (I also love the theme/design), I don’t have time
    to go through it all at the minute but I have bookmarked it and also added in your RSS feeds, so when I have time I will
    be back to read a lot more, Please do keep up the awesome work.

  29. First of all I would like to say excellent blog!
    I had a quick question which I’d like to ask if you
    don’t mind. I was interested to know how you
    center yourself and clear your mind before writing.
    I have had trouble clearing my thoughts in getting my
    thoughts out. I do take pleasure in writing however it
    just seems like the first 10 to 15 minutes are lost simply just trying to figure out how
    to begin. Any ideas or tips? Thanks!

  30. Hey I know this is off topic but I was wondering if you knew of
    any widgets I could add to my blog that automatically tweet my
    newest twitter updates. I’ve been looking for a
    plug-in like this for quite some time and was hoping
    maybe you would have some experience with something like this.
    Please let me know if you run into anything. I truly enjoy reading your blog and I look forward to your new updates.

  31. My developer is trying to convince me to move to
    .net from PHP. I have always disliked the idea because
    of the expenses. But he’s tryiong none the less.
    I’ve been using WordPress on a variety of websites
    for about a year and am worried about switching to
    another platform. I have heard excellent things about blogengine.net.
    Is there a way I can transfer all my wordpress content into it?
    Any kind of help would be greatly appreciated!

  32. My programmer is trying to convince me to move to .net from PHP.
    I have always disliked the idea because of the costs. But he’s tryiong none the less.
    I’ve been using WordPress on a number of websites for about a year and am anxious about switching to another platform.
    I have heard very good things about blogengine.net.
    Is there a way I can transfer all my wordpress content into it?
    Any help would be greatly appreciated!

  33. Hi there, I discovered your site by means of Google at the same time as
    searching for a related matter, your website got
    here up, it looks great. I’ve bookmarked it in my google bookmarks.

    Hi there, simply changed into alert to your weblog thru Google, and located that it
    is truly informative. I’m gonna watch out for brussels.
    I’ll appreciate should you proceed this in future. Numerous folks might be benefited from your writing.
    Cheers!

  34. Howdy! I realize this is sort of off-topic but I needed to ask.

    Does managing a well-established blog like yours require a
    massive amount work? I’m completely new to writing a blog but I do write in my diary daily.
    I’d like to start a blog so I will be able to share my experience and views online.
    Please let me know if you have any kind of recommendations or tips for new aspiring blog owners.
    Thankyou!