বাইসাইকেল থিভস: সিনেমার শুরু যেখানে !

 


পারভেজ সেলিম  ।।


 

চ্যাপলিনকে যদি নি:শব্দ সিনেমার সম্রাট বলি তাহলে তার সাম্রাজের একটা সীমারেখা টানা যেতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত । সেই সাম্রাজের রেশ কিছুটা থাকলেও ইটালীর ‘নব্য বাস্তবতাবাদ’  নামের ‌ধারাটি যখন শুরু হয়, তখন সিনেমায় নতুন এবং বিশাল এক সূর্য উদিত হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। তাদের সাথে আমিও একমত। কিন্তু এটা কি শুধুই সিনেমার নতুন একটা ধারা। নাকি এটাই সিনেমা আসল রুপ ? আমি মনে করি এটাই সিনেমার সত্যিকারের চেহারা ।

সিনেমার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া সেইধারার প্রধানত চলচ্চিত্রটি হলো ‘বাইসাইকেল থিভস’। ১৯৪৮ সালে ভিত্তিরিও ডি-সিকা এই সিনেমাটি বানিয়ে পরবর্তী সিনেমার গড়নই বদলে দিয়েছেন। মানুষ পরিচিত হয়েছে মহৎ ও বিশুদ্ধ সিনেমার সাথে । কিন্তু কি আছে ‘বাইসাইকেল থিভস’ সিনেমায় ?

কি আছে বাইসাইকেল থিভসে :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর ইটালীর রোম শহর গল্পের পটভুমি । সেই শহরের একজন দরিদ্র মানুষ অ্যান্তোনিও রিচ্চি ও তার ছেলে ব্রুনো রিচ্চি । অ্যান্তোনিওর  চাকরি পাবার শর্ত হচ্ছে একটি  বাইসাকেল থাকতে হবে। কিন্তু অভাবের কারনে তার সাইকেল আগেই বন্দক রেখেছে সে । এবার উপায় না পেয়ে বিয়েতে পাওয়া বিছানার চাদর বন্দক রেখে, বন্দকি সাইকেল ফেরত আনেন অ্যান্তোনিও ও তার  বউ । কিন্তু চাকরিতে গিয়ে প্রথম দিনেই সাইকেলটা চুরি হয়ে যায় এই হতদরিদ্র অসহায় মানুষটির । এরপর বাবা অ্যান্তোনি ও ছেলে ব্রুনো মিলে চুরি যাওয়া সাইকেলে সন্ধান করতে থাকেন পুরো সিনেমা জুড়ে।

সিনেমার শেষে যখন কোনভাবেই  হারিয়ে যাওয়া সাইকেলে হদিস পায়না তখন ছেলেকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে অসহায় পিতা চুরি করে বসেন আরেকটা সাইকেল । হাত পাকা নয় তাই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে জনতার হাতে । সন্তানের সমানে চড় থাপ্পড় খেয়ে অপমানিত হয়ে অ্যান্তোনিও ফিরতে থাকে বাড়ির দিকে। ছেলে কাঁদতে কাঁদতে  বাপের হাত শক্ত করে চেপে ধরে আর বাবা অসহায় চাহনীতে নিজেকে সংযত রাখতে চায়। ভীড়ের মধ্য দিয়ে ব্যর্থ এক পিতা আর সন্তানের ফিরে যাবার মধ্যে দিয়েই শেষ হয় সিনেমা। এতটুকুই গল্প।

 
 

 সিনেমার ব্যবচ্ছেদ ও কয়েকটি অকৃত্রিম দৃশ্য :

এত সহজ একটা গল্প কি করে যুদ্ধ পরবতী সমাজের এত মানবিক দলিল হয়ে উঠল ? এখানেই সিনেমার মুন্সিয়ানা। এখানেই সিনেমা আর ‌উপন্যাসের পার্থক্য । ভিত্তোরিও ডি সিকা এই গল্প নিয়েছিলেন লুইজি বার্তোলনির একই নামের উপন্যাস থেকে। বন্ধু সিসারে জাভাত্তানি মিলে চিত্রনাট্য লিখে বানিয়েছেন ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ বাংলায় যার অর্থ ‘ সাইকেল চোর’ । আর  ইংরজি নামটিই তো বিশ্বব্যাপি পরিচিত হয়েছে বেশি ।

শুধু কয়েকটা দৃশ্য দিয়ে যদিও সিনেমা বিচার করা যায় না। পুরোটা মিলে একটা সিনেমা সিনেমা হয়ে ওঠে, তবু আমাদের মনে এমন কিছু দৃশ্য আটকে  থাকে যা সিনেমাটিকে এতটা প্রিয় করে তোলে।

এই সিনেমাও এমন দুর্লভ কিছু দৃশ্য আছে ।  বৃষ্টির দৃশ্য, ছেলে নদীতে পড়ে যাবার পরে বাবার আকুতি, অভিমানী ছেলের সাথে বাবার দুরে দুরে হাটা, রাস্তায় অসহায় বাবা ছে্লের বসে থাকা । সাইকেল চুরির আগের সীদ্ধান্তহীনতার দৃশ্যায়ন, চার্চের ভিতর চোরকে ধরতে চাওয়ার অস্থিরতা , শেষে বাবার সাইকেল চুরির দৃশ্য এবং সর্বশেষ ব্যর্থ বাবার ছেলের সাথে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফেরা । এককটি দৃশ্য যেন একেকটি সিনেমা !!

পরিচালকের আন্তরিকতা আর মুন্সিয়ানা মিলেমিশে একাকার হয়েছে এই সিনেমায় । ডি সিকার মাস্টারির এক নমুনা দেখি  বিছানার চাদর  বন্দক রাখার সময় একটা বিশাল শটে ।দৃশ্যে আমরা দেখি দোকানদার বন্দক রাখা চাদরটা  সিলিং এর কাছে শত শত চাদরের উপর রাখেন। একশটে বন্দক রাখা এতএত সাদা চাদর দেখে বুকটা হুহু করে ওঠে । ছবি কথা বলে ওঠে, শুধু এই দরিদ্র পরিবারটি একা নয় হাজার হাজার মানুষ তাদের বিছানার চাদর বন্দক রেখেছে।এই এক শটে যুদ্ধ পরবর্তী ইটালীর  অর্থনৈতিক অবস্থাটা পরিস্কার করে দেন পরিচালক । সিনেমায়  যা প্রকাশ করা গেল এক দৃশ্যে, শিল্পের অন্য কোন মাধ্যমে কি এভাবে, এত সহজে তা প্রকাশ করা যেত ?

আন্তনিওর  হারানো সাইকেল খোঁজার সময়  রাস্তায় হাজারো মানুষের সারিবদ্ধভাবে হন্যে হয়ে  ঘুরেফেরা, সাজানো সাইকেল ও সাইকেলের বিভিন্ন অংশ।

চলচ্চিত্রটির  এই মুহূর্তের দৃশ্যায়নে ডি সিকা যেভাবে একের পর এক প্যানিং ও ট্র্যাকিং শটের  ব্যবহার করেছেন তা সত্যিই অসাধারণ ও লক্ষণীয়। আসলে চলচ্চিত্রটির নির্যাস  বলতে আন্তনিওর মরিয়া হয়ে হারানো সাইকেলটি খোঁজে পাবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাটুকুকেই আমার মনে হয়।

বাবা তখন ছেলের সামনে অপমানে বাকরুদ্ধ হয়ে চুপচাপ পাশাপাশি দুজন হাঁটে , তখন এক বিশেষ মিথস্ক্রিয়ার জন্ম হয় দর্শকের মনে।  একজন বাবার কাছে ছেলের সামনে অপমানিত হওয়ার চেয়ে বেশি লজ্জার বোধহয় কিছু  নেই। মহৎ সিনেমা  আপনাকে যতটা না আনন্দ দেয়, তার চেয়ে বেশি দেয় দ্বীর্ঘশ্বাস !!

 
বাবা ও ছেলের চরিত্রে লামবের্তোর মাজ্জোরানি ও এনজো স্তায়োলা
 
 

পুরো সিনেমায় ছেলের সঙ্গে বাবার একটি নৈতিক সম্পর্ক উপস্থাপন করেছে ডি সিকা । রাষ্ট্রকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন একটি রাস্ট্রের ব্যর্থতা বলতে কি বোঝায়!  অসহায় বাবার পাশে অবুঝ ছেলে রাগ অভিমান নিয়েও হাসিমুখে যদি থাকতে পারে, লাঞ্চিত পিতাকে রক্ষা করতে আপ্রাণ সাহস নিয়ে যদি একটি শিশু  আগিয়ে আসতে পারে , তাহলে রাস্ট্র কেন পারেনা এমন দরদী মন নিয়ে এগিয়ে আসতে ? এমন একটি কঠিন রুঢ় বাস্তব প্রশ্নের সামনে দাড় করিয়ে দিয়েছে মুখোশধারী রাস্ট্র ব্যবস্থাকে। এই সিনেমায় ছোট্ট  ব্রুনোকে  শুভ রাস্ট্রের প্রতীক হিসেবে  দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মানবতাবাদি ডি সিকা ।

 

কে এই ডি সিকা ?

 

এই ভিত্তিরিও ডিসিকা লোকটা কে? ক্যামনে এমন একটা কাজ করলো ? জানা যায় বাম ঘরানার এই নাটক পাগল লোকটি  মঞ্চ নাটক করেছে ৪০ টির উপরে ।  নিজেও অভিনেতা, আগেও অনেক সিনেমা করছেন তিনি । বন্ধু জাভাত্তানি তার চিন্তা চেতনায় এত প্রভাব ফেলল যে আগের কাজ সব ভুলে গিয়ে নতুন ধারার প্রচলন শুরু করলেন । সিনেমা বানানো শুরু করলেন । একের পরর এক অসাধারণ সিনেমা বানিয়ে পুরো সিনেমার চেহার পাল্টে দিলেন ।

তখন সিনেমা বলতে বানানো সেটে, ফ্যান্টাসীতে ভরপুর আবেগী সিনেমা বাজার কাঁপাচ্ছে । তখনও মানুষ সিনেমায় যা কিছু বাস্তব তা দেখতে অভ্যস্থ হয়নি । ঠিক এই সময় ‘বাইসাইকেল থিবস’ নিয়ে হাজির হলেন ডি সিকা । পুরো সিনেমায় বানানো সেটের কোন বালাই নাই । বাবার চরিত্রে অভিনয় করা  অ্যাস্তোনিওর কোন প্রশিক্ষন ছিল না অভিনয়ের, তিনি ছিলেন একজন কারখানার শ্রমিক । আর বাচ্চা ব্রুনো যেন অভিনয় নয় বাস্তব একটি চরিত্র ,যার ছবি ধারন করা হয়েছে ।কি সাবলিল অভিনয়  ।

স্টুডিওনির্ভর চলচ্চিত্র যখন রমরমা ব্যবসা করছিল দুনিয়াজুড়ে, আবেগপ্রবণ আর  ফ্যান্টাসিনির্ভর চলচ্চিত্র যখন দর্শক পেট ভরে খাচ্ছিল, তখনো কিন্তু মানুষ চলচ্চিত্রকে সমাজের দর্পণ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। ‘বাইসাইকেল থিভস ‘ এসে আগের সেই ধারনাকে ভেঙ্গে দিলো । কল্পনাকে নামিয়ে আনলো বাস্তবতার স্বর্ন মন্দির মাটিতে । সিনেমা হয়ে উঠল নবীনতম শিল্প মাধ্যমের জোরালো প্রতিনিধি। ‘বাইসাইকেল থিভস ‘(১৯৪৮) ছাড়াও  ডি -সিকা আরো অনেক কয়েকটি  অসাধারণ সিনেমা বানান। ‘সুসাইন(১৯৪৬), টু ওমেন (১৯৬১), সানফ্লাওয়ার (১৯৭০) তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয়েছে ।

 

 শেষ যেখানে শুরু :

বিখ্যাত ফরাসি নন্দনতাত্ত্বিক অঁদ্রে বাজাঁর মুল্যায়ন যর্থাথ মনে হয়, ‘বাইসাইকেল থিভস’ হলো  বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান নিদর্শণ। এতে না আছে কোনো অভিনেতা,  না কোনো কাহিনি, না কোনো সেট; অর্থাৎ বাস্তবের নিখুঁত নান্দনিক ভ্রম  সৃষ্টিতে (তথাকথিত) এমন সিনেমা আর নেই।’ তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেন ‘It is the most  successful communist film in the world।’

আর রেঁনে ক্লেয়ার মনে করেন, ‘বিগত ত্রিশ বছরের শ্রেষ্ঠ ছবি।’ কিন্তু আমার মনে হয় এটি শুধু বিগত ত্রিশ বছরেরই নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের  ইতিহাসের প্রথম কয়েকটি চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র। আর ডি সিকা নিজে মনে করেন, ‘Bicycle Thieves is a good picture. I like very  much.’ আমিও মনে করি ‘বাইসাইকেল থিবস’ শুধু একটি মহৎ সিনেমাই নয় একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা এবং I Like it very Much।

 


পারভেজ সেলিম 
চলচ্চিত্রকর্মী ও সাংবাদিক

৭৯ thoughts on “বাইসাইকেল থিভস: সিনেমার শুরু যেখানে !

  1. Pingback: bonanza178
  2. Hello there! I know this is kinda off topic however I’d figured I’d ask.
    Would you be interested in trading links or maybe guest authoring
    a blog article or vice-versa? My website discusses a lot of the same subjects as yours and I think we could greatly benefit from
    each other. If you might be interested feel free to send
    me an e-mail. I look forward to hearing from you!

    Excellent blog by the way!

  3. Pingback: nagaqq alternatif
  4. Pingback: Vape carts USA
  5. Pingback: สล็อต
  6. Pingback: superkaya88
  7. What i don’t realize is in truth how you’re now not actually a lot more smartly-appreciated
    than you may be right now. You are very intelligent.

    You realize therefore significantly in relation to this subject, made me
    personally believe it from numerous numerous
    angles. Its like women and men are not involved until it is something to do with Lady gaga!

    Your own stuffs outstanding. Always handle it up!

  8. Today, I went to the beach with my children. I found a sea shell and
    gave it to my 4 year old daughter and said “You can hear the ocean if you put this to your ear.” She placed the shell
    to her ear and screamed. There was a hermit crab inside
    and it pinched her ear. She never wants to go back!
    LoL I know this is totally off topic but I had to tell someone!

  9. Hello there, I found your site by means of
    Google while looking for a similar subject, your website got here up, it appears to be like great.

    I’ve bookmarked it in my google bookmarks.
    Hi there, simply become alert to your weblog thru Google, and located that it’s really informative.
    I’m going to watch out for brussels. I will appreciate should you continue this in future.
    Lots of folks will probably be benefited out of your writing.

    Cheers!

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x