ঋত্বিক কুমার ঘটক: বাংলা সিনেমার এক দিকপাল


পারভেজ সেলিম

পারভেজ সেলিম ।।


যে কয়েকজন চলচ্চিত্রকার বাংলা চলচ্চিত্রকে ক্যামেরা থিয়েটার থেকে মুক্ত করে শিল্পের আসনে বসিয়েছেন, বাংলার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে রসদ সংগ্রহ করে যারা সৃষ্টি করেছেন চলচ্চিত্রের নিজস্ব এক ভাষা, আপন প্রতিভাবলে চলচ্চিত্রকে যারা সাহিত্যের চাটুবৃত্তি থেকে উদ্ধার করে নতুন এক শিল্পের মর্যাদা দিয়েছেন ঋত্বিক কুমার ঘটক তাদের প্রথম সারিতে।

জন্ম :

 
১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার জিন্দাবাজারে জন্ম নেয়া মানুষটি শিল্পের আরো অনেক মাধ্যমে কাজ করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের মত ব্যয়বহুল, শ্রমসাধ্য ও নবীনতম শিল্প মাধ্যমটিকে। যদিও তার কাজ শুরু করার আগে বাংলা চলচ্চিত্র কতটা শিল্প তা নিয়ে বির্তক থাকলেও পরবর্তীতে সেই বিতর্ক প্যাকেট বন্দী করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন নিন্দুকেরাও।
 
একসঙ্গে হাজার মানুষের কা্ছে পৌঁছাতে না পারার অক্ষমতাই মুলত ঋত্বিক কুমার ঘটককে অন্য শিল্প মাধ্যমগুলো থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। একমাত্র চলচ্চিত্রেরই একসঙ্গে এত বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর সেই সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল এবং উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্পতো নিজেকে প্রকাশ করার জন্য, চলচ্চিত্রকে সামষ্টিক শিল্প ভাবতেন বলে ঋত্বিক কুমার ঘটক সিনেমাকে বেছে নিয়েছিলেন নিজেকে প্রকাশ করার উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে।
 

কর্মময় জীবন :

 
২৫ বছরের কর্মময় জীবনে তিনি ৮ টি পূর্ণ্যদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছেন আর তার ৪ টি অসমাপ্ত কাজ রয়েছে। এটা খুব বেশী কাজ নয় যদি তাকে শুধু একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে দেখি । তাই সত্যজিৎ রায় তাকে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার চাইতেও বড় এবং মহৎ কিছু ভাবতেন ।
 
গল্প, নাটক,অভিনয়, থিয়েটার আন্দোলনসহ বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকলেও তিনি নিজে নির্মাণ শুরু করেন ‘‘নাগরিক’’ দিয়ে ১৯৫২ সালে । তার নির্মিত ৮ টি চলচ্চিত্রের মধ্যে তিনটির গল্প তার নিজের লেখা নাগরিক, কোমল গান্ধার যুক্তি তক্কো আর গপ্পো। বাকি পাঁচটির গল্প ধার করা হলেও প্রায় প্রত্যেকটিতে কিছু পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছেন। কাহিনীচিত্রের মত ৮টি প্রামাণ্যচিত্র এবং ৮ টি অন্য চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনি। তার ইনস্টিটিউটের ছাত্রের নির্মিত কিছু স্বল্প দৈর্ঘ্যে চলচ্চিত্রের তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্বেও তিনি ছিলেন।
 
সুবর্নরেখা সিনেমার নির্মাণের আর্থিক সংকট কাটানোর জন্য scissor নামের একটি ad film ও তিনি বানিয়েছিলেন। নাগরিক’’ তার নির্মিত প্রথম সিনেমা হলেও মুক্তি পায় তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র যুক্তি তক্কো আর গপ্পোর সাথে ১৯৭৭ সালে। ১৯৫৮-৬২ এই পাঁচ বছরে তিনি পাঁচটি সিনেমা বানালেন যার একটি দৈর্ঘ্য আরেকটির চাইতে বড়। এর এগার বছর পর ঋত্বিক ঘটক বানালেন তিতাস একটি নদীর নাম যার দৈর্ঘ্য প্রায় পৌনে তিন ঘন্টা।
 

আরো পড়ুন :


সিনেমার বিষয় বৈচিত্রতা :

 
ঋত্বিক ঘটকের আটটি চলচ্চিত্রে বিষয় বৈচিত্রতা তেমন একটা দেখা যায়না। একটি বিষয় তাকে এত বেশী আবিষ্ট, আচ্ছন্ন এবং যন্ত্রণাকাতর করে তুলেছিল যে তার বেশীর ভাগ সিনেমায় প্রত্যক্ষও পরোক্ষভাবে সেই যন্ত্রণারই কথা তিনি বলতে চেয়েছেন। সাতচল্লিশ এর দেশভাগ তাকে আমৃত্যু আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
 
 নাগরিকে আমরা দেখি এক মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযন্ত্রণার ছবিএই সিরিয়াস সিনেমাটি তার নির্মিত প্রথম সিনেমা হলেও তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা অযান্ত্রিক। যন্ত্রের প্রতি মানুষের অকারণ ভালবাসার এক বিশ্বাসযোগ্য চিত্রায়ন আর আদিবাসীদের জীবন সংস্কৃতির এক বিশেষরুপ এই সিনেমাতে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। বাড়ি থেকে পালিয়ে একটি দুরন্ত ছেলের বাড়ী থেকে পালিয়ে বিশ্বদেখার গল্প। এরপর আমরা দেখব ঋত্বিক কুমার ঘটক আর এধরনের বিষয় নিয়ে সিনেমা করবেন না। নাগরিকের মত সিরিয়াস কিন্তু আরো গভীর এবং ব্যাপক মাত্রা পাবে তার পরবর্তী সিনেমাগুলো !!
 
 
 

দেশভাগের যন্ত্রনা :

 
চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরুর দশ বছর পর তিনি নির্মাণ করবেন তার প্রথম আলোচিত সিনেমা মেঘে ঢাকা তারা। তার পরের দুইবছরেই পরপর বানাবেন কোমল গান্ধার সুবর্নরেখা
 
এই তিনটি সিনেমাই তিনি তার শিল্পী জীবনের নির্যাসটুকু বলে ফেলবেন। জনগনের দু:খ যন্ত্রণার কথা বলার জন্যসিনেমাকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। যেন এক নি:শ্বাসে তিন বছরের মধ্যে সেই সমস্ত কিছু বলে ফেললেন। বললেন সাতচল্লিশে দেশভাগের বেদনা, যন্ত্রণা আর মিলনের আকাঙ্খার কথা। মনে হয় তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন । যে কথাগুলো তিনি বলতে চেয়েছেন সিনেমায় তা যেন তার বলা হয়ে গেল !! তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে এরপর টানা প্রায় দশ বছর সিনেমা করলেন না অর্থাৎ তার নির্মিত সিনেমার কাজ সমাপ্ত হল না।

 

তিতাস একটি নদীর নাম :

 
দশ বছর পর তিনি যে সিনেমাটির নির্মাণ কাজ শুরু করলেন সেটা প্রত্যক্ষভাবে সাতচল্লিশ থেকে আলাদা হলেও পরোক্ষভাবে সাতচল্লিশকে জড়িয়েই। দুই বাংলার মিলনের যে কথাগুলো তিনি আগে বলেছেন, নিজের সিনেমা নির্মানের ক্ষেত্রে তা ঘটানোর চেষ্টা করলেন ।
 
 
এগারো বছরের নিস্ক্রিয়তার স্বেচ্ছানির্বাসনের পর ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক নির্মাণ করলেন অদ্বৈত মল্লবর্মনের উপন্যাস অবলম্বনে তিতাস একটি নদীর নাম
 
সিনেমার শুরুতেই টাইটেলে তিতাসের উপস্থিতিতে লালনের গান তোমার আজব লীলা সিনেমায় আবহ সঙ্গীতের ব্যবহারকে এক বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে দেয় । কাহিনী বিস্তারের প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশের যথাপ্রচলিত সুসজ্জিত সেটের বিরুদ্ধে এ যেন এক স্বধর্মী প্রতিবাদ হচ্ছে এই সিনেমা ।
 
প্রকৃতিকেও যেখানে অভিনেতা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। মাগন সর্দারের চরিত্রটি বোঝানোর জন্য নদীর পাড়ে শিকড় প্রায় উপড়ানো একটা উঁচু নারকেল গাছের তলায় তাকে দাঁড় করানো, শ্রাদ্ধের দিন অনন্তর ভগবতী রুপ কল্পনার পর বৃষ্টির জলে দুটো হাসের নি:শব্দে ভেসে যাওয়া কিংবা বৃষ্টি ভেজা আম গাছের নিচে জমা জলে পাতায় ধরে থাকা ফোঁটা ফোঁটা জল পড়া, এরকম আরো অসংখ্য !!
 
শেষ দৃশ্যে বাসন্তী যেন তিতাসের পাড়ের লাঞ্চিত, বঞ্চিত মানবগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে ওঠে কিংবা হয়ে ওঠে শোষিত সমাজে দ্বিগুন শোষিত নারীর মূর্ত রুপ ! বাসন্তির মৃত্যুর মুহূর্তে ফসলের ক্ষেতে ভেঁপু বাজিয়ে দুরুন্ত শিশুর পদচারনার দৃশ্যটিকে কেউ কেউ ঋত্বিক ঘটকের শৈল্পিক ধারণার পরিনততম রুপ বলে মনে করেন!! বাংলার প্রকৃতি জলের জীবন সমাজ এর আগে এতো আন্তরিকভাবে আর কোন চলচ্চিত্রে উঠে আসেনি ।
 
তিতাস নদীর পাড়ের জেলে গ্রামের কয়েকঘর মানুষের জীবন-সংগ্রাম, আশা-আকাঙ্খা, ব্যথা-ব্যর্থতা যেন সমগ্র মানব সত্তার এক অনিবার্য জীবন সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছে ! তিতাস একটি নদীর নাম বাংলা চলচ্চিত্রের এক মহান সামাজিক মানব দলিলচিত্র হয়ে থাকবে বহুকাল।
 

আরো পড়ুন :


শেষের সিনেমা :

 
সাতচল্লিশ ছিল পুরোপুরি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ঋত্বিক ঘটক এরপর নির্মাণ করলেন পুরোপুরি একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র যুক্তি তক্কো আর গপ্পো। যেহেতু সিনেমার বিষয়বস্তু তুলনামুলকভাবে ভিন্ন তাই এর আঙ্গিকটাও হয়ে গেল ভিন্ন। সাধারন দর্শকদের এই সিনেমা দেখতে বসে হোঁচট খেতে হল।
 
 সিনেমায় নীলকন্ঠরুপী ঋত্বিক কুমার ঘটকে আমরা মৃত্যুবরণ করতে দেখি, সঙ্গে দেখি প্রতিবাদের বিচিত্র এবং জোরালো এক চলচ্চিত্রিক ভাষা। সুবর্নরেখায় অভিরামকে যেমনটি বলেছিল বন্ধু হর প্রসাদ আসল কথা কি মনে হয় জানো ভাইটি ও তুমি প্রতিবাদই কর, আর লেজ গুটাইয়া পলাইয়াই যাও কিছুতেই কিছু হয়না, সব লোপাট আমরা সবনিরালম্ব-বায়ুভুত আমরা মিটে গেচি !!’ । যুক্তি তক্কো আর গপ্পোএ তার এত দিনের যন্ত্রণার মুখপাত্রের (ক্যামেরার) লেন্সে তিনি ঢেলে দিলেন মদ, যেন এসব বলে কিছু হয়না কিছুতেই কারো কিছু এসে যায় না!!
 
 

শ্রদ্ধা :

বিষয় বৈচিত্রতা, না থাকলেও নির্মাণে তিনি মৌলিক এবং স্বকীয় হয়ে উঠেছিলেন। আঙ্গিকে মহাকাব্যিকতা, আর্কিটাইপ মাদার ইমেজ কিংবা অড অ্যাঙ্গেল চলচ্চিত্রে এরকম অসংখ্য শব্দের আরেক নাম হয়ে উঠেছিলেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। বাংলা চলচ্চিত্রের এই দিকপাল ১৯৭৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। আর ৪ নভেম্বর এই মহান শিল্পীর জন্মদিন। জন্মদিনে আমাদের প্রাণের শ্রদ্ধাঞ্জলী।

 

 

পারভেজ সেলিম

লেখক ও চলচ্চিত্রকর্মী

আরো পড়ুন : চিলড্রেন অফ হ্যাভেন : একটি বিশুদ্ধ সিনেমা

ভিডিও সহযোগী : Paru’s Cinema

৬৪ thoughts on “ঋত্বিক কুমার ঘটক: বাংলা সিনেমার এক দিকপাল

  1. Hello! I understand this is kind of off-topic but I had
    to ask. Does running a well-established website like yours require a massive amount work?
    I am brand new to blogging but I do write in my diary every day.
    I’d like to start a blog so I will be able to share my experience
    and views online. Please let me know if you have any kind of recommendations or tips for brand new aspiring bloggers.
    Thankyou!

  2. I have been exploring for a little bit for any
    high quality articles or blog posts in this kind of space
    . Exploring in Yahoo I finally stumbled upon this website.

    Studying this info So i’m satisfied to show that I’ve an incredibly good uncanny feeling I
    came upon just what I needed. I most for sure
    will make certain to don?t forget this site and provides it
    a glance regularly. cheap flights http://1704milesapart.tumblr.com/ cheap flights

  3. Hello there I am so delighted I found your weblog, I really found you by error, while I was researching on Yahoo for something else,
    Nonetheless I am here now and would just like to say kudos for a tremendous post and a all round thrilling blog (I also love the theme/design),
    I don’t have time to go through it all at the
    moment but I have saved it and also added your RSS feeds,
    so when I have time I will be back to read much more,
    Please do keep up the fantastic jo. quest bars https://www.iherb.com/search?kw=quest%20bars quest bars

  4. Woah! I’m really digging the template/theme of
    this site. It’s simple, yet effective. A lot of times it’s
    tough to get that “perfect balance” between usability
    and appearance. I must say you have done a excellent job with this.
    Also, the blog loads extremely quick for me on Firefox.
    Superb Blog!

  5. What i do not realize is if truth be told how you are
    now not actually much more smartly-preferred than you might be
    right now. You’re so intelligent. You know thus significantly when it comes to this matter, made me personally imagine it
    from so many varied angles. Its like women and men don’t seem to be interested unless it’s one thing to do with Girl gaga!
    Your individual stuffs outstanding. Always handle it up!

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x