যীশু থেকে হলোকাস্ট: ইহুদীদের বিষ্ময়কর লড়াই!!


 পারভেজ সেলিম


(পর্ব ০৬)

যীশু খ্রিষ্ট খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হলেও জন্মসূত্রে ছিলেন একজন ইহুদি। তিনি ইহুদি ধর্মের ভিতর থেকেই নব-সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তবে তাঁর শিক্ষা ও দাবি বিশেষ করে নিজেকে “ঈশ্বরের পুত্র” বলা, এছাড়া মন্দির ও ইহুদীদের প্রভাবশালী ধর্মীয় দল বা সম্প্রদায় ফারিসিদের (Pharisees) সমালোচনা করায় ইহুদি ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়।

ইহুদি সিনহেড্রিন ( ধর্মীয় আদালত) যীশুর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তোলে এবং তাঁকে রোমান গভর্নর পন্তিয়াস পিলাতের কাছে মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে তুলে দেয়। মহামতি যীশু ক্রশবিদ্ধ হন ৩৩ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র ৩০/৩৩ বছর বয়সে।

যদিও যীশুকে রোমান সৈন্যরাই ক্রুশবিদ্ধ করে, তবে ইহুদি জনতা ও ধর্মগুরুদের সক্রিয় ভূমিকার কারণে খ্রিস্টান সমাজ বহু শতাব্দী ধরে ইহুদিদের “খ্রিষ্ট-ঘাতক” বলে দাবি করে এসেছে।

এই মনোভাব থেকে জন্ম নেয় ধর্মীয় ঘৃণা, বিতাড়ন, এমনকি গণহত্যা যার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় নাৎসি জার্মানিতে।

তবে আধুনিক যুগে, বিশেষ করে দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিলের পর, ক্যাথলিক চার্চ ঘোষণা দেয় যে ‘সমগ্র ইহুদি জাতি নয়, বরং কিছু নেতা ও রাজনৈতিক চাপই যীশুর মৃত্যুর জন্য দায়ী’।

খ্রিস্টানদের সাথে ইহুদীর ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় বিরোধ তাই দীর্ঘদিনের। যদিও বর্তমানে এই সংকট তারা কাটিয়ে উঠেছে বলেই মনে হয়। ইউরোপ আমেরিকান খ্রিষ্টানরা এখন তাদের বন্ধুই মনে করে।

তবে সংকট এখনো গভীরে আছে মুসলমানদের সাথে। মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদী- মুসলমানদের দ্বন্দ কতটা ভয়াবহ সেটা ফিলিস্তিন-ইসরাইল কিংবা ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে তার টের পাওয়া যায়।

মহানবী সময়কাল থেকেই এই সংকট প্রতীয়মান হয়েছিল।মদিনায় সেসময় তিন বড় গোত্র ছিল ইহুদীদের। বনু নাদির, বনু কাইনুকা ও বনু কুরাইজা। একে একে তিনটি ইহুদী গোত্রকে মদীনা থেকে বিতাড়িত করেছিল মহানবী।

তারপর থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত ইহুদীদের চলে টিকে থাকার সংগ্রাম। সে আরেকটি হাজার বছরের সংগ্রামী ইতিহাস।

মদিনা থেকে বিতাড়িত হবার পর আরবে বিশেষ করে হিজাজ অঞ্চলে ইহুদি উপস্থিতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়।

৭-১১ শতক পর্যন্ত মুসলিমদের স্বর্নযুগের সময় ইহুদীরা মুলত বাস করতো ইরাক (বাগদাদ) পারস্য, মিশর, আন্দালুস (স্পেন), লেভান্ট (লেবানন, সিরিয়া) এইসব অঞ্চলে।মুসলিম শাসনের অধীনে (৮ম-১২শ শতক) ইহুদিরা ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ব্যবসা ও চিকিৎসায় অগ্রগামী হয়। বিখ্যাত ইহুদি দার্শনিক মাইমোনিডিস (Maimonides) এ সময়েই কায়রোতে ছিলেন।

১২-১৫ শতকে ক্রুসেড, নির্যাতন ও ইউরোপে দূর্দশায় কাটে ইহুদীদের জীবন। খ্রিষ্টান ইউরোপে ইহুদিরা ‘ঈসা হত্যাকারী’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। ক্রুসেডাররা (১১–১৩ শতক) ইহুদি বসতিতে গণহত্যা চালায়।

বহু দেশ থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়। ইংল্যান্ড (১২৯০), ফ্রান্স (১৩০৬), স্পেন ১৪৯২ (স্প্যানিশ ইনকুইজিশন) ইহুদীদের বিতাড়ন করেছিল।যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি বা খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়নি, তারা অধিকাংশই মুসলিম অটোমান সাম্রাজ্যে বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে আসে।

১৬-১৮ শতকে অটোমান, ইরান ও পূর্ব ইউরোপে ইহুদিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যে (তুরস্ক, বালকান, লেবানন, প্যালেস্টাইন) ইহুদিরা তুলনামূলক শান্তিতে ছিল।

ইরান (সাফাভি ও পরে আফশারী সাম্রাজ্য) কিছু জায়গায় সহনশীলতা, কিছু জায়গায় নিপীড়নের শিকার হন তারা। পরবর্তীতে পোল্যান্ড ও রাশিয়া আশ্রয় নেয়, কিন্তু সামাজিকভাবে ছিল প্রান্তিকগোষ্ঠির মানুষ। এমন বৈরি পরিবেশে হাজার বছর টিকে থাকার পিছনে বিশেষ কিছু কারন লক্ষ্য করা যায়।

ইহুদীরা বিভিন্ন দেশে ছোট ছোট সম্প্রদায় গড়ে তুলেছিল। ধর্মীয় গ্রন্থ তোরাহ ও তালমুদের প্রতি দৃঢ় আনুগত্য প্রদর্শন করেছিল। শিক্ষা ও পেশায় বিশেষ করে চিকিৎসা, ব্যাংকিং, ব্যবসা ইত্যাদিতে অনেক দক্ষতা অর্জন করেছিল।

অটোম্যান শাসনামলে মুসলিম শাসনের নিচে অধিকতর নিরাপত্তা পেয়েছিল। কয়েক হাজার বছরের এত নির্যাতনের পরও ইহুদীদের টিকে থাকা এক বিষ্ময়কর ব্যাপার।

আঠারো শতকের শেষের দিকে ‘জায়ানবাদিরা’ নিজেদের জন্য একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। জার্মানীতে হিটলার ক্ষমতায় আসে ১৯৩৩ সালে। আধুনিক যুগে ইহুদীদের জীবনে নেমে চরম পরনতি।

শুরু হয় ইহুদী নিশ্চিন্ন করন প্রকল্প। ইতিহাসে পরিচিত ‘হলোকাষ্ট’ নামে।

(চলবে…)


পারভেজ সেলিম

লেখক,সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী


ইহুদী নিয়ে পুরো পর্ব পড়ুন :

পর্ব: ০১ ইহুদী: প্রতিশ্রুত ভুখন্ড ও রক্তাক্ত বর্তমান

পর্ব: ০২ : ইহুদী: ইউসুফ থেকে মুসা, মাঝে অন্ধকার

পর্ব: ০৩ : মুসা: ইহুদীদের ‘মুক্তিদাতা’

পর্ব: ০৪ : ডেভিড ও সুলোমন: ইহুদীদের স্বর্ণযুগ

পর্ব: ০৫ যীশু থেকে হলোকাস্ট: ইহুদীদের বিষ্ময়কর লড়াই !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x