পারভেজ সেলিম
(পর্ব : ০১ )
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন। প্রাচীনকালে এ অঞ্চলের নাম ছিল কেনান। এই কেনান থেকে বেশ দূরের একটি জনপদের নাম উর। মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার প্রথম দিককার শহর।
উর শহরেই জন্ম নিল এক মহান মানুষ। যিনি পরবর্তীতে পুরো মানবজাতির ইতিহাসের চিন্তা, দর্শণ আর ধর্মের আদি পিতা হয়ে উঠবেন। তার নাম ইব্রাহিম। ইহুদী ও খ্রিস্টানেরা যাকে আব্রাহাম নামে ডাকে। কুরআনে তার পিতার নাম বলা হয়েছে আজর।
সময়কাল নিয়ে মতভেদ আছে, তবে ধারণা করা হয় ১৯৯৬ খ্রি.পূর্বের আশেপাশে হবে। মানে আজ থেকে চার হাজার বছর আগে। ইব্রাহিমের পূর্বপুরুষেরা মূর্তি পূজা করতো।
কিন্তু ইব্রাহিমের ধর্মীয় বিশ্বাস ভিন্ন। তিনি একেশ্বরবাদি ধর্মে শুধু বিশ্বাসই করতেন না, তা প্রচারও করতেন। সেসময় উর শহরটি ছিল অত্যাচারি রাজা নমরুদের বিশাল সম্রাজ্যের অংশ। নমরুদ নিজেকে খোদা দাবি করেছিলেন বলে গল্প প্রচলিত আছে।
গল্পে আরো জানা যায় মূর্তি পূজারীদের সাথে ইব্রাহিমের দ্বন্দ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সেসময়ের রাজা নমরুদ তাকে আগুনের কুন্ডলিতে ফেলে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। স্রষ্টার অলৌকিকতায় তিনি বেঁচে যান বলে ধর্মীয় বিশ্বাস আছে।
সূরা আম্বিয়ায় আল্লাহ বলছেন ‘হে আগুন! তুমি ইব্রাহিমের জন্য শীতল ও শান্তিময় হয়ে যাও।’ আগুন সেইদিন ইব্রাহিমের কোন ক্ষতি করতে পারেনি।
পরে আল্লাহর নির্দেশে তিনি পূর্বপুরুষদের ধর্ম ও জাতি দুটোকেই ত্যাগ করেন। হিজরত করেন নতুন এক বাসভূমির আশায়।
বিশ্বাসীদের মতে স্রষ্টার নির্দেশে উর থেকে প্রথমে হারান (উত্তর ইরাক-সিরিয়া সীমানা) ও পরে কেনানে (বর্তমান ফিলিস্তিন ও ইসরাইল অঞ্চল) গিয়ে বসতি গড়েন ইব্রাহিম ও তার পরিবার।
এসময় স্রষ্টা ইব্রাহিমকে তার জন্য নতুন এক জাতি ও বাসভূমির আশ্বাস দিয়েছিলেন। স্রষ্টার সেই ‘প্রমিজড ল্যান্ড’ বা ‘পবিত্র ভূমি’ পরবর্তীতে কয়েক হাজার বছর ধরে ইহুদীদের ইতিহাস, রাজনীতি ও ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে।
ইব্রাহিম (আ.) এর ছিল দুই স্ত্রী। হাজেরা ও সারাহ। বড় জনের ঘরে জন্ম নেয় ঈসমাইল। আর ছোট স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেয় ইসহাক।
সময়ের পরিক্রমায় স্ত্রী হাজেরা ও পুত্র ঈসমাইল জন্মভুমি কেনান ছেড়ে চলে যান মক্কায়। সেই ঈসমাইলের বংশে দেড় হাজার বছর পর জন্ম নেয় ইসলামের প্রধান ব্যাক্তি হযরত মুহাম্মদ (সা.)। সময়কাল ৫৭০ খ্রি.।
অন্যদিকে ইসহাকের পুত্র কেনানের হেব্রন শহরে ইয়াকুব বা জ্যাকোব নামে বড় হতে থাকে। বিশ্বাসীদের মতে স্রষ্টা নিজেই ইয়াকুবের আরেকটি নাম দেন সেটি ‘ইসরাইল’। যার অর্থ হলো “আল্লাহর সঙ্গে সংগ্রামী” অথবা “আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী ও প্রিয়জন”।
বাইবেলের বলা আছে, “Then the man said, ‘Your name will no longer be Jacob, but Israel, because you have struggled with God and with humans and have overcome.’” — Genesis 32:28
ইয়াকুবের ছিল বারো পুত্র। পরবর্তীতে বারো পুত্রের বংশধরেরা নতুন এক জাতীর সৃষ্টি করে যাদের বলা হয় ‘বনি ইসরাইল’। এই বনি ইসরাইলেরাই মূলত ইহুদী জাতি। কুরাআনে ৪৩ বার ইসরাইল শব্দটি এসেছে এই ইয়াকুরের সন্তানদের বোঝাতে।
ইহুদী জাতির আদি নিবাস তাই এই কেনান অঞ্চলেই। তবে চার হাজার বছরের ইতিহাসে তারা বারবার বিতাড়িত হয়েছে নিজের জন্মভূমি থেকে।
কেনান থেকে মিশরে গিয়ে ইহুদীরা হয়ে ওঠেছিল দাস। তাদের মুক্ত করে মুসা নবী নিয়ে আসেন সিনাই উপত্যাকায়। তারপর তারা আবারো বিপথগ্রস্থ হয়। পবিত্র ভূমি জেরুজালেমে প্রবেশের সময়কার দীর্ঘায়িত হয়। সে এক লম্বা ইতিহাস। আগের গল্পে ফেরা যাক।
আব্রাহামের নাতি মানে ইয়াকুবের ১২ পুত্রের এক প্রিয় পুত্র ছিল ইউসুফ। পিতা তাকে বেশি পছন্দ করতো বলে ভাইরা তাকে ঈর্ষা করতো। ঈর্ষা থেকে বিদ্বেষ, শেষ পর্যন্ত তা অনেক দূর গড়ায়। পিতার সাথে মিথ্যাচার করে ভাইকে কুয়ায় ফেলে দেয় ভাইয়েরা।
কিছু মিশরগামী ব্যবসায়ী মানুষ ইউসুফকে সাহায্য করে উদ্ধার করে মিশরে নিয়ে যায়। কালের পরিক্রমায় ও নানা ঘটণায় ইব্রাহিমের প্রোপৌত্র ইউসুফ হয়ে ওঠেন মিশরের রাজদরবারে বড় কর্তাব্যাক্তি। রাজার বিশ্বস্ত। আজকের খাদ্যমন্ত্রীর মতো তার ক্ষমতা তখন।
ইউসুফ নবীকে কুয়ার ফেলে দেওয়া, মিশরের বিক্রি হওয়া, মুনিবের বাড়িতে নারীর অভিযোগে জেলে যাওয়া, সেখান থেকে বের হয়ে মিশরের খাদ্যমন্ত্রী হওয়া পুরো কাহিনী বর্ণনা করা আছে কুরাআনের ‘সূরা ইউসুফে’র ১১১ টি আয়াতে। কুরআনে আর কোন নবীর কাহিনী এত পূর্নাঙ্গভাবে বর্ননা করা নাই।
( চলবে..)
পারভেজ সেলিম
লেখক,সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী