পারভেজ সেলিম
(পর্ব: ০৩)
মিশরের বনী ইসরাইলের দরিদ্র এক দাস পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হয়রত মুসা (আ.)। সময়কাল ১২৭০ খ্রি.পূর্ব।ইউসুফ নবী মারা যাবার প্রায় পাঁচশত বছর পরের গল্প।দুই নবীর মাঝের সময়টা এক বিশাল অন্ধকার যুগ।
সময়ের সঙ্গে ইউসুফ (আ.) এবং তার পরের প্রজন্মের লোকেরা মারা যান। নতুন রাজবংশ বা ফেরাউনের আবির্ভাব হয় যারা ইউসুফ (আ.)-এর অবদান ভুলে যায় (সূরা কাসাস ২৮:৪)।
কয়েক শতাব্দী ধরে নতুন মিশরের ফেরাউনরা বনী ইসরাঈলদের দাসে পরিণত করে।কঠোর শ্রমে বাধ্য করা হয়, ইট ও পিরামিড তৈরির কাজে লাগানো হয়এই অবস্থা চলতে থাকে দীর্ঘ প্রায় ৩–৪ শতাব্দী ধরে।এই সময়কালে কুরআন বা হাদিসে কোনো নবী পাঠানোর কথা উল্লেখ নেই।
তবে তাফসীর ও বাইবেল অনুসারে এই সময় কালে কয়েকজন ধর্মীয় নেতা বা “গোত্র প্রধান” (যেমন: লেভি, কোহাত, আমরাম) ছিলেন যারা ঈমানদারদের মাঝে ধর্মীয় চেতনা ধরে রাখেন।
মুসা (আ.)-এর পিতা আমরাম (Imran) ছিলেন সেই উত্তরাধিকারী ধারার একজন।
মুসা নবীর জন্মের আগে ক্ষমতা ধরে রাখতে জোতিষীরা এক নিষ্ঠুর পরামর্শ দিয়েছিলেন ফেরাউন বা রাজাকে।মিশরের নতুন জন্ম নেয়া সকল পুত্র সন্তানদের হত্যা করতে বলেছিল। জোতিষিদের কথামত সদ্য জন্মদেয়া সকল ইহুদী পুত্রসন্তানদের হত্যা করতে শুরু করেছিলেন ফেরাউন।
সন্তানকে বাঁচাতে মুসার মা নীল নদে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন নিজ ছেলেকে। গল্পে দেখা যায়, ফুটফুটে সুন্দর একটি বাচ্চাকে নদীতে ভাসতে দেখে কোলে তুলে নেয় ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া।
পরবর্তীতে রাজার ঘরেই বড় হতে থাকে মুসা। শুধু তাই না আল্লাহর পরিকল্পনায় দুধমা হিসেবে নিজের মাকেও পায় মুসা।ফেরাউনের ঘরে নিজের মায়ের বুকের দুধ খেয়েই বেড়ে ওঠেন মুসা নবী।কুরআনের ‘সূরা কাসাসে’ মুসা নবীর জন্ম বেড়ে ওঠার এই কাহিনী বর্নিত আছে।
পুরো ইহুদী জাতি ততদিনে মিশরে দাসে পরিনত হয়েছিল। ইহুদীদের প্রতি ফেরাউন যে অত্যাচার করতো তা দেখে সহ্য করতে পারতেন না ছোট মুসা। এমন অন্যায় অত্যাচার দেখতে দেখতেই যুবক হয়ে ওঠেন মুসা।
ঘটনাক্রমে একদিন মুসার অনিচ্ছাকৃত আঘাতে নিহত হন এক মিশরীয়। এজন্য স্রষ্টার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তিনি। এরপর কোন কিছু না ভেবেই তৎক্ষনাৎ মিশর ছেড়ে চলে যান তিনি।
পাশের দেশে মাইদানে (বর্তমান সৌদি আরবের উত্তর পশ্চিমাঞ্চাল) শোয়াইব নবীর সাথে দেখা হয় এক কুয়ার ধারে। পরের গল্প তার মেয়ের সাথে বিয়ে হয় মুসা নবীর।
এরপরই মুসা নবী নবুয়্যত লাভ করেন। আল্লাহর সাথে তার সাক্ষাত হয় তার। ইহুদী জাতির পথ দেখানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তিনি।
এরপর আবার মিশরে ফেরেন মুসা। ইহুদী জাতির পরিত্রাতা হিসেবে এবার আবির্ভূত হবেন তিনি।
এক সময় ফেরাউন হাত থেকে ইহুদীদের রক্ষা করে লোহিত সাগর পার হয়ে চলে আসেন। অলৌকিক ক্ষমতায় সাগরে ডুবে মারা যায় মিশরের ফেরাউন ও তার বাহিনী।
ধারণা করা হয় মূসা (আ.)-এর জীবনকালে ফেরাউন দুজন ছিলেন। একজন যিনি তাঁর জন্ম ও বড় হওয়ার সময় শাসক ছিলেন, নাম ‘রামেসেস II’। আর দ্বিতীয়জন যিনি তাঁর নবুয়্যত ও রেড সি পার হওয়ার সময় বিরোধিতা করেছিলেন, নাম ‘মের্নেপতাহ’।
“Merneptah Stele” নামের একটি প্রাচীন শিলালিপিতে প্রথমবারের মতো “Israel” শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১২১০ সাল) যেখানে লেখা:“Israel is laid waste; its seed is no more.”
অনেক গবেষক মনে করেন, এই সময়েই হয়তো মূসা (আ.) বনী ইসরাঈলকে মিশর থেকে বের করে আনেন এবং এই ফেরাউনই নীল নদে ডুবে যায়।
কতজন ইহুদী সাগরে পার হয়ে এসেছিল তা কোন সংখ্যা কুরআনে উল্লেখ নাই।

তবে বাইবেল কয়েকবার বলা হয়েছে ৬ লাখ পুরুষ (নারী শিশু মিলে ১৫/২০ লক্ষ) লোহিত সাগর পাড়ি দিয়েছিল। আধুনিক ইতিহাসবিদরা অবশ্য মনে করে এই সংখ্যা অতিরঞ্জিত। গোটা মিশরেই তখন জনসংখ্যা ১৫/২৫ লক্ষ মানুষ ছিল।
কুরআনের সূরা ইউনুসে ফেরাউনের মৃতদেহ সম্পর্কে বলা আছে ‘আজ আমি তোমার দেহকে রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তী লোকদের জন্য এক নিদর্শন হও।”
আজও মিশরের কায়রোতে মমি করে সংরক্ষিত এক ফেরাউন রয়েছে, যাকে অনেক গবেষক ‘মের্নেপতাহ’ বলে মনে করেন। এটি ঐতিহাসিক ও কুরআনিক ব্যাখ্যার মধ্যে সংযোগ তৈরি করে।
কিন্তু লোহিত সাগর পার হয়ে আসার পর ইহুদী জাতির শুরু হয় নতুন গল্প।এবারের গল্প ব্যর্থতার গল্প।
মুসা নবী ও স্রষ্টার কথা তার অনুসারিরা অমান্য করতে শুরু করেন। বিপথগামী হয় ইহুদী জাতি।
মুসার নির্দেশমত তারা যুদ্ধ করে জন্মভুমি কেনানে প্রবেশ করতে চান না। তারা মুসা ও তার আল্লাহকে যুদ্ধ করে কেনান দখল করে দিতে বলেন। যেমন করে মোজেজা দেখিয়ে নীল নদ পার হয়ে এসেছিল, তেমনি অলৌকিক ক্ষমতা বলে তাদের পবিত্র ভুমি দখলের আবদার করে মুসা নবীর কাছে। যাতে স্রষ্টার সম্মতি ছিল না।
এরপর ৪০ দিনের জন্য তোরা পাহাড়ে যান মুসা নবী। স্রস্টার কাছ থেকে দশটি মৌলিক উপদেশ তার জাতির জন্য নিয়ে আসেন।
শিরিক করোনা, মিথ্যা বলো না, হত্যা করো না, ব্যাভিচার করোনা, অন্যর সম্পদ লুট করো না, মুর্তিপুজা করোনা, পিতামাতে সম্মান করো, চুরি করোনা, মিথ্যা সাক্ষী দিও না। স্রস্টার নামের অপব্যাবহার করো না।
কিন্তু ততদিনে ইহুদীরা আল্লাহকে ভুলে গেছে, মুসা নবীকে নেতা মানতেও নারাজ। পথভ্রস্ট ইহুদীরা স্বর্ণের গরুর মুর্তির উপাসনা শুরু করেন।
এই পথভ্রস্ট জাতির জন্য ৪০ বছরের শাস্তি প্রদান করেন আল্লাহ। স্রস্টার নির্দেশে তারা ভূখন্ডহীন এক ভবঘুরে জাতিতে পরিনত হন।
সিনাই উপত্যাকায় বেদুইনের মতো দেশহীন ইহুদীরা ঘুরতে থাকেন চল্লিশ বছর। তবু তাদের ‘প্রমিজ ল্যান্ড’ বা ‘পবিত্র ভুমিতে’ ফিরতে পারে না।
ইহুদীদের দূর্দশা দীর্ঘ হতে থাকে।
(চলবে…)
পারভেজ সেলিম
লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী
ইহুদী নিয়ে পুরো পর্ব পড়ুন :
পর্ব: ০১ ইহুদী: প্রতিশ্রুত ভুখন্ড ও রক্তাক্ত বর্তমান
পর্ব: ০২ : ইহুদী: ইউসুফ থেকে মুসা, মাঝে অন্ধকার
পর্ব: ০৩ : মুসা: ইহুদীদের ‘মুক্তিদাতা’