মুসকান: এক ধার্মিক প্রতিবাদী নারী !

ভারতের কর্নাটক রাজ্যের এক মুসলমান ছাত্রীর নির্ভীক প্রতিবাদ, দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে উপমহাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। সময়টা ২০২২ এর ফেরুয়ারি মাস ।

৪০/৫০ জন উগ্র হিন্দু ছেলে স্কুলে ঢুকতে বাধা দেয়ায় সাহসী প্রতিবাদ করেছে একটি মেয়ে। তার নাম মুসকান। প্রশ্ন হলো মুসকানের এই প্রতিবাদ কেন এত সাড়া ফেললো ? 

‘জয় শ্রীরাম’ বলে অন্যের পথরোধ করাটা ধর্মীয় উগ্রবাদ। মুসকান এই উগ্রবাদকে মোকাবেলা করছে তার নিজ ধর্ম দিয়েই। ধর্মীয় শ্লোগান দিয়েই সে উন্মোচন করেছে উগ্রবাদের রুপ। সেটি দারুণ কাজ করেছে। 

উগ্রবাদীরা ভয় পেয়েছে, মুসকানের জয় হয়েছে। মুসকান বীরদর্পে স্কুলে প্রবেশ করেছে। 

মুসকান খানকে হয়রানির চেষ্টা এবং তার প্রতিবাদের ভিডিও ভাইরাল হয়

মুসকানের মটরসাইকেল রাখা, হেটে আসার ধরণ, ’আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার সবকিছু এত নায়কোচিত ছিল যে তার সাহসের কাছে বাকিরা পরাজিত হয়েছে। মুসকানের জয়ে মুগ্ধ হয়েছে বেশিরভাগ মানুষ।

সেই সময়  কিছু শিক্ষক ও সাংবাদিকের মুসকানকে সাহায্য করা চেষ্টা মনে করিয়ে দিয়েছে সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যায়নি।

মুসকানের এই প্রতিবাদকে সবচেয়ে সমর্থন দিয়েছেন ভারতের মানুষেরাই। যত মানুষ ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়েছে, তার চাইতে কয়েকশ গুণ মানুষ মুসকানের পক্ষ নিয়েছে, খোদ ভারতেই।

সারা ভারত ও বাংলাদেশে মুসকানের অপর নাম হয়েছে ‘সাহস’।

মুসকান ধর্ম বোঝে কিনা জানিনা, তবে রাজনীতি বোঝে। বোরখা পরে ক্লাসে যাওয়াটাকে সে অধিকার মনে করে। তাই কর্তৃপক্ষ যখন স্কুলে ইউনিফরম পরে আসার নোটিশ জারি করে সেটাকে সে অমান্য করতে চায়। কারণ সে মনে করে এই নোটিশ শুধু মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকারটুকু কেড়ে নেবার রাজনীতি। 

ধর্মীয় চিহ্নবহন করে অন্যধর্মের শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসতে বাধা দেয়া হবে না, শুধু মুসলমানদের দেয়া হবে বলে মনে করে। এটাই ভারতের বর্তমান রাজনীতি। মুসকান এই রাজনীতির বিরোধী। সে ধর্মীয় হিন্দু উগ্রবাদকে, নিজ ধর্ম দিয়ে মোকাবেলা করতে চায়।

মুসকানের সাহসটুকুই আসলে মানুষের সাহস। সবকিছু যখন আপনার বিরুদ্ধে চলে যাবে, যদি আপনি নিজেকে সঠিক মনে করেন তখন একাই লড়ে যাওয়াই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। মুসকান মানুষের মর্যাদাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

একটু ব্যবচ্ছেদ :

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুসকান কিসের প্রতিনিধিত্ব করেছে? মুসলমানদের? অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর? পোষক নারীদের ইচ্ছাধীন এই মতবাদের? হিন্দুত্ববাদ বিরোধীতার? নাকি সাহসের প্রতিনিধি এই মুসকান?

মুসকান আপনার কাছে প্রিয় হয়ে উঠল তার কোন চরিত্রের জন্য? নিজেকে কি প্রশ্ন করা যায় কেন মুসকান আপনাকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে? 

পোষাক নারীর ইচ্ছাধীন !

ধরুণ মুসকান যদি জিনস টি-শার্ট পরে ক্লাসে যাবার অধিকার চেয়ে প্রতিবাদ করতো তাহলে কি এতটা সমর্থন পেত?  নিশ্চয়ই নয়। কেন নয় এই প্রশ্নের উত্তর খুজলেই যা পাওয়া যায় তা  হল ‘নারীরা নিজের ইচ্ছায় পোষক পরবে’ এই মতবাদের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে মুসকানকে আপনিও হয়ত খারিজ করে দেবেন। তাই এটা নারীর ইচ্ছামাফিক পোষক পরার অধিকারের প্রশ্ন নয়! এটি তাহলে কি?

এটি কি তবে ধর্মীয় পোষাক করে ক্লাসে যাবার অধিকারের প্রতিবাদ?  অথচ প্রিয়াংকা গান্ধী মুসকানের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে বলেছেন ’বিকিনি হোক, ঘোমটা হোক, জিন্স হোক আর হিজাবই হোক, মেয়েরা কি পরবে তা ঠিক করবে মেয়েরাই।’ 

প্রিয়াংকার এমন সমর্থন কি মুসকানের সাহসের সাথে সম্পর্কযুক্ত? খাঁটি মুসলমান হলে তো প্রিয়াংকার এই মতামত সমর্থণ যোগ্য হবার কথা নয়। মুসকান তো তার ধর্মীয় পোশাক পরে শিক্ষা গ্রহণের অধিকারের কথা বলেছে!

তাহলে মুসকান কেন এত সাহসী হয়ে উঠল? সংখাগরিষ্ঠ হিন্দুর মাঝে একাই এক মুসলিম নারী কেন এমন নির্ভীক প্রতিবাদী হয়ে উঠল?  ধর্মের  কারণে ! দীর্ঘ নির্যাতনে মুসলমানদের এমন নির্ভীক হওয়ার ইতিহাস পুরোনো। মুসকান কি সেই পুরাতন ইতিহাসের নতুন প্রতিনিধি? হয়তবা !

বাংলাদেশের স্কুলে টুপি ও ওড়না নিষিদ্ধ : 

২০২০ সালের জানুয়ারি হতে রাজধানীর দুইটি স্কুলে ছেলেদের টুপি আর মেয়েদের ওড়না পড়া নিষিদ্ধ করেছে।  তাদের বলা হয়েছে ক্রস বেল্ট ওড়না পড়তে হবে। তবে কেউ চাইলে সাথে হিজাব পড়তে পারবে। তবে ছেলেরা টুপি পড়তে পারবে না।

স্কুলের এমন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে কোন মুসকান তৈরি হয়নি। অভিভাবকদের মধ্যে কিছুটা প্রতিবাদ  হয়েছে কিন্তু সারাদেশে তা ছড়িয়ে পড়েনি। এমনকি মুসকানের আজকের প্রতিবাদকে যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে ব্যাখ্যা করছেন তারাও নিশ্চয়ই মনে করেননা যে ঐ দুটি স্কুল থেকে ধর্ম বিদায় হয়েছে। তাহলে সংকটটা কোথায়? 

মুসকানের প্রগতিশীলতা :

কেউ কেউ বলছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ যদি ধর্ম দিয়েও করা হয় সেটাও প্রগতিশীলতা। সত্যভাষণ। কিন্তু ভাবুন এখানে ধর্মের চাইতে প্রগতিশীলতাকে মহাণ করে দেখা হয়েছে। হয়নি কি? মুসকান কি প্রগতিশীল নয় ? 

তবু ধার্মিক মুসকানকে আপনি যত সহজে গ্রহণ করছেন, প্রগতিশীল মুসকানকে আপনি কতটুকু গ্রহণ করতে পারছেন সেটাই আপনার লিটমাস পেপার।

বোরকা ছাড়া আরো কয়েকটা ছবি প্রকাশ পেয়েছে মুসকানের। ছবিগুলো দেখেই আপনার মনের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছে? তার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছে নাকি কমেছে? এটা একটা দারুণ পরীক্ষা! 

মুসকানকে কি ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে চান নাকি তাকে আরো বড় ও মহৎ কিছু হিসবে দেখতে চান। সিদ্ধান্ত আপনার। শুধু মুসলিম মুসলিম করে মুসকানের সত্যিকারের প্রতিবাদকে ম্লান করা হচ্ছে। 

মুসকান শিক্ষা চায়, হিজাব পরে। ‘হিজাব মাথার চুল ঢাকে, মগজ নয়’ মুসকান এটাই বিশ্বাস করে।

গান্ধী বলেছিল, ‘আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি শিখ, আমি বৌদ্ধ’। কিন্তু তিনি বলেননি সবার আগে তিনি মানুষ। তিনি ধার্মিক ভারতের চিন্তা করেছেন, অসাম্প্রদায়িক ভারতের নয়। তিনি সবার পরিচয় প্রথমে ধর্ম দিয়ে করছেন, তার পর মানুষ। তবে তিনি চাইতেন সব ধর্ম মিলেমিশে একসাথে থাকুক। 

কিন্তু জিন্নাহ চাইলেন মুসলমানের দেশ, প্যাটেল চাইলেন হিন্দুদের দেশ আর নেহেরু চাইলেন প্রধানমন্ত্রীত্ব। তালগাছটা হিন্দুদের পকেটেই থাকুক এটাই দেখতে চেয়েছিলেন নেহেরু। ফলাফল গত সাতদশকের বেশিসময় ধরে আমরা দেখছি। 

গেরুয়া বাহিনীকে পরাস্ত করার মধ্যে যে সুখ আপনি ভিতরে ভিতরে পান সেটি যেমন সাম্প্রদায়িকতা, হিজাব পড়া বন্ধ করাতে পারলে গেরুয়া বাহিনীর যে সুখের অনুভূতি হয় সেটিও তেমন সাম্প্রদায়িকতা।

মুসলমানদের সাহস প্রদর্শণ :

মুসলমানেরা সাহস প্রদর্শনে অগ্রগামী, তারা মরে যাবে তবু সাহস কখনো কমবে না। এত সাহসী ধার্মিক মানুষ অন্য ধর্মে দেখা যায় না। 

ফিলিস্তিনে ৭২ বছর ধরে মরে শেষ, তবু ছোট মুসলিম ছেলে কিংবা মেয়েটা ইসরাইলি বেয়োনেটের সামনে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে। ভারতে সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দুদের কাছে মুসলমানদের নির্যাতন চলছে দীর্ঘদিন যেমনটি বাংলাদেশেও,তবে প্রতিবাদ প্রদর্শণ তার উল্টো। 

খেয়াল করুন, ভারত এখন সহনশীল বহুত্ববাদ রাষ্ট্র হতে বের হয়ে একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদি রাষ্ট্রে পরিনত হচ্ছে বা হয়ে গেছে।

নরেন্দ্র মোদির রাজনীতি মেরুদন্ডটাই হচ্ছে মুসলিম বিরোধিতা। এভাবেই তিনি ‘সফল’ হয়েছেন,হচ্ছেন।

উত্তরপ্রদেশে এক হিন্দু মেয়ে মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করার কারণে রাষ্টের প্রধানরা মেয়েটিকে পুড়িয়ে ছাই পর্যন্ত গায়েব করে দিয়েছিল। শেষ ফলাফল কিছু হয়েছে? হয়নি। তাহলে হিজাব বির্তক ভারতে ছড়িয়ে পড়ার কারণ কি রাজনীতি নয়? অবশ্যই রাজনীতি। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। সেই পুরোনো  শকুন ।

শেষের কথা :

ধর্ম দিয়ে ধর্মের মোকাবেলা অনেকটা এফডিসির জায়েদ-নিপুনের দ্বন্দের মতো। দুজনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসতে চায়। শুধু রক্তাত্ব হয় সাধারনরা, রাজনীতি চলতে থাকে। তাই মুসকানকের প্রতিবাদ ধার্মিকতা নয়, মানুষের প্রতিবাদ হিসেব দেখতে পারলেই মানুষের জয় হয়। 

একটা কবিতা দিয়ে শেষ করি। 

‘যেখানে জীবনের জয়গান/ সেখানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন হচ্ছে প্রতিবাদ !

যেখানে বেঁচে থাকা যন্ত্রণাময় /সেখানে ভালোবেসে লড়াই হচ্ছে প্রতিবাদ!

অজস্র শোক আর বেদনায় নিমজ্জিত থেকে/ সহজ হওয়া হচ্ছে প্রতিবাদ।

পৃথিবীর প্রত্যেকটি মহৎ প্রাণ/আজন্ম প্রতিবাদি আর বিপ্লবী!’

…..

মুসকান এক মহৎ প্রাণ প্রতিবাদী। মুসকানদের জয় হোক। 

পারভেজ সেলিম

পারভেজ সেলিম

লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী

ফেব্রুয়ারি /২০২২

———————————————-

২ thoughts on “মুসকান: এক ধার্মিক প্রতিবাদী নারী !

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x