খনা: বাঙলার প্রাচীন বিদ্বান নারী

বাঙলার প্রাচীন এক বিদ্বান নারী, যিনি ভীষণ জনপ্রিয়তা নিয়ে এখনো  ঠিকে আছেন বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে,  তার নাম খনা নাম্মী। খনা নামেই যিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। 

তার দেয়া  ভবিষ্যৎবানী ‘খনার বচন’ নামে এখনও বাঙ্গালীর শিক্ষা ও জ্ঞানের এক অপূর্ব ভান্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রাচীনকালে বাঙ্গালী নারীরা শিক্ষায় যে অগ্রগামী ছিলেন তার বড় প্রমাণ খনা নামের এই সুশিক্ষিত নারী।

কি আছে খনার বচনে ?

খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্ব ভিত্তিক ছড়া। যুগ যুগান্তর ধরে গ্রাম বাংলার জন জীবনের সাথে মিশে আছে অজস্র খনার বচন। এই রচনা গুলো মুলত চার ভাগে বিভক্ত।

কৃষিকাজের প্রথা ও কুসংস্কার, কৃষিকাজ ফলিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান, আবহাওয়া জ্ঞান আর শস্যের যত্ন সম্পর্কিত উপদেশ।

অনেকের মতে, খনা নাম্নী আনুমানিক ৮ম- ১২শ শতাব্দীর মধ্যে এসব বচন রচনা করেছিলেন। 

কে ছিলেন এই খনা?

খনার আসল পরিচয় বের করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলে তার আসল নাম ছিল লীলাবতী । তবে এখনও গবেষণায় পুরোপুরি কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি তিনি আসলে কে ছিলেন ! কবে তার জন্ম ! অনেকেই মনে করেন খনা ছিলেন এক নারী বাঙালি কবি। তবে কারো কারো মতে তার আরো কয়েকটি পরিচয় আছে।

মিহিরের স্ত্রী বাঙালী খনা?  

গুপ্ত যুগের রাজা ‘দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত’ বা বিক্রমাদিত্য’র রাজসভার নবরত্নের কথা আমরা জানি। তারা ছিলেন কালিদাস, বেতাল ভট্ট, বরাহ-মিহির, বররুচি, অমর সিংহ, ধন্বন্তরি, খপনাক, শঙ্কু আর হরিসেনা।

এর মধ্যে বরাহ-মিহির ছিলেন জটিল ব্যক্তি। কেউ বলেন বরাহ এবং মিহির হলেন বাবা-ছেলে, কেউ বলেন একই ব্যক্তি। 

যাই হোক, ইনি বা ইনারা ছিলেন অঙ্ক, জ্যোতিষ এবং মহাকাশবিদ্যায় পারদর্শী। ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’ এবং ‘বৃহত সংহিতা’ এদের লেখা দুইটি বৃহৎ বই।

বলা হয়, খনা ছিলেন এই মিহিরের স্ত্রী। আর একদম বঙ্গজ। বারাসাত এর দেউলি গ্রামে তার জন্ম। বিদ্যাধরী নদীর পারে চন্দ্রকেতুগড়ে খনার নামে একটা ঢিপি এখনও আছে। খনাকে বাঙ্গালি বলার পিছনের একটা একটি বড় প্রমাণ হিসেব ধরা হয়।

খনা কি  ভিনদেশী সিংহল রাজার কন্যা ?

অন্য একটি কিংবদন্তি অনুসারে খনা ছিলেন সিংহল রাজার কন্যা। গুপ্ত যুগের উজ্জয়নীর রাজা (বর্তমানে  মধ্যপ্রদেশ) বিক্রমাদিত্যের রাজ সভার প্রখ্যাত জোতির্বিদ বরাহ পুত্র মিহির ছিলেন খনার স্বামী।  

বরাহ তার পুত্রের জন্ম কোষ্ঠি গণনা করে পুত্রের আয়ু এক বছর দেখতে পেয়ে শিশু পুত্র মিহিরকে একটি পাত্রে করে সমুদ্র জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। পাত্রটি ভাসতে ভাসতে সিংহল দ্বীপে পৌঁছলে সিংহলরাজ শিশুটিকে লালন পালন করেন এবং পরে কন্যা খনার সাথে বিয়ে দেন। 

খনা এবং মিহির দু‘জনেই জ্যোতিষশাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। অনুমান করা হয়, বরাহের প্রয়াণের পর মিহির একসময় বিক্রমাদিত্যের সভাসদ হন। 

একবার পিতা বরাহ ও পুত্র মিহির তারা গননায় সমস্যায় পড়লে তার সমাধান করে দেন খনা। এই খবর রাজা বিক্রমাদিত্যের কান পর্যন্ত পৌঁছায়। পরবর্তীতে জ্ঞান আর সঠিক ভবিষ্যৎবানীর জন্য খনা দশম রত্ন হিসেবে রাজসভায় স্থান পান।

বৌমার নির্ভূল গননা শ্বশুর মশাইকে ছাপিয়ে গেলে, তা খুব সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি রবাহ-মিহির। রাজসভায় প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে প্রতিহিংসায় বরাহের আদেশে মিহির জিভ কেটে দেন খনার। যাতে সে আর কোন গননা করতে না পারে। এর কিছুকাল পরে খনার মৃত্যু হয়। 

এই গল্পের সত্য মিথ্যা যাচাই করা খুবই কঠিন। তবে খনাকে নিয়ে এই নির্মম হিংস্রতার গল্প প্রচলিত আছে।

সাথে আরেকটি গল্প প্রচলিত আছে। খনার সেই কাটা জিভ টিকটিকি খেয়ে ফেলেছিল। তাই কোনো কথায় টিকটিকির টিক টিক শোনা গেলে সেই কথা সত্যি হয় বলে এখনও ভাবা হয়। 

জিভ কাটাটা সত্য হোক কিংবা গল্প, নীরব হওয়ার আগে এই মহাণ নারী আমাদের সমাজ-সভ্যতাকে এক বিশাল জ্ঞান ভাণ্ড দিয়ে গেছেন, আর তার অমৃত রসসুধা পান করে আমরা বাঙালীরা আজও আনন্দ পায়ড়।

প্রশ্ন একটা থেকেই যায়, খনা যদি সিংহলের কন্যা হয়েই থাকেন এবং উজ্জয়নীতে তার শ্বশুরবাড়ী হয়, তবে বচন গুলো বাংলায় লিখলেন কি করে ? সিংহলে বা উজ্জয়নীতে তো বাংলা ভাষার প্রচলণ ছিল না !

যদিও কোনো প্রমাণ নেই, তবে মনে করা হয়, খনা গণিত শাস্ত্রের বই  এ যে ভাবে ছোট ছোট সূত্র লিখেছিলেন, সেই ভাবেই সংস্কৃতে এই বচন গুলো লিখেছিলেন। পরে সে গুলো বাংলায় অনুবাদ করা হয়। বাংলায় অনুবাদ, চর্যাপদের আগেই হয়েছিল বলে মনে করা হয়। 

জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী নারী যিনি বচন রচনার জন্যেই পরিচিত, মূলত তার ভবিষ্যতবাণী গুলোই ‘খনার বচন’ নামে বহুল পরিচিত।

খনা কোন সময়ের নারী?

অনেকে মনে করেন ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খনার  জন্ম হয়েছিল। কিংবদন্তি অটণাচার্য ছিলেন খনার বাবা। খনার একটি বচনে এই পরিচয় পাওয়া যায়। “আমি অটনাচার্যের বেটি, গণতে গাঁথতে কারে বা আঁটি”।

অন্যদিকে  আবার খনা যদি বরাহমিহিরের পুত্রবধু হয়ে থাকেন তাহলে তাঁর সময়কাল আরো ‍পুরোনো, মোটামুটি ৪০০ খ্রিষ্টাব্দ। 

 খনার বচন যদি সে সময়ের রচনা হয়ে থাকে, তাহলে তা লিখিত হবে সংস্কৃতে অথবা মাগধী প্রাকৃতে । কারণ বাংলা ভাষার তখনো উদ্ভব হয়নি। সংস্কৃতে বা প্রাকৃতে এইসব বচনের কোন কাউন্টার পার্ট নেই। এমনকি ৭০০-৮০০ শতকের প্রাকৃত ভাষাতেও নেই। আছে শুধুই বাংলায়। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে খনা সম্পর্কে। তাই খনা যে বাঙলার মেয়ে সেটাই বেশ গ্রহণযোগ্য ।

আরো কিছু ভিন্নমত :

অনেকে মনে করেন খনা মধ‍্যযুগের বাংলার একজন মহিলা জ‍্যোতিষীবিদ যাঁর বচনগুলো বিখ‍্যাত আর চিরস্থায়ী করার জন‍্য বরাহমিহিরের নামের সঙ্গে জড়িয়ে এক কল্পকাহিনী রচনা করা হয়েছে। তিনি আলাদা একজন বিদুষী নারী ছিলেন।

অন্য আরেক মতে লীলাবতী ভারতের প্রখ্যাত গনিতবিদ  ভাষ্করাচার্য-২ এর কন্যা। বাল বিধবা। বাবার সাথে বৈদিক অঙ্ক চর্চা করতেন। বাপ বেটির সংকলনের নাম ছিল ’লীলাবতী’, সেটাও আবার অংকের বই। গ্রীক গনিতজ্ঞ ইউক্লিডের ১৩ খন্ডের ‘ইউক্লিড’স এলিমেন্টে’ লিখা হয়েছিল খৃষ্ট পূর্ব ৩০০ সালে । এরপরে ’লীলাবতি’ হলো ইতিহাসের দ্বিতীয় প্রাচীন গনিত বই।

তবু ইতিহাস এবং মিথ মিলে  কিছু ধোঁয়াশা থেকেই যায় খনা কে ছিল আর কোন সময়ের নারী ছিলেন।

তবে এটা নিশ্চিত বঙ্গ ললনা খনা যদি ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রি.এর মধ্যে জন্ম গ্রহণ করেন, তবে তিনি গুপ্ত যুগের নবরত্ন বরাহ -মিহিরের সমসাময়িক হতে পারেন না। গুপ্ত যুগ তার অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছিল। 

৮০০-১২০০ সালে বাংলা তখন খিলজির দৌরাত্ম উপভোগ করছিল। খনার বচন মুলত প্রাক চর্যাপদ যুগের হলেও এতে ধর্ম বা ভক্তি কোনটাই নেই। 

খনা  পরিচয় নিয়ে যত ধোঁয়াশাই থাকুক না কেন তিনি এই বাঙলার সবচেয়ে প্রাচীন এক বিদুষী নারী চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন মানুষের মনে। 

যতদিন বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষ থাকবে ততদিন খনা এক বিশেষ নারী চরিত্র হিসেবে টিকে থাকবেন।


পারভেজ সেলিম

পারভেজ সেলিম

লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x