ধ্রুপদী বাংলার সাড়ে বারোশ বছরের ইতিহাস

parvez salim alordeshe

পারভেজ সেলিম

বাংলার ইতিহাসকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রাচীন যুগ (১৭০০-৩০ খ্রি.পূর্ব), ধ্রুপদী যুগ (৩২০-১২৩০ খ্রি.), মধ্যযুগ (১২০৪-১৭৫৭ খ্রি.) ও  আধুনিক যুগ (১৭৫৭-বর্তমান)। 

প্রাচীনকালের যে ইতিহাস আমরা জানি তা থেকে মৌর্য যুগ পর্যন্ত সময়কে ধরা হয় প্রাচীন যুগ। যদিও এর পরের দুইশ বছরও প্রাচীন যুগের মধ্যেই পড়ে। 

এরপর শুরু হয় সাড়ে তিনশ বছরের ইতিহাস আমাদের আজানা ইতিহাসে যা অন্ধকার যুগ নামে পরিচিত। ক্লাসিক বা ধ্রুপদী বাংলার যুগ শুরু হয় ৩২০ সালে গুপ্ত সাম্রাজ্য শাসনের মধে দিয়ে। গুপ্ত যুগকে বাংলার সমৃদ্ধির শ্রেষ্ঠ যুগ হিসেবে ধরা হয়।  

গুপ্ত যুগের পর অল্প সময়ের জন্য বাংলার ক্ষমতায় বসে এক বাঙ্গালী শাসক, যার নাম শশাংক। তারপর বাংলা আবারো অন্ধকার যুগে চলে যায়। বিশৃংখল বাংলার সেই ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। পরে পাল ও সেন বংশের শাসনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ‘ক্লাসিক বাংলার যুগ’।

১২০৪ সালে বাংলায় মুসলমানদের আগমনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় মধ্যযুগের। আর আধুনিক যুগের সূচনা হয় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে বাঙ্গলার মানুষের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে।

গত সিরিজে আমরা প্রাচীন বাংলার রাজাদের কথা জানিয়েছি। এবারের সিরিজে আমরা মনোযোগ দিতে চাই ধ্রুপদী যুগ বা বাংলার শ্রেষ্ঠ যুগের উপর। 

১. অন্ধকার যুগ: (৩০খ্রি.পূ-৩২০ খ্রি.) ৩৫০ বছর

মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল প্রাচীন বাংলার শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য। এরপর কান্ব রাজবংশ মগধ শাসন করে কিছুকাল। তখনও বাংলা মগধের অধীনে ছিল।

তারপর কুশান রাজবংশ উত্তর ভারত আর সাতবাহন রাজবংশ দক্ষিন ভারত শাসন করে। এ সময় বাংলা তাদের অধীনে থাকার কোন তথ্য পাওয়া যায় না।  এসময় প্রায় ৩৫০ বছর বাংলা কে শাসন করতো তা নিয়ে এখনও অন্ধকার কাটেনি। ছোট ছোট সামন্ত রাজারা শাসন করে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। 

৩০ খ্রি.পূর্ব থেকে ৩২০ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিনশ বছর বাংলার কোন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই ইতিহাসে এই সময়কাল ‘অন্ধকার যুগ’ নামে পরিচিত। 

পরবর্তীতে গুপ্ত সম্রাটরা এসে বাংলাকে এক শক্তিশালী সাম্রাজ্রে পরিনত করে।

২. গুপ্ত রাজবংশ : (৩২০ -৫৫০ খ্রি.): ২৩০ বছর

গুপ্ত যুগ  শুরু হয় ৩২০ খ্রি.। আর এর মধ্য দিয়েই আসলে শুরু হয় ক্লাসিক বা ধ্রুপদী বাংলার শাসনকাল।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রী গুপ্ত। এই বংশের প্রথমদিকের রাজারা হিন্দু হলেও শেষ দিকের রাজারা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকেন।

গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠা শ্রীগুপ্ত করলেও তার নাতি প্রথম চন্দ্রগুপ্তের হাতে এই বংশের শান শওকাত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২৮০ সালে শ্রী গুপ্ত মারা গেলে তার ছেলে ঘটোৎকচ ক্ষমতায় বসেন। তিনি ৩১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন, এরপর প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ক্ষমতায় আসেন ৩২০ সালে। এই সময়কে মুলত গুপ্ত যুগের সূচনা হিসেবে ধরা হয়।

প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সময় থেকে গুপ্ত সাম্রাজের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে চারিদিকে। ৩৩৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। তারপর ছেলে সমুদ্রগুপ্তের হাতে ক্ষমতা চলে যায়।

সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। শুধু এই বংশের নয় ভারত বর্ষের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ রাজাদের একজন ছিলেন সমুদ্রগুপ্ত।

তিনি চন্দ্রগুপ্তের প্রথম সন্তান ছিলেন না। শৌর্য ও বীর্যে তিনি অন্য সন্তানদের থেকে শ্রেষ্ঠ ছিলেন বলেই পিতা তাকে উত্তরাধীকার করে যান। পিতার সেই সম্মান রেখেছিলেন সমুদ্রগুপ্ত। পাটালীপুত্রই ছিল গুপ্ত সম্রাজ্যের রাজধানী। 

ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও সমুদ্র ছিলেন চরম সহিষ্ণু এক রাজা। সে সময়ের শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ পন্ডিত বসুবন্ধু ছিলেন তার মন্ত্রী এবং শুভাকাঙ্খী। 

সমুদ্রগুপ্তের সিংহাসনে বসার তারিখ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলে ৩২৫ খ্রি. কেউ বলে ৩৪০ থেকে ৩৫০ খ্রি. এর মধ্যে কোন এক সময়। আবার কারো কারো মতে এই সালটি ৩৩৫ খ্রি.। ইতিহাসে পাওয়া যায় সমুত্রগুপ্ত  বিশ জন রাজাকে পরাজিত করে বিশাল সাম্রাজ্য বানিয়েছিলেন। ৩৮০ সালে মৃত্যু বরণ করেন ধ্রুপদী বাংলার শ্রেষ্ঠ এই সম্রাট।

এছাড়া সমুদ্র গুপ্তের ছেলে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, পরে রামগুপ্ত সহ অনেকেই পরাক্রমশালী রাজা হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছিলেন। 

ইতিহাসে কয়েকজন চন্দ্রগুপ্ত আছেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন প্রাচীন মৌর্য সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। আর গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন শ্রী গুপ্ত, তার নাতির নাম ছিল ‘প্রথম চন্দ্রগুপ্ত’। 

গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা সমুদ্রগুপ্তের পিতাও পুত্র দুজনের নামই ছিল চন্দ্রগুপ্ত। পিতা ছিলেন ‘প্রথম চন্দ্রগুপ্ত’ আর পুত্র ছিলেন ‘দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত’। ইতিহাসে যিনি ‘বিক্রমাদিত্য চন্দ্রগুপ্ত’ নামে পরিচিত।

চীন পরিব্রাজক ফা হিয়েন এসময় ভারতে এসেছিলেন।গুপ্ত শাসকদের শক্তির মুল উৎস ছিল ঘোড়া। যা তারা কুশানদের কাছ থেকে শিখেছিল।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভায় ৯ জন বিখ্যাত পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি, নাট্যকার কালিদাস, শ্রেষ্ঠ গনিতবিদ আর্যভট্ট ছিলেন তাদের মধ্য অন্যতম। এছাড়া বরাহমিহির, বেতালভট্ট  শিক্ষা সংস্কৃতিতে এক অন্যতম উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন গুপ্ত যুগকে।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের ছেলে কুমারগুপ্ত নালন্দ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। এক শক্তিশালি একতাবদ্ধ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল গুপ্ত বংশের রাজারা। ৩২০সালে শুরু হওয়া এই যুগ শেষ হয় ৫৫০ সালে। ২৩০ বছর টিকে ছিল এই গুপ্তযুগ।

শেষের দিকে উত্তরাধিকারদের মধ্য অন্তকোন্দল, সামরিক শক্তিকে অবেহেলা করে বুদ্ধের অহিংসা নীতি গ্রহণসহ নানা কারনে গুপ্ত সম্রাজের পতন শুরু হয়। 

এরপর গুপ্ত বংশের ক্ষমতার শেষের দিকে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা শুন্য হয়ে পড়ে। এসময বাংলাও স্বাধীন হয়ে যায়। প্রথমবারের মতো এক বাঙ্গালী রাজা বাংলার ক্ষমতায় বসেন যার নাম শশাংক।

৩. শশাঙ্ক (৫৯০-৬৩৮ খ্রি.) : ৪৮ বছর

শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা এবং প্রথম বাঙ্গালী রাজা। এর আগে বড় বড় সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে আমাদের এই বাংলা শাসিত হতো। 

গৌড়কে কেন্দ্র করে প্রথম কোনো একক ব্যক্তি এই অঞ্চলের নেতৃত্বে আসেন। ৩৫/৪৫ বছর শাসন করেন। এই অঞ্চলে জন্ম ও বেড়ে ওঠা প্রথম শক্তিশালী রাজা হলেন শশাংক। তাঁর কোন রাজবংশও তৈরি হয়নি। ইতিহাসে তিনি একাই এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তার মৃত্যুর পর ছেলে মানব মাত্র আট মাস ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন।

গুপ্তযুগের শেষ দিকের দুর্বল শাসনের কারণে ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল।বাংলা অঞ্চলে সেসময় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল। দক্ষিন পুর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে ‘বঙ্গ রাজ্য’ এবং পশ্চিম ও উত্তরবাংলা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল ‘গৌড় রাজ্য’।

বঙ্গ রাজ্যের সেসময়ের তিনজন স্বাধীন রাজার নাম পাওয়া যায়। গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব। এই তিন রাজা ৫২৫ থেকে ৬০০ খ্রি. পর্যন্ত বঙ্গ রাজ্য শাসন করেছিলেন বলে ধরা হয়।

এরপর শশাংক মুলত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে এক বিশাল গৌড় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  গুপ্ত বংশের পর প্রথম কোন শক্তিশালী রাজা আবারো এই অঞ্চলের ক্ষমতায় বসেন।

তবে বঙ্গের দক্ষিণ পুর্ব অঞ্চল তার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল কিনা তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়।তবে ক্ষমতায় বসেই মগধ, উড়িষ্যাসহ বিশাল এলাকা দখল করেছিলেন শশাংক।

শশাংকের ক্ষমতায় বসার তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে। কারো মতে ৫৯০ কারো মতে ৬০০ এবং কেউ কেউ বলেন শশাংক সিংহাসনে বসেছিলেন ৬০৬ সালে।

ক্ষমতায় বসেই শশাংক হাজার বছর ধরে চলা রাজধানীর পরিবর্তন করেন। পাটালিপুত্র থেকে  রাজধানী নিয়ে আসেন কর্নসুবর্ণে। 

বর্তমানে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় এর অবস্থান ছিল। মানে বাংলার রাজধানী এ অঞ্চলের আরো কাছে চলে আসে। 

এ সময়  উত্তর ভারতে এক পরাক্রমশালী রাজা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন তার নাম হর্ষবর্ধন। শশাঙ্কের সাথে মহারাজা হর্ষবর্ধনের বৈরিতার কথা কিংবদন্তিতুল্য। প্রাচীন লেখক বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থে এবং চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর লেখায় এই বৈরিতা এবং যুদ্ধের কথা লিপিবদ্ধ আছে। 

শশাংকের সাথে হর্ষবর্ধনের বৈরিতার কারনটি বুঝতে একটু পিছনে ফিরতে হবে।হর্ষবর্ধণের পিতা প্রভাকর বর্ধন মেয়ে রাজ্যশ্রীকে বিয়ে দিয়েছিলেন মৌখরি রাজা গ্রহবর্মণের সাথে। এর কিছুদিন তিনি মারা গেলে থানেশ্বর রাজ্যের ক্ষমতায় বসেন হর্ষবর্ধনের বড়ভাই রাজবর্ধন।

শশাংক বুঝতে পেরেছিলেন এতে মৌখরি রাজার শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই নিজদেশ রক্ষার স্বার্থে তিনি পাশ্ববর্তী মালবরাজা দেবগুপ্তের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। এরপর দেবগুপ্ত সুযোগ বুঝে কনৌজ আক্রমন করে মৌখরি রাজা গ্রহবর্মনকে হত্যা করেন ও রাজ্যশ্রীকে বন্দি করেন। 

বোনকে উদ্ধার করতে রাজবর্ধন কনৌজে পৌঁছায় এবং দেবগুপ্তকে হত্যা করতে সমর্থ হন। কিন্তু কনৌজে পুর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও বোনকে উদ্ধারের আগেই নিহত হন রাজবর্ধন।

অনেকের মতে শশাংকের হাতেই নিহত হয়েছিলেন রাজ্যবর্ধন।তবে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে।

ধারণা করা হয়, শশাংক  দেবগুপ্তকে সাহায্যের জন্য কণৌজের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। শশাংকের সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন রাজবর্ধণ। আবার কারো মতে রাজবর্ধন যে কোন কারনে হোক শশাংকের কাছে এসেছিলনে সেসময়  শশাংকের মন্ত্রীরাই হত্যা করে রাজবর্ধনকে ।

রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর মাত্র ১৬ বছর বয়সে থানেশ্বরের ক্ষমতায় বসেন হর্ষবর্ধণ।হর্ষবর্ধণের সাথে শশাংকের বৈরিতা  সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পায় ভাই হত্যার পর থেকে। যদিও শশাংকের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হর্ষবর্ধন বাংলা বা গৌড় অঞ্চল দখল করতে পারেননি। তবে মৃত্যুর পরই গৌড় ও বঙ্গ হর্ষবর্ধনের দখলে চলে যায়।

শশাঙ্ককে বৌদ্ধ বিরোধী রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বানভট্ট ও হিউয়েন সাং এর লিখিত গ্রন্থে, যার সত্যতা নিয়ে ইতিহাসবিদেরা দ্বিমত পোষণ করেছেন। 

কারণ বাণভট্ট ছিলেন হর্ষবর্ধনের সভাকবি আর হিউয়েন সাং এসেছিলেন হর্ষবর্ধনের আমন্ত্রণে। তাই হর্ষবর্ধনের পক্ষে স্তুতিগাথা  লিখতে গিয়ে তারা শশাংকের বিষেদগার করেছিলেন বলে অনেক পন্ডিত মনে করেন।

শশাংক ছিলেন ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক।শশাংকের সময় বঙ্গাব্দ চালু হয়। কারো কারো মতে পুন্ডবর্ধণও তখন গৌড়ের অধীনে ছিল। তবে শশাংক সেসময়ের পুরো বঙ্গ রাজ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবু ওবাংলার ইতিহাসের একজন খুবই গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি হয়ে আছেন শশাংক।

শশাংক যখন ক্ষমতায় বসেন তার বিশ বছর আগে ৫৭০ খ্রি. মানব জাতীর ইতিহাস বদলে দেয়া আরেক মহামানবের জন্ম হয় মক্কায়। তিনি হলে ইসলামের প্রধান ব্যক্তি মহানবী মুহাম্মদ (সা.)।

 যদিও শশাংকের ক্ষমতা গ্রহণ ও মৃত্যুর তারিখ নিয়ে দ্বিমত আছে। তবু কারো মতে ৫৯০ সাল, কারো মতে ৬০০/৬০৬ সালে তিনি ক্ষমতায় বসেন। আর তার মৃত্যু হয় ৬৩৮ সালে। মহানবীর মৃত্যুর (৬৩২) কাছাকাছি সময়। শশাংকের  মৃত্যুর ৬০০ বছর পর তার এই বাংলা মুসলমানদের দখলে চলে যায়।

কে এই শশাংক? 

শশাংকের বংশ পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারো কারো মতে তার নাম ছিল নরেন্দ্রগুপ্ত। তাই তাকে গুপ্ত বংশের কোন এক বংশধর হিসেবে ধরা হয়।

আবার কিছু কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে মহাসামন্ত হিসেবে শশাংকের পরিচয় পাওয়া যায়। তাই ধরা হয় তিনি একসময় সময় সামন্ত রাজা ছিলেন পরবর্তীতে বিশাল তিনি গৌড় সাম্রায্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন।

শশাংকের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন ও কামরুপের রাজা ভাস্কর বর্মণ কতৃক দখল হয়ে যায়। বাংলা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যে তাদের শাসনও শেষ হয়। ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে এই অঞ্চলের শাসন। বিশৃংখলা দেখা দেয় পুরো বাংলায়। আবারো ১০০ বছরের বেশি সময়ের জন্য এক গভীর নেতৃত্বের সংকটে পড়ে আমাদের এই বাংলা অঞ্চল। শুরু হয় মাৎস্যন্যায় বা অরাজকতার যুগ

৪. মাৎস্যন্যায় বা অরাজকতার যুগ (৬৫০-৭৫০):  ১০০ বছর

প্রথম শক্তিশালী স্বাধীন বাঙ্গালি রাজা শশাংকের মৃত্যুর পর এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল পুরো বাংলায়। একশ বছর ধরে চলে সেই অরাজকতার যুগ।

৬৩৮ সালে শশাংকের মৃত্যুর পর রাজা হর্ষবর্ধন বাংলার কিছু অংশ দখল করেছিল। ৬৪৭ সালে হর্ষবর্ধনের মৃত্যু হলে জয়নাগ নামে এক রাজা আরো কয়েক বছর শক্তভাবে বাংলা শাসন করেছিল বলে জানা যায়। তার মৃত্যুর পর আর বড় কোন শক্তির হাতে বাংলার ক্ষমতা থাকে না।

৬৫০ থেকে শুরু হয়ে ৭৫০ সাল প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়া চলে বাংলা। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। চরম বিশৃংখলার এই সময়টিকে ইতিহাসে ‘মাৎস্যন্যায়ের যুগ’ বা অরাজকতার যুগ বলা হয়। 

সংস্কৃত শব্দ ‘মাৎস্যন্যায়ম’ মানে মাছের মতো। তখনকার সমাজে শক্তিশালী মানুষ দ্বারা নিপিড়িত হচ্ছিল গরীব মানুষেরা। ছিলনা কোন ন্যায় বিচার । সবকিছু হতো ক্ষমতাবানদের ইচ্ছেমাফিক।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ‘ মাৎস্যন্যায়’ এর ব্যাখা দেয়া হয়েছে এভাবে যে, যখন বিচারের অভাবে ক্ষমতাবানরা দুর্বলকে গ্রাস করে, মানে অনেকটা মাছের রাজত্বের মতো, যেখানে বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে।

বাংলায় প্রায় একশ বছর ব্যাপি তেমনি এক অরাজক আর বিচারহীনতার সময় এসেছিল। গোটা দেশে কোন কেন্দ্রিয় রাজা ছিল না। প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, ব্রাক্ষ্ণণ, সম্ভান্ত লোক, কিংবা বড় ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ এলাকা কিংবা আশেপাশে এলাকা শাসন করতে শুরু করেছিলেন নিজের ইচ্ছেমতন। গরীর আর দুর্বলরা হয়ে পড়েছিলেন চরম অসহায় । বাংলার ইতিহাসে  ছিল এ এক চরম হতাশা আর নৈরাজ্যের যুগ।

মাৎস্যন্যায়ের যুগ শেষ হয় ৭৫০ সালে। পাল বংশের প্রথম রাজা গোপালের ক্ষমতায় বসার মধ‍্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে । এরপর বাংলা প্রায় ৪০০ বছর শক্তিশালী পাল রাজাদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে । চরম হতাশা আর অন্ধকার সময় কাটিয়ে বাংলা আবারো এক বিশাল শক্তিশালি সম্রাজ্যে পরিনত হয়।

৫. পাল বংশ (৭৫০ -১১৬২) ৪১২ বছর

বাংলায় অরাজক অবস্থার সমাপ্তি ঘটে গোপাল নামক এক শক্তিশালী রাজার আগমনের মধ্যে দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাল বংশের শাসন। তার ক্ষমতায় আসা নিয়ে নানা কিংবদন্তি চালু আছে। আবার কারো কারো মতে গোপাল ইতিহাসের প্রথম রাজা যিনি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন। অবশ্য এই তথ্য নিয়েও দ্বিমত পোষণ করেছেন কোন কোন ইতিহাসবিদ।

দীর্ঘ একশ বছরের অরাজকতা ও বিশৃংখল অবস্থার উন্নতি ঘটান গোপাল। ৭৫০ সালে গোপালের ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলা আবারো এক শক্তিশালী শাসক দ্বারা পরিচালিত হতে শুরু করে।

গোপাল কত বছর শাসন করে তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ বই  থেকে জানা যায় তিনি ২৭ বছর শাসন করেছেন। ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে তিনি ২০-৩০ বছর, আর  বৌদ্ধ পন্ডিত লামা তারানাথের মতে গোপাল ৪৫ বছর, শাসন করেছিলেন বাঙলা। তার মৃত্যুর সময়কাল নিয়েও দ্বিমত আছে। কেউ বলে ৭৭০ কেউ বলে ৭৯৫ সালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন বাংলার এই অসামান্য রাজা্।  

গোপালের ছেলে ধর্মপাল ও নাতি দেবপালের সময় পাল বংশের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ে। ৮৫০ সালে দেবপালের মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্য ভাঙ্গতে শুরু করে। 

প্রথম মহীপাল ৯৮৮ সালে এসে আবারো পাল সাম্রাজের পুন:প্রতিষ্ঠা করেন। গজনীর সুলতান মাহমুদ বারবার ভারত আক্রমনের ফলে উত্তরে রাজশক্তি গুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেসময় পালদের শক্তিও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে।

পাল সম্রাটেরা ছিলেন বৌদ্ধ। আর প্রজারা ছিলেন হিন্দু। ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে রাষ্ট্রের নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন রাজা ধর্মপাল। মহীপালের সময় বাংলার বিভিন্ন স্থানে দীঘি খনন ও নগর নির্মাণ হয়েছিল। পাল আমলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার যে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল তা সেন বংশের সময় নষ্ট হয়ে যায়।

দ্বিতীয় মহিপালের (১০৭৫-১০৮০)  সময় নাটোরে জেলে সম্প্রদায়ের কিছু বাঙ্গালী বিদ্রোহ করে বসে। ১০৮০ সালের এই বিদ্রোহ ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ বা ‘বরেন্দ্র বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ এমনকি ভারতবর্ষের প্রথম সফল বিদ্রোহ ছিল এটি। পাল রাজারা ধর্মীয় কারনে মাছ মাংস খাওয়ার বিরোধী ছিলেন। এই নিয়ে জেলে সম্প্রদায়ের মানুষের উপর নির্যাতন করতো পাল রাজারা। ফলোশ্রুতিতে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করে। মাত্র দুবছরের মধ্যেই এর সমাপ্তি ঘটে। ক্ষমতায় বসেন রামপাল।

ধর্মপালের সময় পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার নির্মাণ ছিল এক অসামান্য কাজ। শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল পাল যুগে। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বিশ্বের বহু দেশে শিক্ষা ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়েছিলেন। 

রামপালই ছিলেন সবশেষ শক্তিশালী পাল রাজা যিনি ক্ষমতা ছিলেন ৪০ বছর। ১০৮২ খেকে ১১২৪ পর্যন্ত। এরপর আর চারদশক কোনরকমে টিকে ছিল পাল শাসন। প্রায় সতের পুরুষ ধরে চারশো বছরের বেশি সময় ধরে চলে এই বংশের শাসন। এত দীর্ঘ সময় ধরে এক বংশের রাজ্য শাসনের ঘটনা ইতিহাসে নাই। 

সন্ধাকর নন্দীর ‘রামচরিতম‘ কাব্য লিখা হয় সম্রাট মদনপালের সময় (১১৪৪-১১৬২)। পাল বংশের শেষ রাজা গোবিন্দ পাল ১১৬২ সালে রাজ্য হারা হন। পাল যুগ শেষে  বাংলায় শুরু হয় সেন বংশের শাসন।

৬. সেন বংশ (১০৭০-১২৩০) ১৬০ বছর

পাল বংশের শেষ দিকের রাজারা শক্তিতে দূর্বল হয়ে পড়ে। এর সুযোগে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট ছোট স্বাধীন রাজার উদ্ভব হয়। সেনেরা কিভাবে দক্ষিণভারত থেকে বাংলায় এসে শাসন শুরু করে তার ইতিহাস অস্পষ্ট।

তবে ধারণা করা হয় সেন বংশের প্রথম ঐতিহাসিক ব্যক্তি সামন্ত সেন ১০৭০ সালে প্রথমে ছোট একটি রাজ্য দিয়ে শাসন শুরু করেছিলেন। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের মহীশুর কর্নাটক অঞ্চল থেকে এসেছিলেন এই যোদ্ধা মানুষটি। তারই পরবর্তী বংশধরেরা ধীরে ধীরে বাংলায় বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।যা চলে ১৬০ বছর ধরে।

সামন্ত জন্মের আগেই সেন বংশের কোন একজন বাংলা অঞ্চলে এসে বসতি গড়েছিলেন।সামন্তর ছেলে হেমন্ত সেনের সময় রাঢ়ে ক্ষমতা অধিকার করেছিল সেনবংশ। হেমন্ত সেনকেই সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ধরা হয়।

হেমন্তর ছেলে বিজয় সেন ছিলেন সেন বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। বিজয় সেন ৬২ বছর শাসন করেন (১০৯৭-১১৬০)। তার প্রতিষ্ঠিত সেন বংশ একশ বছর টিকে ছিল।

বিজয় সেনের ছেলে বল্লাল সেন ১৮ বছর শাসন করেন। তিনি ছিলেন লেখক মানুষ।’দানসাগর’ কাব্যটির লেখা শেষে তিনি ‘অদ্ভুতসাগর’ নামের আরো একটি লেখায় হাত দেন।  তবে তার জীবনদশায় তা শেষ করে যেতে পারেননি।

বল্লালের ছেলে লক্ষণ সেন ক্ষমতায় বসে ১১৭৯ সালে। তখন তার বয়স ৬০ বছর। বৃদ্ধ বয়সে ক্ষমতায় বসে তিনি বাবার অসমাপ্ত ‘অদ্ভুতসাগর’ কাব্যগ্রন্থটি লিখা শেষ করেন।

সেনেরা সবাই ছিলেন শৈব ধর্মের অনুসারি। তবে শেষ রাজা লক্ষণ সেন বৈষ্ণব ধর্মে আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ১২০৪ সালে বাংলার উত্তরাঞ্চল দখল করেন। তখন আশি বছরের বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেন বিক্রমপুরের দিকে চলে যান। তিনি সর্বশেষ শক্তিশালী সেন রাজা। মুসলমানদের বাংলা জয়ের ২৫ বছর পরও কয়েকটি  অঞ্চলে সেনরা ক্ষমতায় টিকে ছিল। 

সেন শাসনের আগে বাংলায় হিন্দু, বৌদ্ধরা শান্তিপুর্ণ সহ অবস্থান করেন। সেনরা ক্ষমতায় আসার পর এই অঞ্চলে হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান ঘটে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার প্রসার কমতে শুরু করে। ফলে বৌদ্ধরা এই দেশ ছেড়ে নেপাল ভুটান চীনের দিকে চলে যেতে থাকে।

বখতিয়ার খলজি এবং লক্ষণ সেন মারা যান একই বছর ১২০৬ সালে।সেন বংশের শাসন পুরোপুরি বিলুপ্তি হয় ১২৩০ সালে। কারো কারো মতে এটি ১২৪৫ সাল।সেন যুগের মধ্য দিয়েই শেষ হয় বাংলার ক্লাসিক যুগ। ১২০৪ ক্ষমতায় আসেন মুসলমানেরা। শুরু হয় মধ্যযুগ।

পারভেজ সেলিম

লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী

আরো পড়ুন :

১৩১ thoughts on “ধ্রুপদী বাংলার সাড়ে বারোশ বছরের ইতিহাস

  1. Today, I went to the beachfront with my children. I found a sea
    shell and gave it to my 4 year old daughter and said “You can hear the ocean if you put this to your ear.” She put the shell to her ear and screamed.
    There was a hermit crab inside and it pinched her ear. She never wants
    to go back! LoL I know this is completely off topic but I had to tell someone!

  2. 84182 695721Nice post. I be taught one thing much more challenging on entirely different blogs everyday. It will all the time be stimulating to learn content from other writers and apply slightly one thing from their store. Id desire to use some with the content on my weblog whether you dont mind. Natually Ill give you a hyperlink on your net blog. Thanks for sharing. 407717

  3. Pingback: BAUC
  4. Good day I am so thrilled I found your web site, I really found you
    by error, while I was looking on Google for something else,
    Anyways I am here now and would just like to say thank you for a fantastic post and a all round entertaining blog (I
    also love the theme/design), I don’t have time to go through it all at the moment but I have bookmarked it and
    also included your RSS feeds, so when I have time I will be back to read a great deal
    more, Please do keep up the superb job.

  5. сонник уколы красоты колесо фортуны таро какой аркан сатурн во включенном знаке, включенный знак
    скорпион сонник закрывать дверь на ключ а
    она не закрывается, сонник закрыть
    дверь на ключ изнутри кошачьи
    усы в косметологии, кошачьи
    усы в кошельке

  6. обозначения карты инферно знаменитости с 17
    арканом 12 на входе в денежный канал,
    вход в денежный канал 6 когда молодой месяц в апреле музыкальный приворот все части, музыкальный приворот подарочное издание

  7. стадион строитель воронеж изготовление стеклопакетов старый оскол прием картриджей в омске
    ао мпз муром официальный сайт расписание автобусов по ст волгоград волгоград
    или саратов где лучше жить

  8. порча по фото кипятить гадание на воске черный воск, гадание
    на воске значение фигур по алфавиту сколько часов длится день на марсе,
    сколько длится день на юпитере
    заговор на уговор человека к чему видеть
    на часах 12 21

  9. фамилия обертас происхождение сонник
    толкование снов ходить в туалет по большому видеть во сне дочь в красивом
    платье, видеть во сне дочь в красном
    платье
    приснилось плавать в чистом море к чему снятся трупы людей в доме

  10. женщина скорпион кому подходит по гороскопу что дальше гадание яндекс дзен молитва навстречу гроб несут
    приснилась измена парня к чему с пятницы на субботу к чему
    снится есть рассольник

  11. однакові цифри на годиннику значення 1133 наснилася каламутна
    вода з хвилями
    обертання галактики доповідь, до якого типу
    галактик належить велика магелланова хмара 1919 ангельська нумерологія
    на годиннику значення дорин

  12. учет эдо в 1с, электронный документооборот рк әбіш кекілбаев сабақ
    жоспары, аңыздың ақыры ұлттық құндылықтар
    онкологиялық науқастарға мейіргерлік күтім, қатерлі ісіктер кезіндегі мейіргерлік күтім куз келгенде балалар текст,
    күз туралы өлең

  13. неліктен өлген адамның үйге оралғанын армандайсыз?
    ип налог тексеру, узнать сумму налога на имущество по инн энергия үнемдеу шаралары,
    мектепте энергия үнемдеу жобасы
    мақал мәтелдердің маңызы деген тақырыпта ойыңды жаз, мақал дегеніміз не

  14. новая мечеть астана как доехать,
    маршрут 43 автобуса астана орал мұғалжар,
    мұғалжар өзен көлдері мен мен мен едім өлеңінің стильдік
    ерекшелігі, мен мен мен едім өлеңінің идеясы 38 апта
    жүрек айну, 38 апта выделение

  15. толық емес отбасы презентация, қазіргі қоғамдағы отбасы презентация ғазірет ержанов, газрет ержанов год рождения өзін өзі басқару ұғымы, мектептегі өзін өзі басқару әке
    туралы еске алу сөздері, әкеге сағыныш еске алу
    скачать

  16. кәсіпкерліктің формалары, қр дағы кәсіпкерлік түрлері
    мен нысандары елорда даму объекты,
    елорда даму контакты әнұран ескі,
    әнұран терминінің өзі нені білдіреді бесплатная яндекс музыка, яндекс плюс за 99 тенге

  17. бурабай қайда орналасқан, бурабай флорасы мен фаунасы білім беруді демократиялық басқару моделі, білім берудегі басқару
    ұғымы презентация компания мастер лодок,
    мир лодок астана катарский риал к тенге, купить катарский риал

  18. инклюзив дене шынықтыру, дене шынықтыру және спорт педагогикасы слайд huawei
    freebuds 4i не видит приложение, huawei freebuds 4i
    приложение скачать лакосте парфюм женский, lacoste духи цена стиральная машина wwd120wcs white edition, стиральная
    машина miele wwd120wcs отзывы

  19. вайфай астана, безлимитный интернет для дома права работающей матери с ребенком до 3 лет в рк, перевод беременной на легкий
    труд рк жасанды талшықтар мен синтетикалық талшықтардың айырмашылығы, жасанды талшықтар туралы мәлімет танцы в алматы для детей, школа танцев для взрослых

  20. обучить нейросеть онлайн, курс по нейросетям слив
    5 зертханалық жұмыс 10 сынып биология, биология 10
    сынып 5 зертханалық жұмыс жауаптары электрический духовой шкаф
    gorenje bsa6737e15x отзывы, gorenje 6737 заңгер слайд, заңгер оқу орындары алматы

  21. машиналық оқыту тәсілдері, машиналық
    оқыту жіктеу қазақстандағы машина жасау өнеркәсібі, қазақстандағы машина жасау зауыты школа жании аубакировой отзывы,
    школа жании аубакировой стоимость генетикалық есептер 9 сынып,
    биология есептер шығару 9 сынып

  22. Undeniably believe that that you stated. Your favourite reason appeared to be on the
    internet the simplest factor to bear in mind of.
    I say to you, I definitely get irked at the same time as other folks think about concerns that they plainly don’t know about.
    You managed to hit the nail upon the top and defined out the whole thing with no
    need side effect , people can take a signal. Will likely be again to get more.
    Thanks

  23. до какого времени можно делать
    ремонтные работы дома заработок в
    интернете с выводом на карту онлайн в какие игры можно играть чтобы заработать реальные деньги
    без вложений ремонтные работы в доме разрешены

  24. темір жол сигналдары, темір жол габариттері су
    апаты таралған аймақтар, су тасқыны
    салдары онкологиялық жаңа түзілулердің пайда болуы творчество блока для
    детей, раннее творчество блока кратко

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x