পারভেজ সেলিম ।।
‘ডুব’ আমার দেখা ফারুকীর শ্রেষ্ট সিনেমা। বাংলাদেশে এমন সিনেমা অবশ্যই আর একটিও নেই ! অনেক ক্ষেত্রে এটাই প্রথম !
তবে এই সিনেমা সবার পছন্দ করার সিনেমা না। এটা যার ভালো লাগবে তার শ্রেষ্ট মনে হবে, আবার কারো খুবই বাজে লাগবে। মাঝামাঝি ভালোলাগার সিনেমা এটি নয় । আমার ভালো লেগেছে ।
সিনেমাটোগ্রাফির পরতে পরতে মুগ্ধতা !! ইরফানের ‘কেমন আছো বাবা’ ডায়লগের ক্লোজ আপ, বাংলা সিনেমায় দেখা শ্রেষ্ট ক্লোজআপ শট! যদিও ল্যান্ডস্কেপ লং শটগুলোতে কিয়ারোস্তামির গন্ধ পাওয়া যায় !
এছাড়া বৃষ্টির দৃশ্য, গাড়ীর কাঁচে ছায়া সহ জাবেদের মুখ, রিসোর্টে যাওয়া আসার লং টপ শট, মেঝেতে ছায়া দোলানোর দৃশ্য কিংবা গাড়ীর ভিতর নিতুর মোজাপরা পা, অসাধারণ সব শটে মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায়।
জটিল সম্পর্কের সিনেমা ডুব! ফারুকী সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সিনেমা বানান কিন্তু সম্পর্কের এমন জটিলতা নিয়ে বড্ড ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি !! শিল্পে নতুন রাস্তা মানেই ঝুঁকি ! জনপ্রিয় হবার পথ সংকীর্ণ হওয়া।
জাবেদ চরিত্রটা নিতুর প্রেমে পড়লো কেন? কিসের টান যার জন্য এতকিছু ? প্রথমদিকে টিফিন ক্যারিয়ারে জাবেদের জন্য খাবার পাঠাতে দেখি, শেষের দিকে নিতুকে জড়িয়ে ধরার আগেও সে জাবেদকে জিজ্ঞেস করে কিছু খাবে কিনা? আবার জাবেদ যখন নয়নতারার দরজা মুখের উপর বন্ধ করে দেয় নিতু দরজার ওপার থেকে জিগায় কিভাবে একা বাসায় থাকবে, তার তো গ্যাস্টিকের সমস্যা!
শুধু পেটের খবর রাখে বলে জাবেদ-নিতুর সম্পর্ক তৈরি হয় এটা মেনে নেয়া কঠিন !! তার চেয়ে দেয়াল টপকে নিতু যেদিন নয়নতারায় আসে সেদিন তাদের সিগারেট শেয়ার করে খাওয়াটাই অনেক বেশি যৌক্তিক মনে হয় এই অসম বয়সি সম্পর্কটি তৈরি হবার কারণ হিসেবে।
সম্পর্কের নির্ভরতার কারণটি এখানে প্রকাশ করেন না পরিচালক । আর তাতে নিতু চরিত্রটি অহেতুক নেতিবাচক হয়ে ওঠে। চরিত্রটির প্রতি এমন অবহেলা দর্শককে তাই বিষণ্ণ করে ।
শুধু নিতু- জাবেদ নয় জাবেদ- সাবেরি, কিংবা মায়া -জাবেদ, সাবেরি-মায়া সম্পর্কগুলোর দৃশ্যায়ণ গভীরে পৌঁছায় না। যারা হুমায়ূন আহমেদের জীবন জানে তাদের জন্য কিছুটা নিজের কল্পনা দিয়ে এই গল্প মেলানো সহজ কিন্তু যারা জানেনা তাদের অজানা এই গল্পের পুরোটা ধরতে পারা মুশকিল ।এটাই প্রধান সংকট ডুব সিনেমার, তবু ডুব একটা বিশেষ সুর নিয়ে বাজে মগজে!
সঙ্গীতে পূর্বের দূর্বলতা কাটিয়েছেন ফারুকী। অসাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবারের সিনেমায় । যদিও গানটি কানে লাগে! তবু ফারুকী জানান দিচ্ছে তিনি নতুন এক অধ্যায়ে তাকে যুক্ত করছেন। নিজেকে নতুন রুপে হাজির করেছেন ফারুকি ।
জাবেদের পেশা কি ভিজুয়ালি বোঝা যায় না তাই বোধের মধ্যে স্পষ্ট হয় না তার সংকটের বিস্তৃতি ।
মৃত্যু পরের দৃশ্যসমুহ ভালো লাগেনি, লাশের পিছনে শুধুমাত্র তরুণদের দেখে,লাশের পাশে বসে সাবেরির কান্নার সাথে ডায়লগ অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। তবে মৃত্যুর সংবাদ পাবার পর মা-মেয়ের স্বাভাবিক আচরণের দৃশ্যায়ণ সত্যি ইউনিক !
ইরফানের সহজ অভিনয় দারুণ! তার বাংলাদেশি উচ্চারণ এত ভালো আশা করিনি। তিশা, প্রাচী, পার্ণো ভালো তবে একটাও ডায়লগ না বলা দারোয়ান চাচা অসাধারণ!!!
ডুব! আহা! বাংলাদেশের সিনেমা ! ফারুকী আপনি এরকম একটা সিনেমা বানিয়ে কেন এত চিৎকার করলেন ! কিসের ভয়ে? কেন আপনি মানুষকে নিঃশব্দে সিনেমাটির প্রেমে পড়তে দিলেন না ! শুধু সিনেমার গুণে তার পাশে এসে বসতে দিলেন না ! আপনার চিৎকার আর চেঁচামেচিতে ‘ডুব’ সিনেমাটি অসম্মানিত হয়েছে। নিজের সন্তানের উপর আপনার ভরসা এত কম ছিল কেন? কোন কথা না বলে আপনি যদি নিজে সতিকারের ডুব দিতেন তাহলে আরো অনেক দর্শক এই সিনেমায় ডুব দিয়ে আনন্দ পেতো। আপনার ‘ডুব’ নিয়ে অহেতুক চিৎকার নেতিবাচক ধারণাকে প্রবল করেছে ।
সৃষ্টির পর স্রষ্টার এত ব্যাখা দিতে নাই, কথা বলতে নাই, তাতে শিল্পটি অসম্মানিত হয় ।
তার চেয়ে সৃষ্টির পর নিজেই ডুব দিন, দর্শকের উপর সম্মানের সহিত ভরসা রাখুন। তাদেরকেই ভালো মন্দ বিচারের ভার দিন এবং তা মেনে নিন ! সবাই পছন্দ করেনা, কেউ কেউ করে ! যারা অপছন্দ করছে তাদেরকেও সম্মান করুন ।
জয় হোক বাংলা সিনেমার ।
One thought on “ডুব : ফারুকীর শ্রেষ্ঠ সিনেমা !”
Comments are closed.