বেহেস্ত হতে বিতাড়িত হল মানুষ। পৃথিবীর বুকে নেমে ঘুরতে লাগলো ভবঘুরের মতো। একা ও নিঃসঙ্গ। দুই প্রান্তে দুজন কত বিষন্ন সময় যে পার করেছেন তার সঠিক কোন তথ্য কোথাও নাই। তারপর আদি পিতামাতার মিলন হলো হঠাৎ কোন একদিন। বিশ্বাসীদের মতে,পৃথিবীতে মানুষের পদচারণা শুরু হলো আদম হাওয়ার হাত ধরে।
‘অ্যাডমস পিক’কে যদি আদমের পায়ের ছাপ হিসেবে মেনে নেই, তাহলে বর্তমান শ্রীলংকায় নেমেছিল মানুষের আদি পিতা। আর আরবের তপ্ত মরুভুমির এক ময়দানে নি:সঙ্গ ঘুরছিলেন তার পাঁজর থেকে বানানো প্রিয় সঙ্গী বিবি হাওয়া।
আদম-হাওয়ার আবারও পরিচয় ঘটে নতুন পৃথিবীতে আরবের মাটিতে। মক্কার সেই ময়দানের নাম তাই হয় আরাফা বা পরিচয়ের ময়দান। কুরাআনে এসব স্থানের কোন নাম উল্লেখ নেই। সবই তাফসীরের গল্প।
তবু আদম হাওয়ার দেখা হয়ে গেল। পুরাতন বেহেস্তি প্রেমে তাদের হৃদয় আবারও ভরে উঠলো। গন্ধম ফল খাবার শাস্তি বুঝি এবার কিছুটা কমলো। মিলন হলো মুসলমানের আদি পিতা মাতার।
এর আগের গল্পে দেখা যায়, শয়তান তার কাজে সফল হয়েছে। স্রষ্টার সাথে চ্যালেঞ্জ করে মানুষকে স্বর্গ ছাড়া করেছে। এখন মানুষ, শয়তান আর স্রষ্টার চিরন্তন দাবা খেলা শুরু হয়েছে বিশাল শুন্য, রিক্ত জনমানবহীন মহাপৃথিবীতে।

গল্পে পাওয়া যায়, পৃথিবীর আদি মানব মানবী যখন প্রথম সন্তান জন্ম দেন তারা ছিল এক জমজ। এক ছেলে এক মেয়ে। নাম কাবিল ও ইক্লিমা।
এরপর প্রতিবার জোড়ায় জোড়ায় জন্ম দিতে থাকেন তারা। দ্বিতীয়বার জন্ম নেয় পুত্র হাবিল ও জমজ কন্যা লুবুদা।
কাবিল, হাবিল ও তার বোনেরা যখন ধীরে বড় হতে থাকলো তখন আরো অনেক মানব সন্তানে পৃথিবী ভরে উঠতে শুরু করেছে বলে ধরে নেয়া যায়। সন্তানেরা যখন বড় হলো তখন তাদের সঙ্গী বেছে নেবার সময় হলো। বিপত্তি শুরু হলো তখনই।
শর্ত ছিল ছেলেরা নিজের জমজকে নয়, সঙ্গী হিসেবে বেছে নেবেন অন্য জমজ বোনকে। মানে হাবিলের সঙ্গী হবেন ইক্লিমা আর কাবিলের সঙ্গী হবেন লুবুদা। আর এতেই বাধ সাধলো কাবিল।
গল্পে এর কারণ হিসেবে বলা আছে, কাবিলের চোখে খুব সুন্দর ছিলেন না লুবুদা। তার চোখে পছন্দের নারী ছিল নিজের বোন ইক্লিমা। তাই কাবিল নিজের জমজ বোনকেই সঙ্গী হিসেবে চায়। তবে হাবিল আল্লাহ নিয়ম ভাঙ্গতে নারাজ। শুরু হলো দুই ভাই এর দ্বন্দ।
দুই ভাইয়ের এমন দ্বন্দের সমাধানে এগিয়ে আসেন পিতা আদম। আল্লাই এর সমাধান দেবেন এবং তাদের দুজনকে মানতে হবে আল্লাহর নির্দেশ। দুইপুত্রকে আল্লাহর উদ্দেশ্য কুরবানী দিতে আদেশ দিলেন প্রথম মানব। বললেন, যার কুরবানী আল্লাহ কবুল করবেন তার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। এই হলো ন্যায় ফয়সালা।
কাবিল ছিলেন কৃষক। অনেক কিছু্ চাষ করতেন। কৃষি, ফলমুল সব। তার উৎপাদিত ফলমুল তিনি আল্লাহ উদ্দেশ্য কুরবান করলেন। গল্পে বলা আছে, কুরবানীতে কাবিলের আন্তরিকতা ছিল না, ছিল অনাগ্রহ আর উৎসর্গকৃত ফলমুল ছিল নষ্ট ও পঁচা।
অন্যদিক হাবিল ছিলেন পশু প্রেমী যুবক। তার প্রিয় পশুকে তিনি আল্লার উদ্দেশ্যে কুরবানী করেছিলেন আন্তরিকতা আর আল্লাহ সন্তুষ্টি লাভের নিয়তকে সঠিক রেখে।

গল্পে আরো জানা যায়, কুরবানী কবুল করার প্রমাণ স্বরুপ তখন আকাশ থেকে আগুনের গোলা নেমে আসতো। কাবিলের কুরবানীর পর আকাশে কোন কিছুর চিহ্ন পাওয়া গেল না। কিন্ত হাবিল কুরবানী দেবার পর আকাশ ভরে নেমে এলো আগুনের গোলা। সকলে নিশ্চিত হলো স্রষ্টা কবুল করেছেন হাবিলের কুরবানী।
জয়ী হলেন হাবিল। হেরে গেলেন কাবিল। আল্লাহর এমন বিচার পছন্দ হলো না কাবিলের। বিদ্রোহ করলেন তিনি। পৃথিবীর বুকে প্রথম আল্লাহর আইনকে অমান্য করলেন কাবিল। ঈর্ষায় ডুব দিয়ে খুন করে বসলেন হাবিলকে। পাথর দিয়ে মাথায় এক আঘাতেই শেষ হলো পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়া প্রথম মানব সন্তানের জীবন। পৃথিবীর প্রথম মৃত্যুই প্রথম হত্যাকান্ড।
এখন এই মৃত ভাইকে নিয়ে কি করবেন তিনি! মৃত্যুর পর কি করতে হয় তারও কোন উপায় জানা নাই কারো কাছে। এটাই যে পৃথিবীর প্রথম মৃত্যু।
হঠাৎ দুরে এক কাককে দেখতে পেলেন কাবিল। সেখানে মাটি গর্ত করে আরেকটি মৃত কাককে মাটি চাপা দিতে দেখলেন তিনি।
কাবিল তার মৃত ভাইকে একইভাবে গর্ত করে মাটি চাপা দিলেন। মাটির বুকে ফিরে গেল পৃথিবীর প্রথম সন্তান। রচিত হলো মানুষের প্রথম কবর।
এরপর কাবিল অনুশোচনা দগ্ধ হতে থাকলেন। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চষে বেড়ালেন নিজের ভাইকে খুন করার অপরাধবোধকে প্রশমিত করতে। একসময় তারও মৃত্যু হলো। কারো মতে স্বাভাবিক মৃত্যু, কারো মতে সন্তানের হাতে খুন হয়েছিলেন কাবিল। ততদিনে আদমের সন্তানেরা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পৃথিবীময়।

গল্পের পরের গল্প :
কুরআনের ৫ নম্বর সুরা মায়িদা । আয়াত ২৭-৩৩ । যেখানে আদমের দুই সন্তানের এই গল্পের কথা বলা আছে। তারা দুজনে কুরবানী করেছিলেন। একজনের কুরবানী কবুল হয়েছিল, আরেকজনেরটা হয়নি। তখনই একজন আরেকজনকে হত্যা করে।
হাবিল বলেছিল, ‘তুমি খুন করার জন্য হাত তুললেও আমি হাত তুলবো না, কারন আমি সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করি’। তারপর ভাইকে হত্যা করলো কাবিল।
এরপর আল্লাহ কাক পাঠালেন ভাই এর লাশ কিভাবে গোপন করা যায় তা দেখানোর উদ্দেশ্য । তা দেখে কাবিল অনুতপ্ত হলো ‘হায় আমি কি কাকের মতো হতে পারলাম না যে ভাই এর লাশ গোপন করতে পারি”।
এই গল্প বলার পর নির্দেশ দিচ্ছেন আল্লাহ , ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করা ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করলো’।
হত্যা কখন জায়েজ আল্লাহ তার ব্যাখাও দিয়েছেন কুরআনে, ‘যারা আল্লাহ ও রসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ও পৃথিবী ধ্বংসের কাজ করে তাদের হত্যা করা জায়েজ’। তবে কেউ যদি আগেই তওবা করে নেয় তবে তাদের মাফ করে দিয়েছেন আল্লাহ।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কুরআনে পৃথিবীর প্রথম হত্যাকান্ডের কারন বোনকে বিয়ে করা নিয়ে নয়! কুরবানী কবুল হওয়া, না হওয়ার ঈর্ষা বা মনোকষ্ট নিয়ে। আর ভাই এর লাশ দাফন করতে না পারার অনুশোচনা নিয়ে।
আর এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কুরআনে বলা আছে, শর্তসাপেক্ষে হত্যা জায়েজ। যদিও এখানে দেখা যায় যে, আল্লাহকে ভয় করা হাবিলই খুন হলেন আল্লার আদেশ না মানা কাবিলের হাতে।
তাহলে কুরআনে যা নাই সেই গল্প কিভাবে এলো ইসলামের এমন গুরুত্বপূর্ন বয়ানে?
বোনকে বিয়ে করা নিয়ে দ্বন্দের এই বয়ান এসেছে তাফসীর গ্রন্থগুলো থেকে, যেমন ইবনে কাছির, তারাবি এসব গ্রন্থ থেকে। কুরআনে কুরবানী, ঈর্ষা ও হত্যা এসব আছে। সুন্দরী বোনকে বিয়ে করার জন্য হত্যার গল্প তাই মানুষের বানানো। এমনকি এই গল্প বাইবেলেও নাই ।
তাদের পেশা মানে হাবিল যে কৃষক আর কাবিল যে পশুপালক তা কি আছে কুরআনে ? না তাও নাই। এটা এসেছে বাইবেল থেকে। সেখানে ‘এবেল’ ভেড়া দেখাশোনা করতো আর ‘কাইন’ করতো কৃষিকাজ। যা পরে ইবনে কাছির ও তারাবির গ্রন্থে যুক্ত হয়ে ইসলামী বয়ান তৈরি করেছে।
এমনকি আদমের পুত্রদ্বয়ের নাম যে হাবিল-কাবিল তাও উল্লেখ নাই কুরআনে। শুধু বলা আছে আদমের পুত্রদ্বয়।
স্থান, কাল, নাম এমনকি দ্বন্দের স্পষ্ট কারণ উল্লেখ নাই কুরআনে। তবু হাবিল কাবিলকে নিয়ে ইসলামে একটি পরিপুর্ণ বয়ান প্রচলিত আছে কুরআনকে ঘিরে।
তবুও কুরআন, বাইবেল ও তাফসীর তিনটির বয়ানই এমন বার্তা দেয় যে, নিয়ত যদি বিশুদ্ধ না হয়, তবে ইবাদত কবুল হয় না। হিংসা মানুষকে এমন অপরাধে ঠেলে দেয়, যার পরিণতি হয় ভয়াবহ। সহিষ্ণুতা ও আল্লাহভীতি হচ্ছে একজন মানুষের আসল পরিচয়। আর অন্যায়ভাবে হত্যা মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অপরাধ।
হাবিল ও কাবিল মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যাকাণ্ডের বয়ান। কিন্তু এই ঘটনা শুধু দুই ভাইয়ের লড়াই নয়, বরং মানুষের ভেতরের হিংসা, ঈর্ষা আর সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের প্রতীক হিসেবে দেখলে এর মর্মার্থ উজ্জল হয়ে উঠে।
পারভেজ সেলিম
লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী