পৃথিবীর ইতিহাসে কিছু জীবন আছে, যা ব্যথার সমুদ্র পেরিয়ে পরিণত হয়েছে আকাশচুম্বী মানবতার মশালে। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ঠিক তেমনই এক ইতিহাস যেখানে আপনজন হারানোর নির্মম দুঃখ, সীমাহীন ত্যাগ ও অমিত ধৈর্যের এক অনুপম দৃষ্টান্ত রচিত হয়েছে
তাঁর জীবন কেবল নবুয়ত ও বিজয়ের কাহিনি নয়, বরং একের পর এক আপনজন হারানোর বেদনার মধ্যেও ঈমান ও ধৈর্যের অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত।
শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত — মৃত্যু, বিদায় আর বিচ্ছেদের ধারাবাহিক আঘাত তাঁর জীবনসঙ্গী হয়েছিল। তবুও তিনি ছিলেন স্থির, অটল, ঈমানের শিখরে দীপ্তিমান।
জন্মের আগেই প্রথম বিরহ: পিতৃবিয়োগ
হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায়। তাঁর জন্মের আগেই, যখন তাঁর মা আমিনা (রা.) গর্ভবতী, তখনই পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইয়াসরিব (বর্তমান মদিনা) সফরের সময় অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মুখ কখনোই দেখতে পাননি রাসূল (সা.)। তাঁর জীবন শুরু হয় এক গভীর শূন্যতা নিয়ে।

শৈশবে আপনজন হারানোর মিছিল
৬ বছর বয়সে (৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ): মা আমিনা (রা.)-এর মৃত্যু ঘটে আবওয়ার পথে, মদিনা ফেরার সময়। ৮ বছর বয়সে (৫৭৮ খ্রিস্টাব্দ): দাদা আবদুল মুত্তালিব ইন্তেকাল করেন, যিনি মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর অভিভাবক ছিলেন।এভাবে ছোট্ট মুহাম্মদ (সা.) শৈশবেই তীব্র একাকীত্বের স্বাদ পান।

যৌবনের প্রারম্ভে সন্তানের শোক
বয়স যখন ত্রিশের কোটায়, খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহিত জীবনে তাঁর দুই পুত্র কাসিম ও আবদুল্লাহ (পৃথিবী ছাড়ার আগে ‘তাহির’ বা ‘তাইয়্যিব’ নামেও পরিচিত) জন্মগ্রহণ করে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে তারা শৈশবেই ইন্তেকাল করে। নবীজি (সা.) তখন ৩০-৩৫ বছরের মধ্যবর্তী বয়সে ছিলেন।
নবুয়তের দায়িত্বের পাশাপাশি হৃদয়বিদারক শোক
৪০ বছর বয়সে নবুয়তের মহান দায়িত্বের ভার কাঁধে ওঠে। এরপর থেকে তাঁর জীবন শুধু দ্বীনের দাওয়াত নয়, একের পর এক আপনজন হারানোর কষ্টেও ভরা ছিল।
৬১৯ খ্রিস্টাব্দে ৫০ বছর বয়সে স্ত্রী খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন। এরপর চাচা ও অভিভাবক আবু তালিবেরও মৃত্যু ঘটে।এই দুই শোকপূর্ণ ঘটনায় বছরটি ‘আমুল-হুজন’ বা ‘শোকের বছর’ নামে ইতিহাসে পরিচিত হয়।
মদিনায় নির্বাক শোক: সন্তানদের বিদায়
মদিনা হিজরতের পরও নবী মুহাম্মদ (সা.) আপনজনদের বিদায় অব্যাহতভাবে সহ্য করেছেন: ২ হিজরি/৬২৪ খ্রিস্টাব্দ(৫৪ বছর বয়সে): মেয়ে রুকাইয়া (রা.) বদর যুদ্ধের সময় অসুস্থ অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।৮ হিজরি/৬৩০ খ্রিস্টাব্দ (৬০ বছর বয়সে): বড় মেয়ে যয়নাব (রা.) ইন্তেকাল করেন। ৯ হিজরি/৬৩০-৬৩১ খ্রিস্টাব্দ (৬১ বছর বয়সে): মেয়ে উম্মে কুলসুম (রা.)-এর মৃত্যু হয়।
প্রিয় সন্তানদের একে একে হারানোর মধ্যেও নবীজি (সা.) আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও ধৈর্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
৩ হিজরি/৬২৫ খ্রিস্টাব্দ (৫৫ বছর বয়সে): উহুদ যুদ্ধের ময়দানে প্রিয় চাচা হামজা (রা.) শহিদ হন। তাঁর দেহ অবমানিত করা হয়েছিল।
নবী মুহাম্মদ (সা.) হামজার (রা.) মৃতদেহ দেখে অশ্রুসিক্ত হন এবং গভীর ব্যথায় বুক চাপড়ে কেঁদে ওঠেন।তবুও তিনি প্রতিশোধের আহ্বান না জানিয়ে মাফ ও দয়া প্রদর্শনের শিক্ষা দেন।

সন্তান ইবরাহিমের বিদায়: জীবনের শেষ আঘাত
১০ হিজরি/৬৩২ খ্রিস্টাব্দ (৬৩ বছর বয়সে): নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পুত্র ইবরাহিম ইন্তেকাল করেন মাত্র আঠারো মাস বয়সে।ইবরাহিমের মৃত্যুতে রাসূল (সা.) কাঁদলেন, চোখে অশ্রু ঝরালেন, তবুও বললেন:”চোখ অশ্রুপাত করে, হৃদয় ব্যথিত হয়। তবে আমরা মুখে শুধু তাই বলবো, যা আমাদের প্রভুকে সন্তুষ্ট করে। ইবরাহিম, তোমাকে হারিয়ে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।”— (সহীহ বুখারী)
প্রিয় স্ত্রীদের মৃত্যু
খাদিজা (রা.) এবং জয়নাব বিনতে খুযাইমা (রা.) ছাড়া বাকি স্ত্রীগণ তাঁর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেননি।জয়নাব বিনতে খুযাইমা (রা.) ইন্তেকাল করেন হিজরতের দ্বিতীয় বছরে (২ হিজরি/৬২৪ খ্রিস্টাব্দ)।
শেষ কলাম :
এত মৃত্যু, এত আপনজন হারানো সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো আল্লাহর প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেননি।
বরং প্রতিটি শোককে তিনি ঈমানের দীপ্তিতে রূপান্তরিত করেছেন, শিক্ষা দিয়েছেন কিভাবে দুঃখের গভীরতম অন্ধকারেও আলোর সন্ধান করতে হয়।
তিনি শিখিয়েছেন, দুঃখ-দুর্দশার মাঝেও মানুষের হৃদয়কে বিশ্বাসের উষ্ণতায় ভরিয়ে রাখতে হয়, কারণ আসল জীবন তো এই পৃথিবী নয় — আসল জীবন অপেক্ষা করছে চিরন্তন আখিরাতে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন এক অবিনশ্বর শিক্ষাগ্রন্থ — যেখানে লেখা আছে, শোক আসবে, জীবন বিধ্বস্ত হবে, কিন্তু ধৈর্য, দয়া ও ঈমানের দীপ্তি কখনো মুছে যেতে দেয়া যাবে না।
আপনজনের মৃত্যু যেমন তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ করেছে, তেমনি সেই হৃদয়ে জ্বলেছে বিশ্বাস, মানবতা ও অনুগ্রহের চিরকালীন প্রদীপ।
লিখাটি AI এর সহায়তায় লিখা হয়েছে। তবে কিছুটা পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা হয়েছে । ……..বিভাগীয় সম্পাদক