ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: ব্রিটিশদের ভারত দখল


ধ্রুব রাঠি


১৬৮৬ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। সে সময় ভারতের সিংহাসনে ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। এই যুদ্ধকে অনেকেই একটি বড় বোকামি বলে মনে করেছিলেন, কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনী ছিল ছোট এবং মোঘল বাহিনীর তুলনায় অনেক দূর্বল। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না যে মোঘলরা সহজেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে পরাজিত করেছিল। পরাজয়ের পর ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির কারখানাগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং অনেক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। কোম্পানির গভর্নরকে আওরঙ্গজেবের সামনে নতজানু হতে হয়। 

তবুও, অবিশ্বাস্যভাবে, প্রায় একশ বছর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ দখল করতে সক্ষম হয়। 

আজকের দিনে আমরা অ্যাপেল, গুগল, ফেসবুকের মতো বড় বড় কোম্পানির নাম শুনি, কিন্তু সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এসব আধুনিক প্রতিষ্ঠানের চেয়েও অনেক বড় এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? আসুন আজকে এই বিষয়টি একটু গভীরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করি।

আমাদের গল্পের শুরু ১৬০০ সালে, যখন একদল ব্রিটিশ ব্যবসায়ী মিলে গঠন করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এটি ছিল একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি, যার মালিকানা ছিল শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। প্রাথমিকভাবে মাত্র ১২৫ জন শেয়ারহোল্ডার এই কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন, এবং তারা একত্রে ৭০,০০০ পাউন্ড মূলধন সংগ্রহ করেন। কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলোতে গিয়ে মসলার ব্যবসা করা। 

১৬০১ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার প্রথম যাত্রা শুরু করে এবং ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে দুটি কারখানা স্থাপন করে। তবে সে সময় ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোতে ইতিমধ্যেই স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং ডাচ ব্যবসায়ীরা শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলেছিল। ডাচ কোম্পানিগুলো বিশেষত বেশি লাভজনক এবং শক্তিশালী ছিল, তাদের অর্থ ও সামরিক শক্তি ব্রিটিশ কোম্পানির চেয়ে অনেক বেশি। ডাচরা দ্রুতই সেই অঞ্চলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। 

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বুঝতে পারে, তাদের এই এলাকায় ব্যবসার তেমন কোনো সুযোগ নেই। সংঘাত এড়ানোর জন্য তারা অন্যত্র ব্যবসার নতুন সুযোগ খুঁজতে শুরু করে। এবার তাদের দৃষ্টি পড়ে ভারতের দিকে, যেখানে মশলা ও বস্ত্রের ব্যবসার সম্ভাবনা ছিল বিপুল। 

১৬০৮ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকরা ভারতে পা রাখে। প্রথমে তারা আজকের গুজরাটের সুরাট শহরে অবতরণ করে। 

সে সময় ভারত ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনের অধীনে, আর মুঘল সেনাবাহিনী ছিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বাহিনী, যার সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ লক্ষ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুঘলদের সঙ্গে লড়াই করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হবে। তাই তারা মুঘল সম্রাটের সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা শুরু করে, যাতে তারা এখানে ব্যবসা করার অনুমতি পায়। 

সেই সময় মুঘল সম্রাট ছিলেন জাহাঙ্গীর। কোম্পানির এক ক্যাপ্টেন, উইলিয়াম হকিন্স, জাহাজ থেকে নেমে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আগ্রায় পৌঁছান, যা তখন মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। সেখানে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করেন, ‘আমাদের সুরাটে একটি কারখানা স্থাপনের অনুমতি দিন, আমরা এখানে ব্যবসা করতে চাই।’ 

কিন্তু জাহাঙ্গীর তাতে তেমন আগ্রহ দেখাননি। এর একটি বড় কারণ ছিল যে, সেই সময় পর্তুগিজরা ইতিমধ্যেই সুরাটে ব্যবসা করছিল এবং তারা মুঘল সম্রাটের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছিল।

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের সুসম্পর্ক ছিল। তাই তিনি ব্রিটিশদের মুঘল সাম্রাজ্যে ঢুকিয়ে পর্তুগিজদের প্রতিদ্বন্দ্বী করার কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখেননি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা বুঝতে পারলেন, মুঘলদের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলোতে তাদের জন্য ব্যবসার কোনো সুযোগ নেই। তাই তারা এমন অঞ্চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকলেন, যেখানে মুঘলদের নয়, কোনো স্থানীয় রাজাদের শাসন রয়েছে। 

শেষ পর্যন্ত তাদের এই প্রচেষ্টা সফল হয় ১৬১১ সালে, যখন তারা অন্ধ্র প্রদেশের ‘মাচলিপটনম’-এ প্রথম কারখানা স্থাপন করতে সক্ষম হয়। সেখানকার স্থানীয় রাজা তাদের এই অনুমতি দেন। এভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে ব্যবসার যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী কয়েক বছরে তারা আরও কারখানা স্থাপন করে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে থাকে। এই সময়ে তারা ক্রমাগত অন্যান্য ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে পর্তুগিজদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

১৬১২ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আবার সুরাটে ফিরে আসে এবং সেখানে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধটি ‘ব্যাটল অফ সোয়ালী’ নামে পরিচিত। এতে পর্তুগিজরা পরাজিত হয় এবং তাদের প্রভাব সুরাটসহ অন্যান্য অঞ্চলে কমে যেতে থাকে। পর্তুগিজদের প্রভাবপ্রতিপত্তি মূলত গোয়া অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে বিজয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান ব্যবসায়িক শক্তি হয়ে ওঠে।

এই বিজয়ের পরপরই, ১৬১৫ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসকে অনুরোধ করে, যেন মুঘল সম্রাটের কাছে একজন রাজকীয় প্রতিনিধি পাঠানো হয়। কোম্পানি আশা করেছিল, এবার হয়তো মুঘল সম্রাট তাদের ব্যবসা করার অনুমতি দেবেন। সেই উদ্দেশ্যে কূটনীতিক স্যার টমাস রোকে ব্রিটিশ ক্রাউন থেকে ভারতে পাঠানো হয়। 

স্যার টমাস রো যা করেছিলেন, তা আগের ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্স পারেননি। জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাতের সময় তিনি সম্রাটকে অনেক দামী উপহার দেন। উপহারগুলো দেখে মুগ্ধ হন সম্রাট জাহাঙ্গীর। এর ফলস্বরূপ, জাহাঙ্গীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সুরাটে তাদের নিজস্ব কারখানা স্থাপনের জন্য রাজকীয় অনুমতি প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, কোম্পানিকে কিছু একচেটিয়া ব্যবসায়িক অধিকারও দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে তারা নির্দিষ্ট অঞ্চলে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। তবে, এর বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মুঘল সাম্রাজ্যকে বার্ষিক অর্থ প্রদানের শর্ত মানতে হয়।

এইভাবেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুরাটে তাদের প্রথম কারখানা স্থাপন করে। পরবর্তী কয়েক বছরে, তারা মাদ্রাজ, আহমেদাবাদ, বোম্বে, আগ্রা, পাটনা সহ আরও অনেক শহরে কারখানা স্থাপন করতে শুরু করে। কোম্পানির ব্যবসা দ্রুত বিকাশ লাভ করে এবং তারা তুলা, রেশম, লবণ, আফিম, এবং পরবর্তীতে চা-এর মতো পণ্য নিয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবসা করতে থাকে। যে শহরগুলোতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের কারখানা স্থাপন করে, সেসব শহরে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখা দিতে থাকে। 

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচেটিয়াভাবে ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলজুড়ে তাদের ব্যবসা বিস্তৃত করতে থাকে এবং ধীরে ধীরে আরও শক্তিশালী হতে শুরু করে।

পূর্ব বাংলায় তখন “বাংলা” বলতে বোঝাতো একটি বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত সফল এবং সমৃদ্ধ অঞ্চল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুধু বাণিজ্যিক সুবিধা নয়, তাদের ব্যবসা সহজ করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতাও চেয়েছিল। তারা প্রতিযোগীদের সরিয়ে দিয়ে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান গড়তে চেয়েছিল। এ লক্ষ্যে তারা আবার ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে ইংরেজ রাজাকে অনুরোধ করে তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। তারা যুক্তি দেয়, যেহেতু তারা উৎপাদন করতে পারে, সেহেতু তাদের লাভ আরও বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া উচিত, এবং বিভিন্ন পণ্য থেকে তারা ব্যবসা বাড়াতে পারে।

১৬৭০ সালের দিকে, ইংরেজ রাজা দ্বিতীয় চার্লস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে অসাধারণ ক্ষমতা প্রদান করেন। এই ফরমানের অধীনে, কোম্পানি এখন শুধু বাণিজ্যই নয়, অঞ্চল দখল, রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখা, এবং নিজস্ব বিচারব্যবস্থা পরিচালনার অধিকারও পায়। শুধু তাই নয়, কোম্পানি নিজস্ব সেনাবাহিনী রাখতে, জোট গঠন করতে, এবং প্রয়োজনে যুদ্ধও চালাতে পারবে। 

এটি আজকের দিনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কারণ আমরা আজকের বড় বড় কোম্পানি যেমন অ্যাপল, গুগল বা ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবি। তাদের তো কোনো সেনাবাহিনী বা বিচারব্যবস্থা নেই! কিন্তু সেই সময়, ইংরেজ রাজতন্ত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এই সকল ক্ষমতা দিয়েছিল। এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি বিশাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে একটি কার্যত স্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়।


১৬৮২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার মুঘল গভর্নর শায়েস্তা খানের সাথে আলোচনার চেষ্টা করে। সে সময় বাংলায় কোম্পানির কিছু উপস্থিতি ছিল, কিন্তু তারা বাংলায় ব্যবসার পূর্ণ অধিকার চেয়েছিল। নতুন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব কর কমিয়ে দেন, যা কোম্পানির জন্য কিছুটা সুবিধা ছিল, কিন্তু কোম্পানি বাংলায় তাদের নিজস্ব কারখানা স্থাপনের চেষ্টায় থাকে। আওরঙ্গজেব এই সাহসকে ইংরেজদের অহংকার হিসেবে দেখেন এবং তাদের বিরোধিতা করেন।

১৬৮৬ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় কারখানা স্থাপনের চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। জোসিয়া চাইল্ড তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ছিলেন। কিন্তু মোঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনী মারাত্মকভাবে পরাজিত হয়। এরপর কোম্পানিকে আওরঙ্গজেবের সামনে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইতে হয়। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, আওরঙ্গজেব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন, যা আজকের মূল্যমান অনুযায়ী প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। তবে কোম্পানির ব্যবসার সুযোগ পুনরুদ্ধার করা হয়, বাজেয়াপ্ত কারখানাগুলো ফেরত দেওয়া হয়, এবং পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। যে যুদ্ধের কথা গল্পের শুরুতেই বলছিলাম ।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল ছিল এবং তারা বুঝতে পেরেছিল, মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করে সাফল্য পাওয়া কঠিন। তাই তারা অপেক্ষা করতে থাকে, বিশেষত আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর, যখন মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়বে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা বাংলায় নিজেদের কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করতে থাকে। এভাবেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে বাংলায় তাদের শক্তি এবং প্রভাব বাড়াতে শুরু করে।

মুঘল সাম্রাজ্য যখন দুর্বল হতে শুরু করে, তখন মুঘলদের মধ্যে ক্ষমতার জন্য লড়াই বাড়তে থাকে। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর, শাসনের প্রশ্নে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় এবং আঞ্চলিক নবাবরা নিজেদের অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে, মারাঠারা মুঘলদের জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের আমলেই মারাঠাদের সাথে মুঘলদের বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ হয়েছিল, কিন্তু তার মৃত্যুর পর মারাঠারা মুঘলদের আরও সহজে পরাজিত করে এবং তাদের নিজস্ব অঞ্চল পুনরুদ্ধার করে।

এদিকে, ১৭৩৯ সালে পারস্যের শাসক নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করেন এবং প্রচুর ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে যান। মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতা আরও প্রকাশ পায়। ১৭৪৮ সালে আফগান শাসক আহমদ শাহ দুররানি মুঘলদের আমন্ত্রণে ভারতে প্রবেশ করে। যদিও রাজপুত এবং শিখদের সাথে একত্রিত হয়ে মুঘলরা তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে, সাম্রাজ্যের সামগ্রিক অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকে।

এরপর মুঘল সাম্রাজ্যের আর্থিক সংকট তীব্রতর হয়। আঞ্চলিক গভর্নররা, যারা আগে কেন্দ্রীয় মুঘল সরকারকে কর দিতেন, তারা কর প্রদান বন্ধ করে দেন। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশ বি-কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে, এবং অঞ্চলগুলোতে আঞ্চলিক শাসকদের প্রভাব বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজের অবস্থান শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেয়। তারা নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করে, নতুন কারখানা স্থাপন করে এবং তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলে। কোম্পানি স্থানীয় ভারতীয়দের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে, যাদের ‘সিপাহী’ বলা হতো।

এই সময় বাংলায় মুঘল রাজারা করের সুবিধা দিতে ইচ্ছুক ছিল না। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থানীয় শাসকদের সাথে লেনদেন করার কৌশল খুঁজতে থাকে। অবশেষে, ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাট ফারুক সিয়ার কোম্পানির পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরমান জারি করেন। এই ফরমানের অধীনে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় করমুক্তভাবে একচেটিয়া ব্যবসা করার অধিকার পায়। 

এছাড়াও, কোম্পানি ‘দস্তক’ নামে পরিচিত বিশেষ ট্রেড পারমিটের সুবিধা পায়, যার মাধ্যমে তারা সব ধরনের শুল্ক ও ট্রানজিট কর থেকে অব্যাহতি লাভ করে। এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা আরও দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। অন্যদিকে, মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য এটি ছিল আর্থিক দিক থেকে আরও বড় আঘাত, কারণ বাংলায় কোম্পানির করমুক্ত ব্যবসা সরাসরি মুঘল রাজস্বের ক্ষতি করছিল।

এভাবেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে বাংলার বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে থাকে, যখন মুঘল সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে।

১৭১৭ সালে, বাংলার প্রাক্তন মুঘল গভর্নর একসময় সাহসিকতার সাথে বলেছিলেন, “মুঘল সাম্রাজ্য যদি বন্যায় ভেসে যায়, তাতেও কিছু আসে যায় না। এই বাংলা এখন আমার নিয়ন্ত্রণে, আর আমি সারা বাংলার নবাব হয়েছি।” তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সতর্ক করে বলেন, “এখানে তোমাদের করমুক্ত ব্যবসা চলবে না, তোমাদের অবশ্যই কর দিতে হবে।”

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বুঝতে পারে যে, নিজেদের ব্যবসার সুবিধার্থে স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া এখন জরুরি। সেই সময়ে মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ছিল, এবং ইউরোপীয় শক্তিগুলি, বিশেষ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ডাচ, এবং ড্যানিশরা, এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে মরিয়া ছিল। তারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল।

১৭০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, এই ইউরোপীয় শক্তিগুলো বঙ্গ, পন্ডিচেরি, এবং চন্দননগরের মতো অঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করে। ফরাসিরাও এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ছিল না। ১৭৪০-এর দশকের গোড়ার দিকে, ফরাসি নেতা এবং ফরাসি ভারতের গভর্নর-জেনারেল ডুপ্লে ভারতে একটি ফরাসি সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

১৭৪০ থেকে ১৭৪৮ সাল পর্যন্ত, অস্ট্রিয়ান উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় ইউরোপে যেমন সংঘর্ষ হচ্ছিল, তেমনি ভারতের ভেতরেও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে। ১৭৫৬ সালে, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে শুরু হয় ‘সাত বছরের যুদ্ধ’, যা শুধু ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায় সীমাবদ্ধ ছিল না; ভারতেও এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কর্ণাটিক যুদ্ধগুলির সময় (১৭৪৬-১৭৬৩), ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয় এবং ফরাসিরা তাদের রাজনৈতিক প্রভাব অনেকাংশেই হারায়। পন্ডিচেরি এবং চন্দননগর ছাড়া ফরাসিদের সবকিছুই প্রায় ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়।

এখন প্রশ্ন হলো, এই সময়ে ভারতীয় রাজা এবং মহারাজাদের ওপর এর প্রভাব কী ছিল? এই ইউরোপীয় শক্তিগুলির সামরিক শক্তি দেখে ভারতীয় রাজারা প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। তারা ভাবতে শুরু করেন, “আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের শক্তিশালী, প্রশিক্ষিত এবং সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীকে কেন ব্যবহার করা যাবে না?” কিন্তু তারা বুঝতে পারেননি যে, এর ফলে তারা নিজেদের স্বাধীনতাও হারাতে চলেছেন। 

ইউরোপীয় শক্তিগুলো শুধু সামরিক সহায়তায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, তারা রাজনৈতিক প্রভাবও বিস্তার করতে শুরু করে। তারা স্থানীয় শাসকদের বিরোধীদের ঘুষ দিত, সৈন্য পাঠিয়ে তাদের সিংহাসনে বসাত এবং পুতুল শাসক হিসেবে তাদের ব্যবহার করত। রাজারা বুঝতে পারেনি যে, এই সামরিক সহযোগিতার ফলে তারা ধীরে ধীরে ইউরোপীয়দের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এবং তাদের ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

এবার আমরা ফিরে আসি বাংলার নবাব এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গল্পে।

১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হলেন। আমি আগেই বলেছি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে মুর্শিদকুলী খানের আমল থেকে নবাবদের কর্তৃত্বকে উপেক্ষা করে আসছিল। তবে সিরাজউদ্দৌলা ভেবেছিলেন, “এবার আর নয়!” তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কোম্পানির এই ঔদ্ধত্য মেনে নেওয়া যাবে না। তাই সিরাজউদ্দৌলা তার বাহিনী নিয়ে কলকাতার দিকে অগ্রসর হন এবং কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম আক্রমণ করেন। 

এই আক্রমণে বেশ কিছু ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে বন্দী করা হয়, এবং তাদের মধ্যে অনেকেই ‘কলকাতার ব্ল্যাক হোল ট্র্যাজেডি’ নামক এক মর্মান্তিক ঘটনায় প্রাণ হারান, যেখানে তাদের একটি ছোট জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এই ঘটনায় ব্রিটিশরা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে।

ব্রিটিশরা এ সময় কর্ণাটিক যুদ্ধের সময় শিখে নেওয়া কৌশল কাজে লাগায়। তারা সিরাজের শত্রুদের খুঁজে বের করে এবং তাদের ব্যবহার করে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করে। এই ষড়যন্ত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন জগৎ শেঠ। মুর্শিদাবাদের এই ধনী বণিক পরিবারটি নবাবের দরবারে অনেক প্রভাবশালী ছিল। অন্যদিকে, সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনীর প্রধান মীর জাফরের নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। তার মনে লালিত স্বপ্ন ছিল, একদিন তিনিও নবাব হবেন।

তবে সিরাজউদ্দৌলা বোকা ছিলেন না। তিনি জানতেন যে ব্রিটিশরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং যেকোনো সময় তার শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করবে। তাই তিনি ব্রিটিশদের শত্রু ফরাসিদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ান এবং তাদের সঙ্গে একজোট হন। 

এরপর, ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশদের সাথে সিরাজউদ্দৌলার যুদ্ধ হয়, যা ইতিহাসে ‘পলাশীর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। যদিও সিরাজের বাহিনী ব্রিটিশদের চেয়ে পনেরো গুণ বড় ছিল, তবুও তিনি এই যুদ্ধে পরাজিত হন। কারণ, মীর জাফর ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতা তাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। যুদ্ধের পর, ব্রিটিশরা মীর জাফরকে বাংলার পুতুল নবাব হিসেবে সিংহাসনে বসায় এবং সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ যুদ্ধে ফরাসিদেরও বড় ধাক্কা লাগে এবং বাংলায় তাদের উপস্থিতি প্রায় শেষ হয়ে যায়। চান্দননগর, যা ছিল তাদের শেষ প্রভাবশালী অঞ্চল, সেটিও ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

পলাশীর যুদ্ধ ছিল ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই যুদ্ধের পর, ব্রিটিশরা সরাসরি নয়, পরোক্ষভাবে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে। তবে তাদের নতুন পুতুল নবাব, মীর জাফর, যতটা তারা আশা করেছিল ততটা অনুগত হয়ে উঠেননি। তিনি পরবর্তীতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে মৈত্রী করেন এবং ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্তির চেষ্টা করেন। 

ব্রিটিশরা এটি জানতে পেরে মীর জাফরকে সিংহাসনচ্যুত করে তার জামাতা মীর কাসিমকে ১৭৬১ সালে বাংলার নতুন নবাব হিসেবে স্থাপন করে। তারা আশা করেছিল যে মীর কাসিম হবে তাদের জন্য আরও অনুগত একজন পুতুল শাসক। কিন্তু মীর কাসিমও কোম্পানির অত্যাচার সহ্য করতে পারেননি। তিনি দেখতে পান কীভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করছে এবং বাংলার অর্থনীতিকে শোষণ করছে।

১৭৫৬ সালে মীর কাসিম বাংলার নবাব হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে ব্রিটিশদের অত্যাচার আর সহ্য করা হবে না। তিনি চেয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাকে স্বাধীন করা। এই লক্ষ্যেই ১৭৬৩ সালে তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তবে ততদিনে ব্রিটিশরা সামরিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ফলে বাংলার সেনাবাহিনী পরাজিত হয়, এবং মীর কাসিম ক্ষমতা হারান।

ব্রিটিশরা মীর কাসিমকে ক্ষমতাচ্যুত করে আবার মীর জাফরকে সিংহাসনে বসায়। মীর জাফর আবার নবাব হলেও, তিনি ছিলেন শুধুমাত্র নামমাত্র শাসক—একজন পুতুল নবাব, যিনি ব্রিটিশদের ইচ্ছেমতো পরিচালিত হতেন। 

মীর কাসিম বাংলার বাইরে পালিয়ে যান, বুঝতে পারেন যে একা এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। এরপর ১৭৬৪ সালে ‘বক্সারের যুদ্ধ’ হয়, যেখানে মীর কাসিম, শুজা-উদ-দৌলা এবং মুঘল সম্রাট শাহ আলম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে লড়াই করেন। কিন্তু ব্রিটিশরা আবারও বিজয় অর্জন করে। এই যুদ্ধ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, কারণ এই বিজয়ের পর কোম্পানি বুঝতে পারে যে পুতুল শাসক বসানোর চেয়ে সরাসরি শাসন করা তাদের জন্য অধিক কার্যকরী।

এরপর ১৭৬৫ সালে, ‘এলাহাবাদের চুক্তির’ মাধ্যমে বাংলার ওপর ব্রিটিশদের সরাসরি শাসনের সূচনা ঘটে। রবার্ট ক্লাইভ বাংলার গভর্নর ও সর্বাধিনায়ক হন। এই চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, মুঘল সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয়ের আদেশ অনুযায়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি অধিকার পায়। এর অর্থ, বাংলার করের রাজস্ব সরাসরি কোম্পানির হাতে চলে যায়। ফলে ব্রিটিশরা এখন ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে আয়ের পাশাপাশি রাজস্ব আদায় করেও অর্থ উপার্জন করতে থাকে।

এই নতুন রাজস্বের সাহায্যে ব্রিটিশরা তাদের সামরিক শক্তি আরও বাড়ায় এবং দ্রুত বাংলার পুরো অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এর ফলে তারা ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের কৌশল নিয়ে এগোতে থাকে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কয়েকটি চতুর কৌশল ব্যবহার করে ভারতের অন্যান্য অংশ দখল করতে শুরু করে। প্রথমত, তারা যেসব রাজ্য তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না

সেখানে তাদের বাসিন্দাদের নিয়োগ করতেন। এই বাসিন্দারা মূলত ব্রিটিশ কূটনীতিক, যারা স্থানীয় রাজা-সম্রাটদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে তাদের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতেন। দ্বিতীয়ত, তারা ‘সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স’ নামে একটি চুক্তি কার্যকর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী, স্থানীয় রাজারা নিজেদের সেনাবাহিনী বজায় রাখতে পারতেন না, এবং তাদের পক্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজস্ব সেনাবাহিনী তৈরি করত। এর বিনিময়ে রাজাদের কোম্পানিকে অর্থ প্রদান করতে হতো। এই চুক্তির মাধ্যমে অনেক অঞ্চল পরোক্ষভাবে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

১৮১৮ সালের মধ্যে, এই কৌশলগুলো ব্যবহার করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। উপমহাদেশের জনসংখ্যার ৭৮% কোম্পানির শাসনের অধীনে বসবাস করছিল। 

এরপর, নতুন অঞ্চল দখল করার জন্য তারা ‘ডকট্রিন অফ ল্যাপস’ নীতি প্রয়োগ করে। এই নীতির মাধ্যমে, কোনো রাজা যদি স্বাভাবিক পুরুষ উত্তরাধিকারী ছাড়া মারা যেতেন, তবে সেই রাজ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রিটিশদের অধীনে চলে যেত। লর্ড ডালহৌসির শাসনকালে, ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে এই নীতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়। 

এইভাবে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের এক বিশাল অংশে সরাসরি শাসন কায়েম করে, যা ভারতের ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শাসনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

‘ডকট্রিন অফ ল্যাপসে’র কার্যকরের মাধ্যমে, ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক বিখ্যাত শহর এবং অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৪৮ সালে সাতারা, ১৮৫২ সালে উদয়পুর, ১৮৫৩ সালে নাগপুর, ১৮৫৪ সালে জাহাসি এবং ১৮৫৬ সালে ফিলি আভাদ—এসব শহর ব্রিটিশ শাসনের আওতায় আসে। এই কৌশলগুলির ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্রুত প্রশাসনিক সংস্কার কার্যকর করতে শুরু করে।

যেহেতু কোম্পানিটি এত বিশাল অঞ্চল শাসন করছিল, তাদের জন্য একটি কার্যকর শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি ছিল। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্টের মাধ্যমে বাংলার গভর্নর জেনারেলের পদ সৃষ্টি করা হয়। প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন ওয়ারেন হেস্টিংস, যিনি এই পদের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা সহজতর করেন।

১৮০০ এর দশকের গোড়ার দিকে, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের জন্য টিকে থাকা শেষ বড় সাম্রাজ্যগুলি ছিল মারাঠা সাম্রাজ্য এবং মহীশূর রাজ্য। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিভাবে এই দুই সাম্রাজ্যকে পরাজিত করেছিল তা ছিল একটি আকর্ষণীয় কাহিনী। 

ডকট্রিন অফ ল্যাপসের পর, ১৮৫৭ সালে ‘স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ’ বা ভারতীয় বিদ্রোহ শুরু হয়। যদিও বিদ্রোহীরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয়, তবে ১৮৫৮ সালের ভারত সরকার আইন অনুসারে, ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে জাতীয়করণ করে। এর ফলে, কোম্পানির সব অঞ্চল, সামরিক বাহিনী এবং সম্পদ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে যায়।

এই ঘটনার মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং ব্রিটিশ শাসনের নতুন যুগের সূচনা হয়। ১৮৭৪ সালে, এই কোম্পানিটি চূড়ান্তভাবে বিলুপ্ত হয়। একই সময়ে, শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে বার্মায় নির্বাসিত করার ফলে মুঘল সাম্রাজ্যেরও সমাপ্তি ঘটে। এরপর, পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অনেককেই হত্যা করা হয়, যা মুঘল রাজত্বের শেষ চিহ্নগুলিকে নির্মূল করে।

এই সব ঘটনার মধ্য দিয়ে দেখা যায়, বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী কোম্পানি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান ও পতনের গল্পটি সত্যিই চিত্তাকর্ষক। এটি শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় নয়, বরং ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে বদলে দেওয়ার এক অনন্য কাহিনী।


ধ্রুব রাঠি

ভারতীয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর


 ভিডিও থেকে এই লিখাটি অনুবাদ  ও সম্পাদনায় AI এর সহযোগিতা নেয়া হয়েছে।

বিভাগীয় সম্পাদক

১১ thoughts on “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: ব্রিটিশদের ভারত দখল

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x