এক বিষ্ময়-জাগানিয়া গণঅভ্যুত্থান


 সম্পাদকীয়


নতুন এক গণঅভ্যূত্থানের স্বাক্ষী হলো বাংলার মানুষ। কত বছর পর সবাই এক হলো একটি মাত্র সিদ্ধান্তে আর সেটি হলো ‘স্বৈরাচার ও খুনি’ শেখ হাসিনার পদত্যাগ। ৩৬ দিনের আন্দোলন, ৭০০ তরতাজা প্রাণ আর অসংখ্য মানুষের রক্তের বিনিময়ে এলো বাংলার ‘নতুন স্বাধীনতা’। কারো মতে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’। কারো মতে ‘ফ্যাসিবাদ’ মুক্ত নতুন বাংলাদেশ ।

‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া প্রম বিদ্রোহ ধরা হয় এই অঞ্চলের মানুষের। সেটারও বয়স এক হাজার বছর হতে চললো। এর আগেও বাংলার মানুষের ‘বিদ্রোহ’ করাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে তা ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া ভাই এর মতোই। এ অঞ্চলের মানুষকে চেপে ধরলে, শক্তি প্রয়োগ করলে দীর্ঘদিন তারা তা সহ্য করে, তারপর ফুঁসে ওঠে একদিন। তখন আর রক্ষা থাকেনা,পালিয়ে যান শাসকেরা।

এবারে যা ঘটলো তা অকল্পনীয়, অসাধারণ এবং অনন্য।  সাধারণের যে কি শক্তি তার প্রকাশ অনেক হতাশ মানুষের মনেও আশা জাগিয়েছে। সবাই এক হলে যে কি হয়, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এবারের গণঅভুত্থান।

প্রতিবাদ করতে গিয়ে, দাবি আদায় করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলায় এত মানুষ একসাথে জীবন দেয়নি। সকল মানুষ একসাথে এক বিন্দুতে এভাবে এসে বন্দুকের সামনে আর কখনো দাঁড়ায়নি। ভরসা করা যায় এদেশের মানুষের উপর।

শুরুটা হয়েছিল ছাত্রদের হাত ধরে, সরকারি চাকরিতে কোটার বৈষম্য  দূর করার আন্দোলন নিয়ে। আস্তে আস্তে সরকারের গোয়ার্তুমি আর জনগনকে মানুষ মনে না করার আচরণ, সব শ্রেনীর মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে এনেছিল। ছাত্র, শিক্ষক, সৈনিক, পেশাজীবী, দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, কে ছিলেন না এই যুদ্ধে!

জীবনকে কি অবলিয়ায় তুচ্ছ করেছে ছোট ছোট ছেলেরা। কা বুক চেিয়ে দাঁড়িয়েছে রংপুরের সাঈদ, পানি লাগবে পানি লাগবে বলতে বলতে গুলিতে লুটিয়ে পড়েছে মুগ্ধ, পুলিশের গাড়ি থেকে কি নির্মমভাবে ফেলে দিয়ে হত্যা করে ইয়ামিনকে। মোহাম্মাদপুরের ফাইয়াজ, পুরান ঢাকার রিকশা চালক সোহাগ মিয়া, হবিগঞ্জের আশরাফুল, কুমিল্লার শাওন। কত কত নাম। কত কত জীবন। কত কত নিষ্পাপ তরুণের সাহসী মুখ। এই সাহসকে দাবায়ে রাখবে কে ?

যাত্রাবাড়ির থানার সামনে কি অবলিলায় লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে পুলিশ। আহা! সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে ১৫ জন পুলিশকে নির্মম হত্যার শিকার হতে হয় স্থানীয়দের হাতে। এক বিভীষিকাময় কয়েকটি দিন !

পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, আওয়ামীগুন্ডারা শতশত মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মেরেছে যাদের বেশির ভাই ছাত্র ও অল্প বয়সি যুবক। তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ৬৭ জন শিশু-কিশোর নিহত হয়েছে এই আন্দোলনে। যাদের বয়স ৪-১৭ বছর। ঘরের ভিতর থেকেও রক্ষা পায়নি ৬ বছরের শিশু রিয়া।

কারো কারো তে মৃতের সংখ্যা এক হাজারের উপরে, কারো মতে এই সংখ্যা ৬৫০ জনের মতো। এই পরিসংখ্যান শুধুমাত্র হাসপাতালের রেজিষ্টার থেকে পাওয়া তথ্য । তবে মৃত্যের প্রকৃত সংখ্যা বের করা সহজ হবে না, নানা জটিলতার কারণে। অতলে হয়ত হারিয়ে যাবে অজ্ঞতানামা কন সাসী যুবকের আত্ন্যাগ।

তবে যত রেছে মানুষ তত বড় হয়েছে মুক্তির মিছিল। সেনাবাহিনী এই সাহসের কাছে মাথা নত করে যুক্ত হয়েছে ছাত্র-জনতার সাথে। তপ্ত দুপুরে তাজা রক্তের বিনিময়ে বদলে যায় সূর্যের রঙ, আওয়াজ ওঠে রাস্তায় ‘পালাইছেরে পালাইছে..’।

৫ আগস্ট, ২০২৪ দুপুরে আড়াইটায় সকল শক্তি আর দম্ভকে  পিছনে ফেলে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। সাথে আত্নগোপনে চলে যান তার দোসরা। লক্ষ লক্ষ মানুষ দখল করে নেয় গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়সহ সারা বাংলাদেশ। এক  অভূতপূর্ব গণঅভ্যত্থানে জন্ম নেয় নতুন বাংলাদেশ। তরুণদের বাংলাদেশ।

এর পরের ইতিহাস যদিও কলঙ্ক আর বিশৃঙ্খলার। তবু একাত্তরের পর বাঙলার মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জণ এই গণঅভ্যুত্থাণ। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন সবাই এক হবার গৌরবময় এই আন্দোলন অদম্য এক সাহস জুগিয়ে যাবে মানুষের মনে।


 সম্পাদক, আলোর দেশে


আরো সম্পাদকীয় পড়ুন :

স্বাধীনতার পঞ্চাশ

মহামারর ঈদ !

৪৫ thoughts on “এক বিষ্ময়-জাগানিয়া গণঅভ্যুত্থান

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x