৮ ফেলুদার গল্প !

 

পারভেজ সেলিম

 


 
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্রের নাম ফেলুদা। যার পুরো নাম প্রদোচন্দ্র মিত্র। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বাংলা সিনেমা নির্মিত হয়েছে এই গোয়েন্দা চরিত্রটিকে নিয়ে। ফেলুদার স্রষ্টা বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়। ফেলুদা তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে টিকে আছে আর দিন দিন  যেন এর জনপ্রিয়তা আরো বাড়ছে ।
 
ফেলুদা প্রথম প্রকাশ পায় সন্দেশ পত্রিকায় ১৯৬৪ সালে । প্রথম গল্প ছিল ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি। এরপর সত্যজিত মোট ৩৫ টি গল্প লিখেছেন । এরমধ্যে ছোটগল্প আছে ১৭ টি আর উপন্যাস ১৮ টি। ফেলুদাকে নিয়ে তার তিনটি গল্প অসমাপ্ত  রয়ে গেছে। 
 
 

সৌমিত্র প্রথম ফেলুদা :

 
ফেলুদাকে প্রথম সিনেমার পর্দায় আনেন সত্যজিত রায় নিজেই। জয়বাবা ফেলুনাথসোনার কেল্লা এই দুটি সত্যজিতের নিজের বানানো ফেলুদা চলচ্চিত্র। আর এই দুটিতে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেন সত্যজিতের সবসময়ের জন্য প্রিয় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়। সৌমিত্র চট্টপাধ্যায় হচ্ছেন সিনেমার প্রথম ফেলুদা।
 
 এরপর আরো ৭ জন অভিনেতা এই চরিত্রটিকে অলংকৃত করেছেন, কেউ কেউ জনপ্রিয়ও হয়েছে, কেউ কেউ সেরকম সাড়া ফেলতে পারেননি । তবে সৌমিত্রের ফেলুদা যে চুঁড়ায় উঠেছে সেখানে আর কেউই এখনও উঠতে পারেনি। সৌমিত্র ছিল অসাধারণ ও দুর্ানত এক ফেলুদা

সব্যসাচি ফেলুদা :

 
এরপর পর আসেন সব্যসাচি চক্রবর্তী। সৌমিত্রর পর সব্যসাচিই একমাত্র অভিনেতা যে এই চরিত্রে জনপ্রিয় হতে পেরেছিলেন। তবে এই ফেলুদাকে জনপ্রিয় করার পিছনে সত্যজিতের পুত্র সন্দীপ রায়ের বেশ ভুমিকা আছে। বাবার মৃত্যুর পর সব্যসাচিকে দিয়ে তিনি একাই পরপর ৭টি সিনেমা বানিয়েছেন । প্রায় প্রত্যেকটিতে সব্যসাচির ছিল দর্শকপ্রিয়তা । এছাড়া টেলিভিশনের জন্য বানানো ধারাবাহিকেও সন্দীপ রায় আস্থা রেখেছিলেন সব্যসাচির উপর।  দীর্ঘদিন এই কয়েকজনের মধ্যে ফেলুদা নির্মাণ ও অভিনয় ঘোরপাক খাচ্ছিল । ধীরে ধীরে এর পরিবর্তণ শুরু হয় ।
 
টেলিভিশনে কিসসা কাটমুন্ডু কা নামের একটি হিন্দি ধারাবাহিক প্রচারিত হয়। সেই ধারাবাহিকে ফেলুদা হন শশী কাপুর। এটাই প্রথম বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় ফেলুদার চিত্রায়ণ ।

 

 কয়েকজন ফেলুদা :

 
এরপর ২০১৪ সালে বাদশাহী আংটি সিনেমায় দেখা যায় নতুন ফেলুদা আবীর চ্যার্টাজীকে। আবীরের অভিনয় অনেকের পছন্দ হলেও ২০১৬ সালে ডাবল ফেলুদাতে আবার দেখা যায় সব্যসাচিকে ।
 
 ২০১৭ সালে এসে ফেলুদাকে নিয়ে শুরু হয় ওয়েভ সিরিজ নির্মাণ ।  দেখা যায়  নতুন ফেলুদা পরমব্রত চট্টপাধ্যায়কে। পাঁচ নাম্বার ফেলুদা হন পরমব্রত। এই সিরিজের পরিচালনাও করেন তিনি । এছাড়া পরমব্রতই একমাত্র অভিনেতা যে পসে ও ফেলুদা দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ।
 
এরপর ২০১৯ সালে  ফেলুদা চরিত্র ভারতের গন্ডি পেরিয়ে আসে বাংলাদেশে। নয়ন রহস্য নিয়ে ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করেন দেশের স্বনামধন্য পরিচালক তৌকির আহমেদ। আর এখানেই বাংলাদেশের প্রথম ফেলুদা হন আহমেদ রুবেল । অভিনয়ে বিশেষ স্বকীয়তা আনলেও, ফেলুদা হিসেবে খুব বেশী জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি আহমেদ রুবেল ।

এবছরের শুরুর দিকে ফেলুদার যাত্রা হয় হলিউডে । ‘স্লামডগ মেলেনিয়া’র খ্যাত পরিচালক ড্যানি বয়েল ‘লন্ডনে ফেলুদা’  অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা দেন । ইংলিশ ফেলুদা চরিত্রে দেখা যাবে ‘পাইরেটস অব দ্যা ক্যারাবিয়ান’ খ্যাত অভিনেতা অর্ল্যান্ডো ব্লুমকে । 
 

সৃজিতের ফেলুদা :

 
সবশেষ  কলকাতার জনপ্রিয় নির্মাতা সৃজিত মুখার্জী ফেলুদা নির্মাণের ঘোষণা দিলে হইচই শুরু হয়। কে হচ্ছেন সৃজিতের ফেলুদা ? সৃজিত অনলাইনে ফেলুদা নির্বাচণ নিয়ে একটা ভোটাভুটির আয়োজনও করেন। সেই ভোটে প্রথম হন আবির চ্যাটর্জী। কিন্তু ভোটের রেজাল্টকে বাদ দিয়ে সৃজিত বেছে নেন তার পছন্দের টোটা রায় চৌধুরীকে। টোটা রায় চৌধুরীই আট নম্বর এবং এখন পর্যন্ত সর্বশেষ ফেলুদা। তার অভিনীত ফেলুদা সিরিজ দর্শক দেখতে পারবে ২০২০ সালে।
 
এখন পর্যন্ত ১১ নিয়ে সিনেমা হয়েছে ফেলুদাকে নিয়ে। এছাড়া টিভি নাটক, ধারাবাহিক কিবা য়েব সিরিজে ফেলুদা নির্মিত হয়েছে এবং  হচ্ছে । সেখানে ফেলুদা ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ দুটি চরিত্র মাতিয়ে রাখছে দর্শকদের। তারা হলেন ফেলুদার সহযোগী সর্ম্পকে ছোট ভাই তোপসে বা তপেশ রঞ্জন  আর সবচেয়ে জনপ্রিয়জন হলেন লেখক লালমোহন গাঙ্গুলী বা জটাযু,যার কাজই হচ্ছে পুরো সিনেমাজুড়ে ভুল আর অর্ধসত্য তথ্য দিয়ে গল্পকে আরো জমজমাট করে তোলা।
 
বাংলা সাহিত্যে কিংবা সিনেমায় আরও কিছু তুখোড় গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু বাঙ্গালীর আবেগ আর অনুভুতির সাথে ফেলুদা যেভাবে জড়িয়ে আছে  তা আর অন্য কোন গোয়েন্দা চরিত্রের সাথে দেখা যায় না। জয় বাবা ফেলুনাথ। ফেলুদা দীর্ঘজীবী হোক ।
 
 
 
 
পারভেজ সেলিম
 
লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী
 
 

x