রাষ্ট্রহীন ইহুদী: রাষ্ট্রের স্বপ্নে উন্মাদ


পারভেজ সেলিম


(পর্ব: ০৬/শেষ পর্ব)

১৮ শতকের শেষের দিকে আমেরিকায় কিছু ইহুদী একটি আন্দোলন শুরু করে। থিওডোর হার্শেল ছিলেন তাদের নেতা। ইহুদীদের জন্য তারা একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবি করতে থাকে। এটি ‘জায়ানিজম আন্দোলন’ নামে পরিচিত।

কিন্তু প্রকৃত ইহুদীরা এই আন্দোলনের সাথে এক মত না। ঐতিহ্যগত (Orthodox) ইহুদিরা বিশ্বাস করে, “Messiah” (মসীহ) আসার পরেই ইহুদিরা ঈশ্বরপ্রদত্ত ভূমি (Promised Land)-এ ফিরে যাবে।তারা মনে করে,মানব দ্বারা রাষ্ট্র গঠন ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এটি পাপ’।

এই ধারা অনুসরণকারী অনেক ইহুদি গোষ্ঠী রয়েছে, বিশেষ করে Neturei Karta: যারা এখনও ইসরায়েল রাষ্ট্রকে অস্বীকার করে। Haredi Jews (আল্ট্রা-অর্থোডক্স) যারা রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চায়।এভাবে ইহুদীদের মধ্যে ভিন্নমতের গ্রুপ হয়ে যায়।

যারা রাস্ট্র চায় তাদের বলা হয় ‘নতুন ইহুদী বা জায়োনিস্ট’, আর যারা রাষ্ট্রের জন্য অপেক্ষা করতে চায় তাদের বলা হয় ‘প্রকৃত ইহুদী বা রিলিজিয়াস জিউস’।

এই দুই মতের মধ্যেই আমেরিকায় শুরু হয় ‘জায়ানিজম আন্দোলন’। একদল ইহুদী রাস্ট্রের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে।

এরই মধ্য ১৯শতকের প্রথম দিকে কয়েক হাজার ইহুদীদের একটা দল বসবাসের জন্য প্রথম ইসরাইলে আসে। যাদের বলা হয় ইহুদীদের ‘প্রথম আলিয়া’।

তারা ফিলিন্তিনের কিটবুস অঞ্চলে স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে জমি কিনে বসবাস শুরু করে। কৃষিকাজ করতে থাকে। আস্তে আস্তে সারা পৃথিবী থেকে অল্প অল্প করে ইহুদী জড়ো হতে থাকে ফিলিস্তিনে।

এর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮ খ্রি.) শেষ হয়। উসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। মুসলমানদের অধিকারে থাকা ফিলিস্তিন দখল করে ব্রিট্রিশরা। আশেপাশে অঞ্চল চলে যায় ফান্সের দখলে।

১৯৩৩ সালে জার্মানীতে ক্ষমতায় আসে হিটলার। নেমে আসে ইহুদীদের জন্য চরম অন্ধকারের সময়।হিটলারের ইহুদী বিদ্বেষ ছিল নারকীয় ও বিভৎস।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সময় (১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রি.) গোটা ইউরোপের ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করা হয় মাত্র কয়েক বছরের মধ্য। ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় রচিত হয়, যা ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত।

মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি এত নির্মম অত্যাচার সাধারন মানুষের মনকে অস্থির করে তোলে। ইহুদীদের প্রতি সহমর্মীতা জন্মাতে শুরু করে ইউরোপিয়ান ও সাধারণ বিশ্ববাসীর মনে।

শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলার পরাজিত হয়। ব্রিটেন, আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়ন জয় লাভ করে।

এর আগে ২ নভেম্বর ১৯১৭ সালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেমস বেলফোর (Arthur James Balfour) একটি চিঠি লিখেছিলেন ব্রিটিশ ইহুদি নেতা লর্ড রথচাইল্ড-এর উদ্দেশ্যে,

“His Majesty’s Government view with favour the establishment in Palestine of a national home for the Jewish people…”

এটি ঐতিহাসিক ‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে পরিচিত। যা ইসরাইল রাস্ট্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। ব্রিটেনের বেলফোর ঘোষাণার মাধ্যমের ইহুদীদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনের ভুমি দখল করে একটি নতুন দেশ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইহুদীদের নতুন এই রাষ্ট্রের নাম দেয়া হয় ‘ইসরাইল’।

আরব বিশ্ব মেনে নেয় না ইহুদী রাষ্ট্রটিকে। শুরু হয় যুদ্ধ। ইসরাইল-আরব যুদ্ধ।

হেরে যায় আরবরা। এরপর দফায় দফায় আরো যুদ্ধ হয়।

আরব/ফিলিস্তিনি দেশগুলো সাথে সাথে ইসরাইলের ৮টি বড় আকারের যুদ্ধ এবং অনেক ছোট ও মাঝারি সংঘর্ষ হয়েছে যার প্রায় সবগুলোতেই জিতেছে ইসরাইল। পশ্চিমা বিশ্বে মদদের কারণে ইসরাইলের এমন অপরাজেয় হয়ে উঠে মধ্যপ্রাচ্যে।

ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত পিএলওর মাধ্যমে অনেক আলোচনা চালায়। দুই জাতি দুই দেশ এই সমাধানের, কিন্তু সফল হয়না। ইসরাইল ধীরে ধীরে পুরো ফিলিস্তিন দখল করতে থাকে।

২০২৩ সালে অক্টোবরে অতর্কিত হামলায় ১২০০ ইহুদীকে হত্যা করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস।

প্রতিশোধ হিসেবে পরবর্তী দেড় বছর ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি মুসলমানকে হত্যা করে ইহুদীরা। গাজাকে পুরো মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে ইহুদীরা। এখন শুধু পুরোটা দখলের অপেক্ষা। এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে এখন ফিলিস্তিনের মানুষ।

১২ এপ্রিল,২০২৫ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্দান্যে ‘মার্চ ফর ফিলিস্তিন’ নামের এক আয়োজনে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ যুক্ত হয়। ফিলিস্তিনের জয় হোক, এই স্লোগানের প্রকম্পিত হতে থাকে ঢাকার আকাশ।

কয়েক হাজার বছর ধরে নির্যাতিত, বিতাড়িত ইহুদীরা যেন সকল প্রতিশোধ নিচ্ছে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর। অথচ ফিলিস্তিরাই একদিন তাদের ভালোবেসে বসবাসের জায়গা দিয়েছিল।

মিশরীয়, ব্যাবলনীয়,রোমান, কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে খ্রিষ্টানরা যত অত্যাচার করেছে ইহুদীদের উপর তার ছিটেফোটাও করেনি মুসলমানেরা। অটোম্যান সাম্রাজ্যে সময় ইহুদীরা সুখে শান্তিতে বসবাস করেছে বিভিন্ন মুসলিম শহরে।

অথচ আধুনিক কালে এসে ইহুদীদের প্রধান শত্রু হয়েছে মুসলমানেরা। মাত্র ৮০ বছর আগে ইউরোপের খ্রিষ্টানরাও তাদের উপর নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছে অথচ খ্রিষ্টান নয় ইহুদীদের প্রধান শত্রু মুসলমান।

ইহুদী, খ্রিষ্টান আর মুসলমান এই তিন ধর্মের আদি ইতিহাস প্রায় এক। অথচ কয়েক শতাব্দি ধরে নিজেরাই যুদ্ধে লিপ্ত। এ এক অদ্ভুত নিয়তি মানবজাতির।

সবশেষ ১২ জুন,২৫ ইসরাইল আক্রমণ করে বসে ইরানকে। পারমানবিক বোমা যেন বানাতে না পারে এমন অযুহাতে মিশাইল হামলায় কয়েকশ মানুষকে হত্যা করে।

প্রধান সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করে। পরে যুদ্ধে যোগ দিয়ে ইরানের তিনটি পারমানবিক স্থাপনায় হামলা চালায় আমেরিকা। পাল্লা জবাবে কাতার ও ইরাকের আমেরিকার সামরিক ঘাটিতে মিশাইল ছোড়ে আমেরিকা।

১২ দিনের মাথায় ২৪ জুন,২০২৫ ট্রাম সোস্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা দেয় যুদ্ধবিরতির। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ আপাতত হয়ত শেষ হয়েছে।

কিন্তু ইহুদী-মুসলিম- খ্রিষ্টানের মনের ভিতরে বিদ্বেষের যে যুদ্ধ চলমান তার কি কোন পরিসমাপ্তি আছে? আল্লাই হয়ত ভালো জানেন।

(সমাপ্ত)


পারভেজ সেলিম

লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকর্মী



ইহুদী নিয়ে পুরো পর্ব পড়ুন :

পর্ব: ০১ ইহুদী: প্রতিশ্রুত ভুখন্ড ও রক্তাক্ত বর্তমান

পর্ব: ০২ : ইহুদী: ইউসুফ থেকে মুসা, মাঝে অন্ধকার

পর্ব: ০৩ : মুসা: ইহুদীদের ‘মুক্তিদাতা’

পর্ব: ০৪ : ডেভিড ও সুলোমন: ইহুদীদের স্বর্ণযুগ

পর্ব: ০৫ যীশু থেকে হলোকাস্ট: ইহুদীদের বিষ্ময়কর লড়াই !

পর্ব: ০৬ : রাষ্ট্রহীন ইহুদী: রাষ্ট্রের স্বপ্নে উন্মাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x