বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের যাবতীয় আলোচনায় মুসলমানি বাংলা সাহিত্য নামে একটি আলাদা অধ্যায় থাকে। অর্থটা পরিস্কার, হিন্দু বাংলা সাহিত্যই হলো মূলধারার বাংলা সাহিত্য, মুসলমানি সাহিত্য প্রান্তিক। হিন্দু অভিজাতদের উন্নাসিকতা কিংবা মুসলিমবিদ্বেষের একটা ভূমিকা হয়তো এই স্তরভেদের পিছনে কাজ করতেও পারে। হয়তো কেন, নিশ্চিতভাবেই করেছে। কিন্তু সেটাই এক ও একমাত্র কারণ নয়। আরও একটি গভীর সামাজিক প্রেক্ষাপটও এখানে আছে।
সাহিত্য, বিশেষত লিখিত সাহিত্যের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন। বিশ্বের কোনো দেশেই প্রাচীন ও মধ্যযুগে দরিদ্র জনসাধারণের শিক্ষার সুযোগ ছিল না। আর ভারতে তুর্ক আগমনের আগে বর্ণাশ্রমের কারণে উচ্চবর্ণ ছাড়া অন্য কারুরই শিক্ষার অধিকার ছিল না। বৌদ্ধ সংঘারামে অবশ্য তত্ত্বগতভাবে বর্ণভেদ থাকার কথা ছিল না। কিন্তু সম্রাট অশোকের আগেই বৌদ্ধধর্মও উচ্চবর্ণের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এইজন্যই প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সমস্ত সাহিত্যকারই ব্রাহ্মণ, এমনকি বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও। সামাজিক কারণেই এটা ছিল অনিবার্য।
বাংলায় ইসলামের আগমন হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিকদের মাধ্যমে। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী চট্টগ্রাম ও আরাকানে কিছু মানুষ (মূলত জেলে) কলমা পড়েছিলেন। কিন্তু তার প্রচাব ছিল খুবই সীমিত। বাংলায় ইসলামের প্রকৃত অনুপ্রবেশ ঘটে তুর্ক আগমনের হাত ধরেই। যদিও তার আগেও সুফি প্রচারকরা বাংলায় পৌঁছে গেছেন। তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। এবং তাঁদের প্রভাবে বর্ণাশ্রমপীড়িত অন্ত্যজ কিছু মানুষ ইসলামে দীক্ষা নেন। ইসলামের প্রসার ও প্রভাব বাড়ে বক্তিয়ার খিলজির নবদ্বীপ ও লক্ষণাবতী দখল করার পর থেকে। এই সময় থেকেই প্রচুর মুসলিম যেমন বাইরে থেকে বাংলায় আসেন, তেমনি প্রচুর সংখ্যায় স্থানীয় মানুষও ইসলামের কলমা পড়েন।
বহিরাগতদের ভাষা ছিল মূলত ফার্সী। এদের একাংশ ছিলেন ধর্মপ্রচারক, একদল অভিজাত, অনেকেই ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা। মোঙ্গল আক্রমণের ভয়ে কিছু কারিগরও হয়তো এসেছিলেন। কারিগররা বাদে বাকি সকলেই অতি দ্রুত প্রশাসনের অংশ হয়ে যান। শিক্ষা এদের ছিল, কিন্তু বাংলার প্রতি টান থাকার কোনও কারণ প্রাথমিকভাবে এদের ছিল না। অন্যদিকে যারা ধর্মান্তরিত হলেন, তাদের সিংহভাগই ছিলেন হতদরিদ্র নিম্নবর্গের মানুষ। তারা বাঙালী হলেও শিক্ষার কোনও অধিকার এতাবৎ তাদের ছিল না। তাই সাহিত্য রচনায় তাদের এগিয়ে আসাটা তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব ছিল না।
লিখিত সাহিত্য মূলত সাংস্কৃতিক আধিপত্যকারীর ভাষাতেই রচিত হয়। দীর্ঘ মুসলিম শাসন কিন্তু হিন্দু উচ্চবর্ণের আধিপত্যে তিলমাত্র আঘাত করেনি। বরং মুসলিম শাসকের প্রশাসনে হিন্দু অভিজাতদের কর্তৃত্ব যথেষ্ট বজায় ছিল। নাহলে বাংলার ভূস্বামীদের অধিকাংশই হিন্দু ছিলেন কিভাবে? এমনকি পূর্ববঙ্গেও? আর কেনই বা নিরন্ন কৃষকদের মধ্যে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ? এতে অবাক হবার কোনও কারণ নেই। মুসলিম সুলতান, নবাবরা কেউ ধর্মপ্রচারক ছিলেন না। তারা এসেছিলেন নিজের পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়ে রাজত্ব করতে। সেই আদায় যারা সবথেকে ভালো করে দিতে পারবে, তারা তাদেরই পুছবেন, এতো সহজ সত্যি। ফলে বর্ণাশ্রমের প্রকোপ তো কমলই না, উলটে সামাজিক স্তরবিন্যাসনিরপেক্ষভাবে সমস্ত মোমিনকে এক চোখে দেখার ইসলামি আদর্শ গেল বদলে। মুসলিম সমাজেও চলে এল একধরনের বর্ণবাদ, যেখানে সৈয়দরা হলেন ইসলামি ব্রাহ্মণ আর আনসারিরা ইসলামি চণ্ডাল।
ফার্সি ভাষা আয়ত্ত্ব করে সুলতান আর নবাবদের দরবারে হিন্দু উচ্চবর্ণই দাপট বজায় রেখে গেল। এর সর্বশেষ উজ্জ্বল উদাহরণ হলেন রাজা রামমোহন রায়। তাঁর প্রথম গ্রন্থটিই তো ফার্সিতে লেখা। এই পুরো পর্যায় জুড়েই বাংলায় সাংস্কৃতিক আধিপত্য ছিল ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চবর্ণ হিন্দুদের হাতেই। স্বভাবতই সাহিত্যেও ছিল তাদেরই আধিপত্য। মাঠে-ময়দানে রাম আর রহিমের প্রতিদিনের সংযোগে যে বাংলা ভাষার বুনিয়াদ গড়ে উঠছে, আধিপত্য বজায় রাখার জন্য স্বাভাবিকভাবেই এরা নিলেন ভিন্ন মার্গের বাঙলার আশ্রয়। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় চলে আসা ফার্সি শব্দগুলোকে বহিস্কার করা হয় তো গেল না, কিন্তু ভাষার চলনটাকে নিয়ে যাওয়া হলো সংস্কৃতের কাছাকাছি। আর এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর মুখের ভাষার বদলে ভিন্ন একটা ভাষাই হয়ে গেল সাহিত্যের ভাষা।
এই ভাষা উচ্চবর্ণ হিন্দুর আবিষ্কৃত ভাষা। কাজেই এই ভাষায় রচিত সাহিত্য হয়ে গেল মূলধারার সাহিত্য। আর মাঠের ভাষাকে অবলম্বন করে যে সাহিত্য রচিত হল, সে হল প্রান্তিক সাহিত্য, মুসলমানের সাহিত্য। একটা মজা দেখবেন? মির মুশাররফ হুসেন যখন বিষাদসিন্ধু লিখছেন, আরবি ও ফার্সি শব্দের বাহুল্য সত্ত্বেও তার ভাষার চলন বঙ্কিমের কাছাকাছি। অথচ সেই মানুষটাই যখন জমিদারদর্পণ লিখছেন, সেই ভাষা হয়ে উঠছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষার কাছাকাছি। ভাষা ও সাহিত্য কিভাবে আধিপত্যের বুনিয়াদ নির্মাণ করে, এটাই তার বড় উদাহরণ।
লেখকের ফেসবুক থেকে